ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মসূয়া জমিদারবাড়ি : সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা

রুমন চক্রবর্ত্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৮, ১ জানুয়ারি ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মসূয়া জমিদারবাড়ি : সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা

মসূয়া জমিদারবাড়ির মূল ভবনের সামনের অংশ

নেই কোনো প্রাচুর্য, নেই অহংকার, নেই জমিদারিও। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটা মসূয়া জমিদারবাড়ির কথা।

 

বংশানুক্রমে আজ আর কেউ এ বাড়িতে বাস করে না। তবু রয়ে গেছে কিছু স্মৃতিচিহ্ন। রয়েছে জরাজীর্ণ অবকাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ি। যার পরতে পরতে ছাপ পাওয়া যায় জমিদারিত্বের।

 

সংক্ষিপ্ত  ইতিহাস : মসূয়া জমিদারবাড়ির জমিদার ছিলেন হরি কিশোর রায়। তাঁর আদি বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ জেলায়। তৎকালীন সময়ে জমিদারিতে অনেক প্রভাব থাকলেও মনে তার শান্তি ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। পরবর্তীতে বড়ভাই কালীনাথ দেব ওরফে শ্যাম সুন্দর দেব ও জয়তারা দেবীর পুত্র কামদারঞ্জনকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন জমিদার হরি কিশোর রায়। জমিদারি প্রথা টিকিয়ে রাখতে দত্তক পুত্র কামদারঞ্জনের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখেন উপেন্দ্র কিশোর রায়। পরবর্তীতে অবশ্য জমিদার হরি কিশোর রায়ের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। যার নাম রাখা হয় নরেন্দ্র কিশোর রায়। লেখাপড়ায় মনোযোগী উপেন্দ্র কিশোর রায়কে পড়ালেখায় স্বাবলম্বী করতে মময়মসিংহ জেলা স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সেখানে হরি কিশোর রায়ের প্রভাব প্রতিপত্তী ছিল। এখনও তাঁর নিজ নামের একটি রাস্তা সে ইতিহাস বহন করে চলছে।

 

                                           মসূয়া জমিদারবাড়ির ভেতরের অংশ

 

জমিদারি প্রথার শেষলগ্নে : পালক পুত্র উপেন্দ্র কিশোর রায়কে নিয়ে হরি কিশোর রায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। তিনি চেয়েছিলেন পরবর্তীতে জমিদারি সে সামলাবে। কিন্তু পড়ালেখা, গানবাজনা ও ছবি আঁকায় মনোযোগী উপেন্দ্র কিশোর রায় ছিলেন পুরোই বিপরীত। তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল শুধুই পড়ালেখা। এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় সতের বছর বয়সে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলেজে অধ্যায়নকালেই জড়িয়ে পড়েন কলকাতার শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে।

 

সেই সুবাদে আন্তরিকতা আর ঘনিষ্টতা বাড়ে জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে। এক সময় খ্যাতিমান সংস্কারমুক্ত মনের মানুষ ব্রাহ্মনন্দ কেশব চন্দ্র সেনের সান্নিধ্যে থেকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। পরবর্তীতে জমিদারি প্রথা আর ভাবমূর্তি না থাকলেও বাবা হরি কিশোর রায় পুত্রের সুবাদে বেশ কয়েকবার ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের মসূয়া গ্রামে বেড়াতে এসেছিলেন।

 

                            কালের কষাঘাতে মসূয়া জমিদারবাড়ির জৌলুসহীন সামনের বারান্দা

 


পরবর্তী বংশধর : ১৮৮৩ সালে উপেন্দ্র কিশোর রায় ২১ বছর বয়সে বিএ পাশ করার পর, দ্বারকানাথ ও প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট- মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনীর একমাত্র কন্যা সন্তান বিধুমুখীকে বিয়ে করেন। তাদের বৈবাহিক জীবনে ১৮৮৭ সালে ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন দ্বিতীয় সন্তান সুকুমার রায়। জন্মের পর থেকেই পিতার সকল গুণাবলীই বিদ্যমান ছিল তাঁর মধ্যে। ১৯১৩ সালের গোড়ার দিকে সুকুমার রায় ঢাকার খ্যাতনামা সমাজসেবক কালী নারায়ণ গুপ্তের কন্যা সুপ্রভাকে বিয়ে করেন। বৈবাহিক জীবনের আট বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯২১ সালে ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত বাঙালী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তিনি একবারই বাংলাদেশের ঢাকায় এসেছিলেন।

 

                                        জমিদারবাড়ির ভেতরের একটি ঘর 

 


উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী : উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী বিয়ের পর চাকরি না করে সাহিত্য ও শিল্পকর্মে মননিবেশ করেন। তার পাশাপাশি তিনি ছাপা ও ব্লক তৈরির কলা কৌশল রপ্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৯১৩ সালে প্রথম বিখ্যাত পত্রিকা ‘সন্দেশ’ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি পরলোক গমন করেন।

 

সুকুমার রায় ছিলেন পিতার উত্তরসূরী। তিনিও সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য জীবনে বেশ প্রভাব ও আধিপত্যের মাঝেই বেঁচে ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অতি সহজে চিত্রাঙ্কণ, গানবাজনা ও অভিনয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি আলোকচিত্র ও ছাপাখানা প্রযুক্তি বিদ্যায় লন্ডন থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে ১৯১৩ সালে বাবার সুনামধন্য ছাপাখানা ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ এর ধ্যান ধারণায় মনোনিবেশ করেন। আর তাঁর স্ত্রী সুপ্রভাও ছিলেন গানের জগতে পারদর্শী ব্যক্তিত্ব। যার গান শুনতে ব্যাকুল ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর পর্যন্ত। সুকুমার রায় শিশু কিশোরদের জন্য বিভিন্ন হাসির ছড়া, কৌতুক ও প্রবন্ধ লিখে গেছেন। ‘সুকুমার সমগ্র’শিশুদের অত্যন্ত প্রিয় একটি গ্রন্থ। তা ছাড়া আবোল তাবোল, হ-য-ব-র-ল এমন অনেক অতুলনীয় গ্রন্থ লিখে গেছেন তিনি। ১৯২৪ সালে তিনি গ্রামের জমিদারি দেখতে মসূয়া আসেন এবং এখানে দীর্ঘ আড়াই বৎসর কালা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন।

 

পিতা ও পিতামহের কোনো কিছুই কমতি ছিল না সত্যজিৎ রায়ের মাঝে। তাঁদের নাম-যশ টিকিয়ে রাখতে আর পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারবাহিকতায় তিনিও শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে সব সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। ধীরে ধীরে নিজের মেধা আর বুদ্ধির চাতুর্যে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন সমগ্র বিশ্বে। তাঁর মেধা আর মননশীলতাকে এক নামে সবাই জানত বিশ্ব সাহিত্য আসরে। চিত্রাঙ্কণ, গানবাজনা ও অভিনয়ে তিনি ছিলেন অনন্য ও বিরল প্রতিভার অধিকারী। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তাক লাগিয়ে দেন সমগ্র বাঙালী জাতিকে। আর তাই তাঁর অসাধারণ প্রতিভা বলে আজো তাকে আমরা স্মরণ করি ‘অস্কার বিজয়ী’ সত্যজিৎ রায় হিসেবে।

 

জমিদারবাড়ির বর্তমান চিত্র : কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে সড়ক পথে ৩১ কিলোমিটার দূরে কটিয়াদী উপজেলা। সেখান থেকে আট কিলোমিটার ভেতরে মসূয়া গ্রামে অবস্থিত এ জমিদারবাড়িটি। বর্তমানে এর বাহ্যিক অবকাঠামো খুব নাজুক। খসে খসে পড়ছে পুরোনো ইট-পাথর-চুনের গড়া প্রাসাদটির বিভিন্ন অংশ। কোনো কোনো অংশ তৈরি হয়েছে মরণ ফাঁদে। প্রাসাদটির দ্বিতল ভবনের ছাদ ভেঙ্গে বিশালাকার এক গর্ত তৈরি হয়েছে। ঝুলে রয়েছে ছাদের উপরে বড় বড় লোহার বিম। প্রাসাদের চারিপাশে লতাপাতা আর বটবৃক্ষের আবর্তনে ঢাকা পড়েছে এর বাহ্যিক সৌন্দর্য্য।

 

                             মসূয়া জমিদারবাড়ির একটি অংশকে সংস্কার করে নির্মিত গেস্ট হাউজ

 


ভবনের পেছন দিয়ে চিকন সরু সিঁড়ি পথটি অনেক বছর আগে একবার সংস্কার করা হয়েছিল। বর্তমানে সেটা বিলীন হয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে ফাটল আর শ্যাওলা। তবে বর্তমানে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটাটি সরকারি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এই ভিটার চারপাশ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাড়ির পেছনে একটি ছোট পুকুর ও মূল ফটকের বাইরে একটি পুকুর ঘাট রয়েছে। জরাজীর্ণ বাড়িটির পাশের দরবারগৃহটি বর্তমানে মসূয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর মাঠের এক পাশে পর্যটকদের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়েছে একটি দোতলা রেস্ট হাউস।

 

মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা এক পর্যটক সারোয়ার হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী এ জমিদারবাড়ি। আমরা বর্তমান প্রজন্ম শুধু সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায় এটাই জানি। তাই সরেজমিনে দেখতে এখানে এসেছি। তবে অতিশীগগিরই যদি এর সংরক্ষণ ও পরিচর্যা করা না হয় তাহলে আগামী প্রজন্ম আর কিছু জানা বা দেখার সুযোগ পাবে না।

 

                                         মসূয়া জমিদারবাড়িতে ঢোকার সামনের গেট

 

স্থানীয় গ্রামবাসী নারায়ণ চন্দর দাস রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই এ বাড়িটি দেখে আসছি। এ জমিদার বাড়ির সামনের অংশে বড় পূজা অনুষ্ঠিত হতো সে সময়। আরো অনেক কিছুই ছিল, কিন্তু বর্তমানে সেসবের কিছুই নাই। স্বাধীনতার পর অনেক মূল্যবান জিনিস চুরি হয়ে গেছে। আর আশপাশের অনেক জায়গাও দখল হয়ে গেছে। বর্তমানে বাড়িটির পেছনে একটি মাজার রয়েছে। তবে এর আগে আমরা এ মাজারটি দেখিনি। তবে মাজারে অবস্থিত লোকজন ঔ জমির কিছু অংশ তাদের নিজস্ব ভূমি বলে দাবি করছে। প্রতিদিনই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ এখানে পর্যবেক্ষণ করতে আসেন, তবে তারা বিমুখ হয়ে ফিরেও যান।’

 

যেহেতু এ জমিদার বাড়িটি একটি ইতিহাস ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি বাড়ি, তাই যত দ্রুত সম্ভব এটি সংস্কার এর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

 

 



রাইজিংবিডি/কিশোরগঞ্জ/রুমন চক্রবর্ত্তী/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়