ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মরুভূমি থেকে কেনা ভালোবাসার উপহার

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৬, ১৭ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মরুভূমি থেকে কেনা ভালোবাসার উপহার

দোহা, কাতার

শিহাব শাহরিয়ার : সকালের রোদ ফুটে আছে মরুর পিঠে। বালুময় মরু। বিমানের  জানালা দিয়েই দেখলাম সেই রোদ। ধীরে ধীরে কাতার এয়ার লাইন্সের বিমানটি ভূমিতে অবতরণ করছে। দীর্ঘ প্রায় ছয় ঘণ্টা ভ্রমণের ক্লান্তি মুছে ফেলে এক উৎসুক মনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি মরুর দেশ কাতার।পুরো বিমানবন্দর ঝলমল করছে। সময়ের ব্যবধানে এখন সকাল এই কাতারে, আর আমরা বাংলাদেশ থেকে বিমানে উঠেছিলাম গভীর রাতে।

আমেরিকা যাওয়ার পথে ট্রানজিটের জন্য আমরা নামলাম বিমান থেকে। আমরা বলতে তেরো জন। ইমিগ্রেশন শেষে এয়ার লাইন্সের ট্রান্সপোর্ট বাসে করে আমাদের বিমানবন্দর থেকে নিয়ে গেল কাতারের রাজধানী কাতার শহরে। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি বেশ উন্নত। তেলসমৃদ্ধ দেশের একটি। এরা আধুনিক আদলে গড়ে তুলেছে শহর। মরুর বালির পাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চেহারা রাস্তা-ঘাট ও দালান-কোঠা। গাড়িতে যেতে যেতে এই চেহারা অবলোকন করছি। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর হোটেলের সামনে আমাদের গাড়ি থামল। পাঁচ তারকা হোটেল। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম কাতার দর্শনে।

আমার সঙ্গে আছেন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মণিপুরী ভাষার একজন সমরজিৎ রায় সিংহ। মেধাবী মানুষ তিনি। জ্ঞান-গরিমা, সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কেও তাঁর ধারণা প্রখর। আমার তাতে সুবিধাই হলো। কারণ ভ্রমণে এবং নতুন জায়গা বিশেষ করে বিদেশ বিভূঁইয়ে একজন উপযুক্ত সঙ্গী হলে ভ্রমণটা বেশ আনন্দের হয়। সমরদা সেরকমই একজন। হোটেলে আমাদের পাশাপাশি রুম দিয়েছে। দু’জন মিলে বেরিয়ে পড়লাম। আগে জানতাম না যে, আমাদের হোটেলের পাশেই বাংলা বাজার আছে। বাংলা বাজার বলতে কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশীদের গড়ে তোলা একটি বাজার, যেখানে বাংলাদেশের শাক-সবজি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা একটি ছোট্ট বাংলাদেশ এই জায়গাটি। সে বিষয়ে পরে আরেকটি বয়ান করা যাবে।


আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, কাঁচা বাজার এবং শুকনো বাজারও। কৌতূহল নিয়ে ফুটপাতের একটি দোকানে খাবারের জন্য বসলাম। দোকানটি যেমন ধরা যাক বাংলাদেশের ফুটপাতের কোনো পিঁয়াজু, আলুর চপ বিক্রি হয় এমন। কিন্তু খাওয়া হলো না, কারণ ডলার ভাঙানো গেল না। ঢুকলাম একটি মেয়েদের রকমারি জিনিসপত্রের দোকানে। আরবীয় সব জিনিসপত্র। ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা আমাদের হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। তখন স্থানীয় সময় রাত ন’টা বাজে। আগেই বলেছিলাম আমাদের হোটেলের পাশেই প্রবাসী বাঙালিদের জমজমাট আড্ডাখানা। একটি মার্কেটের পাশেই লনের মতো খোলা জায়গা, একদিকে বড় রাস্তা ও অন্যদিকে গলি রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে বাঙালিদের বাজার, দোকান। যেখানে লালশাক থেকে শুরু করে সব সবজি- তরিতরকারি, আটা-ময়দা, সাবান তেল কি নেই- সব আছে। পিঁয়াজু, পুরি, আলুর চপ, বেগুনি, ছোলা ভাজা হচ্ছে, সবাই নিচ্ছে খাচ্ছে। চা খাচ্ছে আড্ডা দিচ্ছে। দারুণ বাংলাদেশ!

মনে হলো ঢাকারই কোনো এলাকার চেহারা। সবাই বাংলায় কথা বলছে, কেনাকাটা করছে আড্ডা দিচ্ছে- দারুণ লাগল দেখতে। আমরাও পিঁয়াজু-চা খেয়ে যখন হোটেলে ফিরবো তখনই পিছন থেকে একজন ডাক দিল শিহাব, আপনি কেমন আছেন?
আমি তো অবাক! তাহলে কাতারেও পরিচিতজন পেলাম। কাছে এসে বলল, কেমন আছেন? আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, টিএসসিতে আবৃত্তি করতাম ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুক্ষণ কথা বললাম, ভালই লাগল। এরপর ফিরে এলাম হোটেলে। নিচেই রেস্টুরেন্ট। রাতের খাবার শেষ আমরা উঠে গেলাম উপরে যার যার কক্ষে। কিছুক্ষণ পর আমার কক্ষে নক করলেন সমরদা। বললেন, চলুন কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়া যাক। আমি সায় দিলাম। বসলাম তার কক্ষে। আমাদের ফ্লোরে আমেরিকাগামী আরো দুজন বাঙালি যাত্রী। একজন ছাত্রী, ও যাবে ওয়াশিংটন। ওর ফ্লাইট স্থানীয় সময় সকাল আটটায়। আরেকজন রয়েছেন যিনি পুরান ঢাকার নারী, সাবেক কমিশনার, যাচ্ছেন নিউইয়র্কে। আমাদের ফ্লাইট স্থানীয় সময় সকাল সাতটায়। সকাল সোয়া ছ’টায় এয়ার লাইন্সের গাড়ি আসবে, সুতরাং তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। তবু আড্ডা জমলো রাত গভীর পর্যন্ত। দু’জন নারী, দুজন পুরুষ- আড্ডার বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শুরু করে আমেরিকা দেখার প্রথম স্বপ্ন। তবে মেয়েটি যাচ্ছে পড়াশোনা করতে। ওর মনটা একটু ভারী, কারণ আঠারো-উনিশ বয়সের মেয়েটি বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে প্রথম যাচ্ছে বলে, চোখে মুখে সেই মনোবেদনার ছাপ লক্ষ করলাম। বলল, আমার জন্যে দোয়া করবেন। মেয়েটিকে খুবই মেধাবী ও স্মার্ট মনে হলো।     


পরদিন সকালে উঠে কোনো রকম নাস্তা সেরে এয়ার লাইন্সের গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছুটে চলল বিমান বন্দরের দিকে। সকালের নরম রোদ হলেও, বাইরে তাপ অনেক প্রখর। গাড়ি থেকে নেমে ইমিগ্রেশনে দেখা হলো হাসান আজিজুল হকসহ ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে। বিমানবন্দরটি বেশ সুন্দর। বিভিন্ন দেশ থেকে বিমান ওঠা-নামা করছে। ওমানের মাস্কাটের মতই একটা ইমেজ বা ফ্লেবার পেলাম এই বিমান বন্দরেও। তবে কাতারের মানুষ আরবিতেই কথা বলে, ইংরেজিও আছে। ইমিগ্রেশনজুড়ে নানা দেশের মানুষ কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশী, ভারতীয়, আফ্রিকান, শ্রীলঙ্কান, নেপালি ও আরবের অধিবাসীরাও। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করে পুনরায় বিমানে উঠে উড়াল দিলাম আটলান্টিকের দিকে। সুদূর আমেরিকার উদ্দেশ্যে। নিচে ও ধীরে ধীরে পিছন হয়ে গেল রোদেভরা কাতার বিমানবন্দর। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের বলাকা কাব্যের কথা- যেন আমরা যাচ্ছি দূর থেকে সুদূরে। উপরের নীলাকাশ, সাদা মেঘের রাজ্য আর অনন্ত কুয়াশায়।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : আমেরিকা থেকে ফেরার পথেও এই কাতার বিমান বন্দরটিই ট্রানজিট ছিল ঘণ্টা তিনেকের। সেদিন দেখা হলো মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে, যিনি এই বিমান বন্দরটি ব্যবহার করে যাচ্ছেন মস্কোতে। তাঁরও সময় ছিল ঘণ্টাখানেক। ইমিগ্রেশনের পাশে বসেই অনেকক্ষণ আলাপ হলো, আড্ডা হলো এবং দুজনে মিলে ঘুরে ঘুরে দেখলাম ডিউটি ফ্রি শপিং সেন্টারগুলো। এরপর তিনি তাঁর বিমান ধরে চলে গেলন। আমার হাতে আরো ঘণ্টাখানেক সময় ছিল, হাতে ছিল সোয়াশ’ ডলারের মতো, তাই ভাবলাম কিছু চকোলেট আর একমাত্র বউটির জন্য নিয়ে যাই একটি সোনার আংটি। ঠিক একশ’ ডলারই লাগল। কিনলাম এবং দেশে ফিরে পরিয়ে দিলাম তার ফর্সা হাতের মধ্য আঙুলে, যেটি এখনও সে পরে আছে। ভালোবাসার উপহার কার না ভালো লাগে?





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়            

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়