ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মাওরি এবং ঐতিহ্যবাহী হাকা-মোকো

শাহিদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৮, ২৪ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাওরি এবং ঐতিহ্যবাহী হাকা-মোকো

শাহিদুল ইসলাম : মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের আদি অধিবাসী। ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতকে এরা পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে নিউজিল্যান্ডে এসেছিল। মাওরি ভাষায় ‘মাওরি’ অর্থ ‘স্বাভাবিক’ বা ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘সাদাসিদে’। আসলেই নিউজিল্যান্ডের আদি অধিবাসী মাওরিরা যেন প্রকৃতির সন্তান।

 

মাওরিরা নিউজিল্যান্ডকে বলে আতিরোয়া। মাওরি ভাষায় এর অর্থ ‘দীর্ঘ শ্বেতমেঘের দেশ’। মাওরিদের মৌখিক ইতিহাস থেকে জানা যায় ১২৫০ থেকে ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষরা পলিনেশিয়ার হাওয়াইকি থেকে বড় সমুদ্রগামী বাঁকানো নৌকা নিয়ে সমুদ্রপথে নিউজিল্যান্ডে প্রবেশ করে এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

 

মাওরিরা প্রথমে উপকূলে অবতরণ করে সেখানে বসবাস করতে থাকে। বেঁচে থাকার তাকিদে তারা মৎস শিকার শুরু করে। মৎস শিকারে তারা নিজস্ব কিছু কৌশল উদ্ভাবন করেছিল। এই কৌশল কাজে লাগিয়ে তারা উপকূলে সীলমাছ, ডলফিন ও পাইলট তিমি শিকার করত। ধীরে ধীরে তারা কৃষি কাজের দিকে ঝুঁকতে থাকে।

 

আদি থেকেই নিউজিল্যান্ড দ্বীপটি অরণ্যময়। মাউরিরা বন কেটে পরিষ্কার করে চাষযোগ্য জমি তৈরি করত। বাগান তৈরিতে এরা অদ্ভুত সব কৌশল অবলম্বন করত। হর্টিকালচার বা উদ্যানবিদ্যার উন্নয়নে এদের অবদান অসামান্য।

 

কালক্রমে মাউরিদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিজস্ব সম্পদের ওপর অধিকার আরোপে বাঁধে যুদ্ধ। ধীরে ধীরে তারা যুদ্ধবাজ জাতি হিসেবে গড়ে ওঠে।

 

মাওরি জাতির নিজস্ব এক ধরনের সংস্কৃতি রয়েছে, যা `মাওরি` নামে পরিচিত। এদের পোশাক অন্যান্যদের থেকে বেশ আলাদা। যেহেতু মাওরিরা পলিনেশিয়া থেকে এসেছে, তাই এদের সংস্কৃতিতে পলিনেশিয়ার প্রভাবই বেশি।  নিজস্ব এ সংস্কৃতি দিয়ে চেনা যায় তাদের।

 

টাট্টু বা ট্যাটু মাওরি সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুখভরা টাট্টুকে বলা হয় মোকো। মেয়েরা অবশ্য মোকো করতে পারে না। তবে তারা পুরুষের আনুমতি সাপেক্ষে নাক, থুঁতনি আর ঠোঁট ওপর অবধি আঁকতে পারে।

 

 

মাওরিদের নাচ খুবই আকর্ষণীয়। তাদের একটি বিখ্যাত নাচ হাকা বা যুদ্ধনৃত্য। আগে যুদ্ধের পূর্বে হাকা নাচ হতো। এখন নিউজিল্যান্ড রাগবি টিম খেলার আগে হাকা নাচে। গায়ে রঙ মেখে অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গি করে তারা এ নাচ প্রদর্শন করে।

 

মাওরিদের নিজস্ব ভাষার নাম ‘রে তে রেও’ যা একটি পলিনেশিয়ান ভাষা। তবে এই ভাষার চর্চা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ মাওরিই এখন ইংরেজি ভাষায় কথা বলে।

 

মাওরিদের ধর্ম মূলত পলিনেশীয় ধর্মের অনুরূপ। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস সমুদ্রকে ঘিরে। তবে ইউরোপীয়রা আসার পর তাদের উপর খ্রিষ্ট ধর্মের প্রভাব পড়তে শুরু করে। ১৭ শতকের প্রথম ভাগে ইউরোপীয়রা নিউজিল্যান্ডে আসা শুরু করে।

 

নিউজিল্যান্ড ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হলে মাওরিদের সঙ্গে ব্রিটিশদের রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়। ১৮৪০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হবসন ও মাউরি নেতাদের মধ্যে এক চুক্তির মাধ্যমে এই সংঘাত শান্তিপূর্ণভাবে বন্ধ হয়। ইতিহাসে এটাই ওটেংগি চুক্তি নামে খ্যাত।

 

 

১৮৬০ সালে বাসস্থান এবং চাষাবাদের জমির বণ্টন নিয়ে মাওরিরা আবার ব্রিটিশদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। মাওরিদের ওপর অতিরিক্ত টোল আরোপ করা হয়। ফলে মাওরিরা রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে পড়ে। ১৮৪০ থেকে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মাওরিরা ব্রিটিশ সমাজে মিশে যেতে থাকে। ব্রিটিশদের বদৌলতে মাওরি জনগোষ্ঠী প্রথম আধুনিকতার ছোঁয়া পায়। এদের জীবনধারা এবং সংস্কৃতিতে ইউরোপীয় প্রভাব বাড়তে থাকে।

 

২০১৩ সালের বিশ্ব জনসংখ্যা রিপোর্ট অনুযায়ী, নিউজিল্যান্ডে মাওরি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। সে অনুযায়ী মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি, যা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। নিউজিল্যান্ডের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে মাওরিদের জীবনমান অনেক নিম্নমানে। এরা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া। এর প্রভাবে মাওরিদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতার আধিক্য দেখা যায়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুলাই ২০১৬/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়