ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মোগল আমলের স্মারক সুখাইড় জমিদারবাড়ি

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৯, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মোগল আমলের স্মারক সুখাইড় জমিদারবাড়ি

সুখাইড় জামদারবাড়ির একটি ধসে পড়া ভবনের সামনের অংশ (ছবি : হিমাদ্রি শেখর ভদ্র)

৩০০ বছরেরও বেশি পুরোনো মোগল আমলের স্মারক এই সুখাইড় জমিদারবাড়ি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, পাহাড়ি বৌলাই নদী, বিশাল বিশাল হাওর, পাখি, জঙ্গল সবদিক বিবেচনায় সুনামগঞ্জের সুখাইড় জমিদারবাড়ি ভাটি বাংলার রাজমহল হিসেবে খ্যাত।

 

জমিদারদের প্রথম পুরুষ বিশ্বনাথ চৌধুরীর আমলে ২৫ একর জায়গা জুড়ে স্থাপনা শুরু হয়। মোগল শাসনামলে মহামানিক্য দত্ত রায় হুগলি থেকে আসাম যাওয়ার পথে ভাটির প্রকৃতি-রূপ-ঐশ্বর্য্যে বিমোহিত হয়ে সুখাইড় অঞ্চলের জায়গির ক্রয় করেন।

 

এক সময়ের দুর্দান্ত প্রতাপশালী সুখাইড় জমিদারদের বাড়িতে এখন গাছপালার আধিপত্য (ছবি : হিমাদ্রি শেখর ভদ্র)

 

ইতিহাসে কথিত, জমিদার আমলে সুনামগঞ্জ যে ৩২টি পরগনায় বিভক্ত ছিল- এর মধ্যে সুখাইড় জমিদারবাড়ি একটি। বাকি প্রায় সবগুলো ধ্বংস হয়ে গেলেও সুখাইড় জমিদার বাড়ি এখনো ঐশ্বর্যময় দিনগুলোর সাক্ষী বহন করছে। ব্রিটিশ আমলে প্রতাপ রায় চৌধুরী, সুবংশ রায় চৌধুরী, গোপী রায় চৌধুরী ও সদারয় চৌধুরী জমিদারির বন্দোবস্ত লাভ করেন। সে সময় লর্ড কর্ন ওয়ালিশ তা বন্দোবস্ত করে দেন। সে আমলে নান্দনিক ভবন নির্মাণে ও নিসর্গ প্রকৃতির ব্যাপ্ততায় তা ভাটি রাজ্যের রাজমহল বলে আখ্যা পায়।

 

জমিদারি প্রথা
জমিদারদের আয়ের উৎস ছিল বলতে প্রজার ওপর ধার্যকৃত খাজনা আদায় ও হাওরের মৎস্য খামার এবং বন জঙ্গল। ১২০০ বঙ্গাব্দে এসে প্রজাদের ওপর শুরু হয় অত্যাচার, নিপীড়ন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। সুন্দরী মেয়ে, ঘরের বধূ এদের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়লে রেহাই পেতো না কেউ। ধীরে ধীরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। আর আজো সেসব কাহিনী অত্যাচার-নির্যাতন-প্রভাবের গল্প গ্রামাঞ্চলে কল্পকাহিনীর মতো ছড়িয়ে আছে। জমিদারি প্রথার শেষ দিকে নানকার বিদ্রোহের পটভূমি তারই অংশ।

 

জমিদারবাড়ির বর্তমান অবস্থা
অযত্ন, অবেহেলা ও সরকারের উদাসীনতায় প্রত্নত্ত্বের সম্ভাবনাময় স্থান এবং মোগল আমলের এ নিদর্শনটি হারিয়ে যেতে বসেছে। জলসাঘর, বৈঠকখানা, বাংলা, বিশ্রামাগার, দুর্গামন্দির ইতিমধ্যে ধসে গেছে। এককালে যে জমিদার বাড়িকে আবর্তিত করে পরিচালিত হতো প্রজা ব্যবস্থা, তার চার ভাগের মধ্যে এখনো বড়ো বাড়ি, মধ্যম বাড়ি ও ছোট বাড়ি টিকে আছে। জমিদারি পতনের পর বাড়িগুলোর অনেক বদ্ধ ঘর ও সিন্দুক রয়েছে, যা আজো খোলা যায়নি।

 

জমিদারবাড়ির একটি ধসে পড়া ভবনের ভেতরের অংশ (ছবি : হিমাদ্রি শেখর ভদ্র)

 

বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলে এখনো গা ছমছম করে। অন্ধকারে ডুবে থাকে এককালের রঙিন আলো ও শোভাদানকারী কক্ষসমূহ। বর্তমান বংশধররা জানান, প্রাচীন আমলের মাটির নিচে যে ঘরগুলো ব্যবহার হতো, এখনো সেসব কেউ খুলতে সাহস পান না। তেমনি অযত্নে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাড়ির দেয়ালের নান্দনিক কারুকার্যসমূহ। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও সরকার উদ্যোগ পেলে নতুন কিছু আবিষ্কারেরও সম্ভাবনা রয়েছে।

 

বংশধরদের বর্তমান অবস্থা
প্রজাদের ওপর জমিদারদের স্বর্ণময় সময়ে যে অত্যাচার, নিপীড়ন এবং নির্মমতার ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এখন যেন তারই ফল ভোগ করে চলেছেন জমিদারদের বর্তমান বংশধরেরা। জমিদারবাড়ির জৌলুসহীন রূপের মতোই তাদেরও জীবনযাপন আভরণহীন। বড় বাড়িতে বাস করছেন মলয় চৌধুরী, মধ্যম বাড়িতে শিপু চৌধুরী ও ছোট বাড়িতে বিমল চৌধুরী।

 

বর্তমান জমিদার বংশধরদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ ৮৫ বছর বয়সী বিমল চৌধুরী ওরফে ছানা বাবু ক্ষোভের সঙ্গে জানান, বাড়ির জায়গাটুকু ছাড়া বদলি কোনো কিছু না দিয়ে সরকার সব নিয়ে গেছে। আমরা এখন নিঃস্ব।

 

জমিদারবাড়ির পরিত্যাক্ত দরবার গৃহের শ্যাওলা ধরা দেওয়াল (ছবি : হিমাদ্রি শেখর ভদ্র)

 

তিনি তাদের পূর্ব পুরুষদের কির্তীময় একটি ঘটনার কথা বলেন, সে সময় জমিদারি পরিদর্শন করতে এসেছিলেন ইংরেজ প্রশাসক মি. বেলেন্টিয়ার। তিনি বেরিয়েছিলেন অদূরবর্তী টাঙ্গুয়ার হাওরে শিকার করতে। তখনকার সময়ে শিকারের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল প্রথম সাহেবরা গুলি চালাবেন, এরপর জমিদার গুলি করবেন। শিকারের সময় হঠাৎ বেলেন্টিয়ার সাহবের হাতিকে তিনটি বাঘ আক্রমণ করে। মুহূর্তের আকস্মিকতায় সাহেব জ্ঞান হারান। সে অবস্থায় সুখাইড়ের জমিদার মথুর চৌধুরী সাহেবের অপেক্ষায় না থেকে তিনটি বাঘকেই গুলি করে হত্যা করেন। পরে সাহেবের জ্ঞান ফিরলে তিনি জমিদারকে নিজের রাইফেলটি উপহার দিয়ে দেন।

 

আসতে হলে
সুনামগঞ্জ থেকে লঞ্চ বা ট্রলার যোগে ৫/৬ ঘণ্টার পথ সুখাইড়। ট্রলারে না গিয়ে লঞ্চে গেলে ভালো লাগবে। সুনামগঞ্জ থেকে লঞ্চ ছাড়ে রাত সাড়ে ১১টায়। যথাসম্ভব সুনামগঞ্জ শহরে বিকেলের মধ্যে পৌঁছলে ছিমছাম শহরটি ঘুরে দেখারও সুযোগ পাবেন। রাতের সুরমা নদীর অনিন্দ দৃশ্য যে কোনো সৌন্দর্য প্রেমি মানুষকে ঘুমোতে দেবে না। আবার চাইলে লঞ্চে ঘুমিয়ে অথবা ভিসিডিতে সিনেমা দেখে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারেন।

 

সুখাইড় জমিদারবাড়ির প্রাসাদ ভবনের সামনের একটি অংশ (ছবি : হিমাদ্রি শেখর ভদ্র)

 

এখানকার গ্রামের মানুষ খুবই সহজ সরল। ইচ্ছে করলে দিনে ঘুরেফিরে রাতটা বাজার বা গ্রামের যে কারো বাড়িতে থেকে যেতে পারেন। কিংবা নিকটবর্তী উপজেলা ধর্মপাশা বা মধ্যনগরের উদ্দেশ্যে দুপুরে ট্রলার ছেড়ে যায়। তাতে উঠে যেতে পারেন। ধর্মপাশা বা মধ্যনগর থেকে সুনামগঞ্জ হয়ে ফিরতে না চাইলে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ হয়ে যে কোনো দিকে যেতে পারবেন। ভাটির জনপদ বলে হোটেলের ভাড়া ও খাওয়া খরচ একেবারেই কম। আপনার গায়েই বাধবে না।

 

 

 

রাইজিংবিডি/সুনামগঞ্জ/২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/হিমাদ্রি শেখর ভদ্র/সনি

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়