ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

মরছে শালতা, ধুঁকছে জীবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৬, ২২ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মরছে শালতা, ধুঁকছে জীবন

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সাতক্ষীরার শালতা নদীর তীর ঘুরে :  বিপন্ন ধূসর জনপদ। আঁকাবাঁকা সরু মেঠোপথ। গাছপালা কম। ফাঁকা বাড়িঘর। কিছু মাঠে থইথই পানি। কিছু মাঠ বিরান। সবুজের চিহ্ন মাত্র নেই।

ধুলো উড়িয়ে চলে মোটরবাইক, ভ্যান, বাইসা্ইকেল। মাছের ঘের করার প্রস্তুতি পর্বে কিছু মানুষের হাতে এখন কাজ আছে। কিন্তু অধিকাংশই কর্মহীন। রোজগারের তাগিদে কেউ কেউ শহরমুখী। যাদের সঙ্গে আলাপ হলো, প্রত্যেকের মুখেই হাজারো সংকটের কথা। আর সংকটের নেপথ্যের কারণ বলতে গিয়ে সবাই আঙুল  তোলেন মরা নদীর দিকে।

নদীটির নাম শালতা। এক পাড়ে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার কাঠবুনিয়া, আরেক পাড়ে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রাম। মাঝখানে বয়ে গেছে এ নদী। একাংশ মিলেছে বুড়িভদ্রার সঙ্গে আরেক অংশ মিলেছে শিবসা নদীর সঙ্গে। মাঝখানে অন্তত ১২ কিলোমিটার একেবারেই মরে গেছে। কিছু অংশ মিশে গেছে সমতল ভূমির সঙ্গে। নদীর স্থানে উঠেছে বাড়িঘর, অন্যান্য স্থাপনা। কোথাও হয়েছে চিংড়ির ঘের।

যে নদী সচল রেখেছিল মানুষের জীবন, গ্রামে ফিরিয়ে দিয়েছিল প্রাণচাঞ্চল্য, সবুজ করে রেখেছিল গ্রামের পর গ্রাম, বহু মানুষকে দিয়েছিল কাজের সন্ধান, সেই নদী এখন হাজারো মানুষের অভিশাপ।

শালতা তীরবর্তী তালা ও ডুমুরিয়া উপজেলার কয়েকটি গ্রাম সরেজমিন ঘুরে মিলছে নানা তথ্য। দুই উপজেলার ১৫ গ্রামের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ চরম ভোগান্তিতে দিন কাটাচ্ছে বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কাঠবুনিয়া, বৈটেয়ারা, বাটুলতলা, মহান্দী, বয়ারশিং, মুড়োবুনিয়া, পুটিমারী ও সুন্দরবুনিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ অভিযোগ করেন, নদী ভরাট হওয়ায় তাদের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। নদী খনন করার দাবি এলাকাবাসীর। তবে খননের আগে নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। কারণ অনেক স্থানে নদীর চিহ্নমাত্র নেই। কেউ কেউ একসনা বন্দোবস্ত নিয়ে ভরাট নদীর বুকে বাড়িঘর তুলেছে, মাছের ঘের করেছে। তাই খননের আগে সীমানা নির্ধারণ না হলে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে।

ডুমুরিয়ার বৈটেয়ারা গ্রামের বাসিন্দা হিমাংশু মন্ডল (৬০) বলছিলেন, শালতা নদীর মাঝে এখন ঘের-বাড়িঘর। কুড়ি বছর আগের অন্তত ৪০০ ফুট প্রশস্ত নদীটি এখন একেবারেই মরে গেছে। সরকারি ম্যাপে এই নদীর প্রশস্ত কোথাও ৪৫০ ফুট, কোথাও ৫০০ ফুট আবার কোথাও ৪০০ ফুট। নদীর বর্তমান অবস্থা দেখে সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। এই নদীতে একসময় স্টিমার চলত। এখন সে দিন নেই। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা।

আন্ধারমানিক গ্রামের অধীর কুমার জোয়ার্দার (৭৮) বলেন, নদী সচল থাকাকালে এলাকায় বেশ ধান হতো। হরকোজ ধান, বালাম ধান, পাটনাই ধানসহ বিভিন্ন জাতের ধানের খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। সেসব ধান হারিয়ে গেছে। মরে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। যেসব মানুষ এলাকার কৃষিকাজে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা এখন বেকার। কিছু মানুষ মাছের ঘেরে কাজ করতে পারলেও অনেকেই রোজগারের প্রয়োজনে এলাকার বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

বৈটেয়ারা গ্রামের ক্ষুদ্র ঘের মালিক কৃষ্ণপদ মন্ডল (৪০) বলছিলেন, ‘নদী মরে যাওয়ার কারণে আমরা কেউই ভালো নেই। জমিতে হালচাষের দিন শেষ হয়েছে আগেই। নিরূপায় হয়ে অনেকে মাছের ঘের করেছে। কিন্তু ঘেরেও রয়েছে হাজারো সমস্যা। বর্ষাকালে মাঠের পর মাঠ বৃহৎ বিলে পরিণত হয়। ঘেরের মাছ ভেসে যায়। ঘের মালিকরা লোকসানে পড়ে। বড় ঘেরের মালিকরা কিছুটা ভালো থাকলেও ছোট ঘেরের মালিকরা মোটা অঙ্কের দেনায় জড়িয়ে পড়ে।’

সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, শালতা মরে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ায় বর্ষার ছয় মাস এই এলাকার মানুষ এলাকায় কোনো কাজ করতে পারেন না। এ সময় যাতায়াত সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। স্বাভাবিক জীবনের গতি থমকে দাঁড়ায়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে চরম সংকট দেখা দেয়। প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। রোগীকে যথাসময়ে চিকিৎসকের কাছে নিতে না পারায় অনেক সময় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। জলাবদ্ধতায় দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই। বর্ষাকালে চিংড়িঘেরে কিছু মানুষের কাজের সংস্থান হলেও তাদের মজুরি একেবারেই কম। সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা।

 


কাটবুনিয়ায় শালতা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে মুনসুর আলী বিশ্বাস (৬৫) নদীর দিকে আঙুল তুলে বলছিলেন, ছোটবেলায় এই নদী সাঁতরে এপার থেকে ওপারে যেতে পারিনি। এখন তো নদী আমাদের মরণ। বর্ষাকালে পুরো এলাকা ডুবে থাকে। নদী খনন না করলে এলাকার মানুষ বাঁচবে না। অবিলম্বে নদী খনন করতে হবে। তবে খননের আগে নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে এলাকা ছেড়ে মানুষদের অন্যত্র চলে যেতে হবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, বর্ষায় গোটা এলাকা ডুবে থাকলেও শুকনোয় ঠিক উল্টো চিত্র চোখে পড়ে। পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। দূরদূরান্ত থেকে আনতে হয় খাওয়ার পানি। শুকনো মৌসুমে এইসব এলাকার মানুষরা বর্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কেউ মাটি কাটেন। কেউবা ঘরবাড়ি সংস্কার করেন। কেউবা অতিরিক্ত রোজগার করে সংকটকালের জন্য কিছু খাবার মজুতের চেষ্টা করেন। বর্ষা এলেই যেন এলাকার মানুষের দুঃখ নেমে আসে। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে, সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলা এবং খুলনা জেলার পাইকগাছা ও ডুমুরিয়া উপজেলার সীমানা বিভাজন করে মাগুরখালী ইউনিয়নের কাঞ্চননগরের ঘ্যাংরাইল নদীতে মিলিত হয়েছে শালতা। শালতা থেকে ঘ্যাংরাইল নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার। ১০টি ইউনিয়নের ৯৪টি গ্রাম রয়েছে। নদী তীরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় আট হাজার জেলে পরিবারের বসবাস। নদী ভরাটের কারণে জেলে পরিবারগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছে। কাঞ্চননগরের ঘ্যাংরাইল নদী থেকে উজানের কাঠবুনিয়া পর্যন্ত বর্তমান শালতা নদী সীমাবদ্ধ।

তালা উপজেলা পানি কমিটির সাধারণ সম্পাদক মীর জিল্লুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে জোয়ার-ভাটা না থাকার কারণে পলি পড়ে শালতাও ভরাট হয়ে গেছে। এ জন্য শালতা অববাহিকার জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ বেকার হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এ মুহূর্তে শালতা নদী খনন না করলে এলাকার মৎস্যজীবীসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।

এলাকা ঘুরে জানা গেছে, অনেকে মাছ ধরার পেশা পরিবর্তন করে বিভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছে। আবার অনেকে পেশা পরিবর্তন করতে না পেরে বিভিন্ন মৎস্য ঘেরে শ্রমিক হিসেবে মাছ ধরছেন। এতে জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের সংসার চালাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে অনেক পরিবারের। তালা উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার পূর্বে জেয়ালানলতা গ্রাম। এই গ্রামে প্রায় এক হাজার মৎস্যজীবী পরিবারের বসবাস। জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বেকার হয়ে অলস সময় পার করছেন। পার্শ্ববর্তী শালতা নদী ভরাট হওয়ায় তাদের হাতে এখন কাজ নেই। একসময় নদীতে মাছ ধরেই তাদের সংসার চলত।

শালতার সংকট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার বিভাগীয় প্রধান প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম জানান, খুলনার ডুমুরিয়া থেকে টিয়াবুনিয়া পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার শালতা খনন করা হবে। এতে বরাদ্দ হয়েছে ৯৩ লাখ টাকা। দ্রুতই টেন্ডার আহ্বান করা হবে।

নদীর অন্যান্য অংশ খনন হবে কি না সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি তিনি।

তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নদীর এই অংশটুকু খনন করলে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। একই সঙ্গে নদীর মরে যাওয়া অংশ খনন করতে হবে। আর তাহলেই শালতা সচল হবে। মানুষের সংকট মিটবে।
 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জানুয়ারি ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/রুহুল/এএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়