ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুক্তিসংগ্রামের গল্প : ঈমাম সাহেব

হুমায়ূন শফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৫, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিসংগ্রামের গল্প : ঈমাম সাহেব

|| হুমায়ূন শফিক ||

 

সাত-আটজন যুবকের হাত পিছনে নিয়ে শক্ত দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেধে উপুর করে শুইয়ে রাখা হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে তাদের বলি দেওয়া হবে। হয় তাদের কপালে গুলি করা হবে, নয়তো মাথা থেকে ধর আলাদা করা হবে। এটা নির্ভর করছে ক্যাপ্টেনের ওপর। তিনি যা বলবেন তার ওপরই নির্ভর করছে ছেলেদের কীভাবে মারা হবে।

 

শুকুর আলী শাদা পাঞ্জাবি পরে, সুগন্ধী মেখে বাড়ি থেকে বের হল। তার মুখে শাদা দাড়ি। মসজিদের সামনে পৌঁছে ঈমামকে ডাক দিল। ভিতর থেকে তজবিহ পড়তে পড়তে ঈমাম সাহেব এসে তাকে সালাম দিল।

—চলেন, ঈমাম সাহেব ক্যাম্পে যাই।

—কোন ক্যাম্পের কথা কন?

—সেনাবাহিনীর।

ঈমাম সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। তার মুখে বারবার পানি এসে ভরে যাচ্ছে সে গিলে সারতে পারছে না। কয়েকবার থুথু করে ফেলে দিল। তবু থামছে না। শুকুর আলী হল এই গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী লোক। তার কথার অগ্রাহ্য করা মানে চাকরি থেকে চ্যুত হওয়া। সে কোনোভাবে পাক-বাহিনীর ক্যাম্পে যেতে রাজি না। কিন্তু কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না।

—সাহেব, আমার তো হামিদ মিয়ার বাড়ি মিলাদ আছে। কেমনে যাই? জানে মিথ্যা বলে লাভ হবে না।

—দূর মিয়া মিলাদ পরে পড়বা, এখন চল।

সে শুকুর আলীর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। তার মুখের ভিতর এখন পানি। সে গেলার চেষ্টা করছে। কোনো কিছু খাওয়ার ফলে এমন হতে পারে। দুপুরে ফালু মুন্সির বাড়ি কৈ মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছে, অতি সু-স্বাদু সেই রান্না। একেকটা মাছ খেতে অমৃত’র মত লাগছিল। সে দুটি খেয়েছে। নিজের বাড়ি হলে আরো দু-একটি বেশি খেত। মুখে পানির আসার কারণটা আসলে বলা মুশকিল। এত সুস্বাদু খাবার খাওয়ার পর যদি কোন অসুখ-বিসুখ হয় তাহলে মানুষ খাবে কি?

 

ঈমাম সাহেব দেখল, সাত-আট জন যুবককে উপুর করে শুইয়ে রাখা হয়েছে, তাদের হাত বাধা। উদাম গা। কয়েকজন প্যান্ট পরে আছে, কয়েকজন লুঙ্গি। তারা বেঁচে আছে না মরে গ্যাছে বলা মুশকিল, কারণ কেউ নড়ছে না। মরার মত পরে আছে।

—ক্যাপ্টেন কাহা? শুকুর আলী জিজ্ঞেস করে এক সৈনিককে।

সৈনিকটি একটু-আধটু বাংলা জানে, তার ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, মজা লুটছে।

—কাহা?

—তাবু মে।

—বহুত আচ্ছা। বহুত আচ্ছা। হামারা এ্যাক দোস্ত আয়া হ্যায়।

সৈনিকটি ঈমাম সাহেবকে সালাম দেয়। সে উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ক্যাছে হু বাচ্চো?

—বহুত আচ্ছা। আরো কয়েকজনকে দেখা যায় আশে-পাশে ঘুরঘুর করছে। এ সময় ক্যাপ্টেন তাবু থেকে বের হয়। উড়া-মুড়ি দেয়। হেঁটে হেঁটে তাদের দিকে আসতে থাকে। পিছনে দেখা যায় সৈন্যরা একটি নারীকে টেনে-হেচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার শরীরের উপরিভাগ অনাবৃত। সবাই সেই দিকে লোভাতুর দৃষ্টি তাকিয়ে আছে। ঈমাম সাহেব দৃশ্যটি একবার দেখে চোখ নামিয়ে নিল। শুকুর আলী এক দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে আছে।

—কিয়া বাত, শুক্কুর সাব?

—হামারা এ্যাক দোস্ত আয়া, সাব।

—সালাম, ঈমাম সাব।

বাংলা শুনে ঈমাম একটু অবাক হলেও সামলে নিয়ে বলল, জ্বি ভাল। আপনি বাঙালি?

—জ্বি না। এইদেশে ছিলাম বহুত দিন, তাই বাংলাটা আসে।

তা বেশ। কাজকর্ম কেমন চলতেছে?

—আপনারা সাহায্য না করলে কি ভাল চলবে? সবাই শুনে শুধু মোক্তিতে যোগ দিচ্ছে। বহুত আচ্ছা, বহুত আচ্ছা। শালাদের ধরেছি, ঐ যে দেখেন।

 

সবাই যুবকদের দিকে তাকায়। এখনও তাদের শরীরে কোন গতি দেখা যায় না।

শুকুর আলী জিজ্ঞেস করে, সবকে সব কি মৃত?

—না, শালারা ভান ধরে আছে। শুয়ারকা বাচ্চা সব, হিন্দু। মুসলমান এক বা দুইজন আছে।

—গুলি করেন না কেন? শুকুর আলী দাঁত বের করে হাসে।

—আরেকটু বেলা কমুক, সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব আসলে শালাগো গলা কাটব। স্বাধীন হইতে চায়, স্বাধীনতা।

শেষের কথাগুলো ইমাম সাহেবের খুব দুঃখ হল। সে বলে উঠল, সাব, সবাইকে না মারলে হয় না। আপনি তো একটু আগে একটা খারাপ কাজ করলেন। আল্লাহ মহান তিনি সবই দেখছেন।

—কন কি মিয়া? সাবরে এই কথা বলার সাহস হয় কেমনে?

—উনি ঠিকই বলেছেন, শুক্কুর আলী সাব।

আমরা মুসলমান মুসলমান ভাই। আবার হিন্দুরা আমাদের প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে হাদিসে আছে, যে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে ও আখেরাতে বিশ্বাস করে সে যেন স্বীয় প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। (দ্র. সহীহ বুখারী হা.৬০১৮)

—ঈমাম সাব বহুত জ্ঞানী নিকলা। উসকো সাত এক…..

—না সাব। উনি ভাল লোক। পাকিস্তান চান। শুকুর আলী বলে।  

হু…তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বলেই সে এক সৈন্যকে ডাক দেয়। সৈন্যকে বলে সেই মেয়েটিকে তাদের সামনে হাজির করতে। সৈন্যটি দৌড়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরই মেয়েটিকে নিয়ে হাজির হয় সে। মেয়েটির অবস্থা আগের মতই।

ক্যাপ্টেন বলে, ঈমাম সাব আপনি মেয়েটির দিকে তাকান। ঈমাম সাব মুখ ফিরিয়ে নেয়। এক সৈন্যকে হুকুম দেওয়া হয়, ঈমাম সাহেবের মুখ মেয়েটির দিকে ধরে রাখতে। সে শক্ত করে ধরে। কিন্তু ঈমাম চোখ বন্ধ করে ফেলে। শুকুর আলী দৃশ্যটা খুব মজা করেই দেখছে।

 

 

ক্যাপ্টেনের নির্দেশে মেয়েটিকে ঈমামের মুখোমুখি নিয়ে যাওয়া হয়। মেয়েটি অঝোরে কাঁদছে। ঈমামের চোখ খোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সৈন্যরা। অন্যরা হাসছে। যেন সার্কাস পার্টি চলছে।

—পাকিস্তান চান?

—এতদিন চাইতাম, এখন না। ঈমাম খুব রাগীস্বরে বলে।

ক্যাপ্টেন ঈমামের চোখের পাতা সুঁই-সুতা দিয়ে সেলাই করে দিতে বলে। যাতে সে চোখ বন্ধ করতে না পারে। অন্যরা তাই করে। সে চিৎকার করতে থাকে। তার চিৎকারে কড়ই গাছের মগডালে বসা পাখিরা উড়ে যায়। আশেপাশের যুবকদের শরীরে গতি ফিরে আসে। তারা উঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তার চোখের পাতা সেলাই শেষ হলে মেয়েটিকে নিয়ে সৈন্যরা খেলা শুরু করে। সেই দৃশ্যগুলো ঈমাম দেখতে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে ঝরঝর করে।

 

মেয়েটিকে আবার তাবুতে বেঁধে রাখা হয়। সবাই আবার তাবুর বাইরে আসে। ঈমামের অবস্থা দেখে দাঁত বের করে হাসে শুকুর আলী। মেয়েটি যে তাঁবুর ভিতরে সেখানে শুকুর আলী প্রবেশ করে। তাকে দেখে অন্য সৈন্য তাঁবু থেকে বের হয়ে আসে।

 

ঈমামকে ক্যাপ্টেন বলে, দারুণ তৃপ্তি পেলেন?

পলকহীন চোখে তাকিয়ে সে বলে, আল্লাহর গজব আপনাদের উপর পড়ব। খুব শীঘ্রই।

সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন তাকে ঠাস করে থাপ্পর মারে। তার পাঞ্জাবি খোলার নির্দেশ দেয়। তার উদাম শরীরে লাঠি দিয়ে ৫০ বার বাড়ি দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পরক্ষণেই মতামত পরিবর্তন করে। তার শরীর ছুরি দিয়ে কুঁচি কুঁচি করে কাটার হুকুম দেয়।

 

একজন সৈন্য একটি ছুরি নিয়ে আসে। তাকেই কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়। সে উৎসাহের সাথে কাজে লেগে পড়ে। ঈমাম সাহেবের স্তনের দুই বোটা কেটে ফেলে। ঈমাম সাহেব জানে চিৎকার করেও লাভ নেই, তার মরণ সন্নিকটে। সে জোরে জোরে জয় বাংলা, জয় বাংলা বলতে থাকে। যুবকরা তার গলার সাথে সুর মেলায়। সেই সময় তার কান দুটি কেটে ফেলা হয়। তার পেটের এক অংশ কাটা হলে সে নিজে দেখতে পায় পেটের নাড়িভূড়ি। তার ঠোঁট দুই ভাগ করে ফেলা হয়। সে তবু জয় বাংলা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। কিছুক্ষণ পর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

 

ঈমাম সাহেব স্বপ্নে দেখেন, একটি পতাকা উড়ছে। লাল-সবুজ রঙের। মাঝখানে লাল, চারদিকে সবুজ। অসাধারণ এক পতাকা। কে যেন বারবার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। ঈমাম সাহেব তার শরীরের রক্ত দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলছে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৬/হুমায়ূন/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়