ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মন ভালো নেই, অক্ষরের গায়ে ঝরাপাতার গন্ধ

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
 মন ভালো নেই, অক্ষরের গায়ে ঝরাপাতার গন্ধ

শিহাব শাহরিয়ার : তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। অফিসে নিজের কক্ষে বসে কম্পিউটারে কাজ করছি; আমার সহকর্মী কঙ্কন কান্তি বড়ুয়া দরোজা খুলে কক্ষে ঢুকে বললেন, ‘শাকিল মারা গেছে’।

 

বলেই চলে গেলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম... শাকিল! কোন শাকিল?

 

হৃদয়ে দপ্‌ করে অনেকগুলো আশঙ্কা জ্বলে উঠল। আমি সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে একটি অনলাইন বাংলা পোর্টালের প্রথম পৃষ্ঠার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল- সুপুরুষ শাকিলের ব্যক্তিত্বপূর্ণ একটি ছবি।

 

আহ, আহা এ তো মাহবুবুল হক শাকিল...! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী, কবি, গাল্পিক, সুন্দর আড্ডার প্রাণবন্ত পুরুষ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি, এরশাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের অন্যতম সাহসী ছাত্রনেতা, পড়ুয়া, দীর্ঘদেহি, শ্যামলরঙা বলিষ্ঠ পুরুষ, নিরাহঙ্কারী, ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মাহবুবুল হক শাকিল।

 

ছবির উপরে বড় করে লেখা ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল ইন্তেকাল করেছেন’। চুপচাপ ভাবতে থাকলাম, এমন মৃত্যুর খবর কেন আমার কানে আসে? কেন আমি মানতে পারি না এমন মৃত্যু? কোনো কোনো মৃত্য এমনই হয়, যা বেদনার জানালা খুলে দেয়, যে জানালা দিয়ে উত্তরের হু হু বাতাস ঢুকে যায় মন-ঘরের ভিতরে আর নীরবে টুপটুপ ঝরে কষ্টের শিশির হৃদয়ের দুর্বাঘাসে। শাকিলের মৃত্যুর খবরে আমার বুক ব্যথায় ভরে গেল... আহা, এই তরতাজা মানুষটি কি সত্যি মারা গেছেন? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

 

আমি মৃত মানুষের মুখ দেখি না। দেখি না কারণ, মানুষটির তাজা-জীবন্ত মুখটাই মনে রাখতে চাই। শাকিলের মৃত-মুখটিও আমি দেখবো না। ওর ব্যক্তিত্বপূর্ণ গম্ভীর মুখটিই আমার সামনে থাকুক, যতদিন থাকে। ওর কণ্ঠস্বর তো আমার কানে এখনও বাজছে, সর্বশেষ কণ্ঠস্বর, ভারী গলা... ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ঠিক সাত দিন আগে, টেলিফোনে। ওর যে নম্বরটি আমার কাছে আগে থেকে ছিল, সেটিতে কল যাচ্ছিল না, বন্ধ পাচ্ছিলাম। পরে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী কবি ও সাংবাদিক শাহনাজ মুন্নীকে ফোন করে ওর নম্বরটি নিয়ে ফোন দিলাম। রিং বেজে উঠতেই দরাজ কণ্ঠে বলল, কে বলছেন?

 

আমি বললাম, শিহাব শাহরিয়ার।

ওপাশ থেকে বলল, শিহাব ভাই কেমন আছেন?

বললাম, ভালো, তুমি কেমন আছো?

বলল, জ্বি ভালো, বলেন শিহাব ভাই?

 

বললাম, বেশ কয়েকজন লেখক গাজীপুরে একটা জায়গা নিয়ে লেখক-পল্লী গড়ে তুলতে চাচ্ছে, ওরা তোমাকেও চায় সেখানে। ও বলল, শিহাব ভাই, আপনার মাধ্যমে তাদের ধন্যবাদ দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমি সেখানে থাকতে পারবো না। কারণ আপনি তো জানেন, এই ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশে আমার কোনো জমি নেই, বাড়ি নেই, ফ্ল্যাট নেই। আমার প্রয়োজনও নেই, আমি একজন সাধারণ, নির্লোভ মানুষ। ... লেখকদের জন্য শুভ কামনা আর আপনিও ভালো থাকবেন... শেষ... আর কোনো দিন কথা হবে না, দেখা হবে না।

 

তারপর অফিস থেকে ফেরার পথে মোবাইলে ফেসবুক অন করলাম। দেখলাম, পরিচিত সবাই নানান রকম ছবি দিয়ে শাকিলের মৃত্যুর খবর দিয়েছেন। গেলাম শাকিলের একাউন্টে। সেখানে তাঁর কবিতা, গল্প, অভিমান, অভিজ্ঞতা আর জীবনের নানা মাত্রিক নির্যাস নিয়ে অসংখ্য স্টেটাস। বৃহত্তর পাঠকদের জন্য ওর লেখার কিছু অংশ তুলে ধরছি। কারণ ওর জীবন-ভাবনা এতো প্রখর, তা আমি নিয়মিত অনুসরণ করতে পারিনি বলে, বুঝতে পারিনি। অনেকগুলো স্টেটাস পড়তে পড়তে আমার গভীর রাত হয়ে গেছে। যেমন গত ২৮ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে পোস্ট করা কবিতাটি :

 

‘নক্ষত্রশোভিত রাতে

আমরা কি ঘুমিয়ে ছিলাম সেই রাতে? সেইসব রাতে?

নক্ষত্র খচিত রাত বার্তা পাঠায় ভালোবাসার, মলাট

খুলি না, ভুলে যাই পিতামহের হিমাগার, আধখানা বই।

তোমার হেমন্ত দিনে আমার বসন্ত আসে ক্রমাগত স্বাদু

জিলিপির মতো. ভুলেও অনিকেত আমি ঠিকানা জানি না।

এইসব মধুরাত শেষ হয় নিশ্চয় মরণের কালে, আমাদের

শরীর মরে যায়, মরে যায় নিকষ অক্ষর, নক্ষত্রশোভিত রাত।’

 

সেই একই দিনে তাঁর অন্য একটি স্টেটাস : ‘মূলত আমি কেউ না, না রাজনীতিবিদ, না কবি, না গল্পকার, এমনকি নই তুমুল সংসারী। এক অভিশপ্ত চরিত্র যার কিছুই থাকতে নেই। সাধু কিংবা সন্ত নই, চোখ জ্বলজ্বল করে জীবনের লোভে। চন্দ্রাহত, বিষাদ এবং ভূতগ্রস্ত, বসে থাকি ব্রহ্মপুত্র ঘাটে, শেষ খেয়ার অপেক্ষায়...’

 

গত ২৩ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে পোস্ট করা বঙ্গবন্ধু-কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে স্টেটাস : ‘মায়ের মতো একজন বোনের হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ থাকে, স্বপ্ন দেখে সুবর্ণ প্রভাতের, একটি আধুনিক স্বর্ণগ্রামের...’

 

এর আগের দিন পোস্ট করা একটি কবিতাও চোখে পড়ল তার ফেসবুক পেজে।

 

‘ক্ষমা করো নদী, ক্ষমো মোরে বালিকা

কোনোদিন সেই নদীর কাছে গিয়ে বলা হলো না,

ক্ষমা করো বালিকা, চিরতরে ঢেকে দাও তোমার জলে।

ঘনিষ্ট বসবাস যে হৃদয়ের আমাদের কণ্ঠের কাছে,

অবসর হলোনা শোনার কি দুঃখ তার গভীর ভিতরে আছে?

তবুও এই আয়ুক্ষয়, বৃথা বাক্য, জীবন নিংড়ে নেয়া কাব্যদোহন

আমাদের ভ্রমণপিয়াসু উড়ন্ত মন নিয়ে কেবলি নিরুদ্দেশে চলে যায়।

প্রাচীন গুহা ভরে উঠে সারিবদ্ধ অচেনা মৃতদেহের স্তুপে, 

সোনালী গমের মতো রৌদ্রময় দিনে যাত্রা থামে ধ্বংসের কাছে এসে।’

 

এখন হেমন্তের সোনালী গমের সময়; এখন রৌদ্রময় দিনের সময়, কোন্ এক ধ্বংসের কাছে এসে থেমে গেল শাকিলের জীবন যাত্রা? কিংবা ধরুন ২১ নভেম্বর পোস্ট করা কবিতাটি :

 

‘নিজস্ব বলে কিছু নেই, পিতা কিংবা মাতা, সহোদর?

বহুদূর, এমনকি ভগ্নিকূল, কিছুই থাকে না, নিজস্ব অন্তর্বাস

চলে যায় ভুল ঠিকানায়, বেপথু রাতে, দ্রাবিড় পূর্ণিমায়।

আমি নই তোমার একান্ত নিজস্ব, তোমারও তৃষা জাগে হায়

অচিন মধ্যরাতে কোনো এক আগুনমুখীর শাখা-প্রশাখায়।’

 

শাকিল যে এতো ভালো লিখতো আমি জানতাম না। কাল রাত ছিল শাকিলকে উৎসর্গ করা আমার রাত। আমি ওর কবিতা, গল্প আর জীবন ভাবনার স্টেটাসগুলো পড়তে পড়তে গভীর ঘোরের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছি। ভোরে উঠেও শাকিলকে চোখ থেকে সরাতে পারছি না। বার বার ভেসে উঠছে ওর চেহারা। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দুই ব্যাচ নিচে ছিল, সমাজ বিভাগের ছাত্র। আমি বাংলা বিভাগে। ওর ক্লাসমেট মিরপুরে আমার বাসার পাশাপাশি বসবাস করা একে আজাদ খোকনের মাধ্যমেই ক্যাম্পাসে শাকিলের সঙ্গে একদিন আমার পরিচয়। দেখতে লম্বা, সুগঠিত শরীর। বাড়ি ময়মনসিংহ। আমার শেরপুর। মিল আরো একটি বড় বিষয়ে-নদী। দু’জনেই ব্রহ্মপুত্র নদের চেহারা দেখে কৈশোরিক কাল কাটিয়েছি। ওকে দেখতাম ছাত্রলীগের মিছিলে, স্বৈরচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে।

 

একদিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠিনক সম্পাদক নির্বাচিত হলো, অভিনন্দন জানালাম। এর কয়েক বছর পর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতিও নির্বাচিত হলো; তখনও অভিনন্দন জানালাম। রাজনীতির পাশাপাশি ওর প্রচুর বই পড়া ও আড্ডা দেওয়ার অভ্যাস ছিল। ছাত্রত্ব শেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূল দলে প্রবেশ করেছে একজন তথ্য-গবেষক হিসেবে। যথাযথ সেটি। বঙ্গবন্ধুর তনয়া তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন ঠিকই। মেধাবী শাকিলকে তিনি তাই তাঁর কাছে রেখেছেন। বানিয়েছেন উপ-প্রেস সচিব ও পরে অতিরিক্ত সচিবের পদ-মর্যাদায় বিশেষ সহকারী হিসেবে। শুনেছি শাকিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-ভাষণের খসড়া তৈরি করতেন। উপযুক্ত কাজ। কারণ, ওকে দেখতাম প্রচুর বই কিনতে, পড়াশোনা করতে। বই কিনতে দৌড়ে চলে আসতো শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে, বিশেষ করে পাঠক সমাবেশে। তাকের দিকে তাকিয়ে প্রয়োজনীয় বই খুঁজতেও দেখেছি ওকে। বই পাগলই কেবল ছিল না, বই লেখার কাজেও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিল। বিশেষ করে কবিতায়। কাল রাতে ইউটিউব থেকে শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর ছোট তনয়া শেখ রেহানাকে নিয়ে ওর একটি মর্মস্পর্শী কবিতা; যেটি আবৃত্তি করেছেন বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্যজন এবং মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

 

দারুণ কবিতা! কবিতাটিতে আছে আগস্টের শোকগাথা। আছে ছোট্ট শেখ রাসেলের সাইকেলের কথা। সম্প্রতি লিখতে শুরু করেছে গল্প। ওর লেখা প্রকাশিত দুটি গল্প আমি পড়লাম। ও নেই বলে বলছি না, প্রকৃত অর্থে শাকিলের গল্পের হাত অসাধারণ। একই ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাড়ি বলেও বলছি না, শাকিল গল্পে হুমায়ূন আহমেদের একই ট্রেনে চড়তে পেরেছিলেন বলে মনে করি। কারণ সহজ করে, সুন্দর করে গল্প উপস্থাপন করার চমৎকার মুন্সীয়ানা বা দক্ষতা সে দেখিয়েছে। তার গল্প আপনারা পড়লে, আমার সঙ্গে একমত হবেন বলে বিশ্বাস। ফেসবুকে ওর একাউন্টে দেখেছি; একটি গল্প লেখা শেষ করে সে কি স্বস্তির নিঃশ্বাস!

 

একটু তুলে ধরি : ‘মনটা ভীষণ রকমের খারাপ ছিল। এখন ভালো লাগছে, অনেক অনেক ভালো। গল্পটা লিখে ফেললাম- রেখো মা দাসেরে মনে'।

 

লেখার প্রতি আত্মনিবেদিত ছিল মাহবুবুল হক শাকিল। আর লেখকদের প্রতিও ছিল তাঁর অসম্ভব দরদ। উদাহরণ টানুন না, কবি শহীদ কাদরী, যিনি মারা গেলেন আমেরিকায়, তাঁকে বাংলাদেশে আনা এবং দাফন করা, তাঁর শোকসভা করা; উদ্যোগ নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানানো। আরেক মায়াবতী শ্যামল বাংলার শ্যামল কন্যা শাকিলকে সব ব্যবস্থা করতে বললেন। তারপর সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের চিকিৎসা ও দাফন। কবি হেলাল হাফিজের চিকিৎসা... তারপর সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার মনোনিবেশ এবং তৎপরতা ছিল দেখার মতো।

 

বিলেতে বাংলা বইমেলা, ফ্রাঙ্কফ্রুট বইমেলায় বাংলাদেশের লেখক-প্রকাশকদের নিয়ে অংশগ্রহণ করা। লেখকদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা- ইত্যকার সব জায়গাতেই মুখর ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কি হয়ে গেল? মাত্র ৪৭ বছরের জীবন নিয়ে পাড়ি জমাল সে অনেক অনেক দূরের দেশে। পেছনে রেখে গেল ব্রহ্মপুত্র নদ... পেছনে রেখে গেল প্রিয় স্বজনদের... একমাত্র সন্তান মেয়েটির বুক কি ভেসে যাচ্ছে না হাহাকারের ঢেউয়ে? বাবার ছবি বুকে নিয়ে ওই ছোট্ট মানুষটি কত দূর দৌড়াবে আর? আকাশের শূন্যতা ছুঁয়ে দেওয়া তার পক্ষে কি সম্ভব? বাবা যে ওকে নিয়ে লিখেছিল :

 

‘পায়ের নিচে খেলতে থাকবে শৈশবের সর্ষেদানা, মধ্যবিত্ত

দিন আর রাত্রি কানে কানে বলে দেবে, ‘সুখে থেকো বাছা, এইতো সময়।’

 

মেয়েকে নিয়ে এই কবিতাটির নাম শাকিল দিয়েছে ‘আত্মজার জন্য’। উৎসর্গ চরণে শাকিল লিখেছে, ‘মৌপি, তোকে নিয়ে আমার কোনোদিন কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি- ইতি বাপ’।

 

আহা!

           শাকিল, তোমার কথা দিয়ে তোমাকেই বলি : ‘মন ভালো নেই, অক্ষরের গায়ে ঝরাপাতার গন্ধ...’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়