ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ম্যাগনা কার্টার দেশে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৩, ১৭ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ম্যাগনা কার্টার দেশে

টাওয়ার ব্রিজ

ফেরদৌস জামান  :  ব্যবসা, শিক্ষা, ভ্রমণ অথবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক না কেন, লন্ডন যাওয়া মানে ব্যস্ততার ফাঁকে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত কিছু জায়গা দর্শন করা। লন্ডন যাওয়া বিদেশিরা যে কয়টি জায়গার দর্শন নেওয়া থেকে নিজেকে একেবারেই বঞ্চিত করতে চায় না, তার মধ্যে অন্যতম টাওয়ার ব্রিজ।

 

সুতরাং, নিজের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটতে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর প্রায় সব নগরীতেই রয়েছে চোখ জুড়ানো নিদর্শন। লন্ডন টাওয়ার ব্রিজ তেমনই একটি।

 

পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহর গ্রেট ব্রিটেনের অন্য যে কোনো শহর অপেক্ষা পাঁচ থেকে সাতগুণ বড়। একই সঙ্গে ইউরোপের সর্ববৃহৎ সমুদ্র বন্দর তো বটেই, বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমুদ্র বন্দরগুলোর একটি। এ ছাড়াও লন্ডন হল কমনওয়েলথ দেশগুলোর প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র।

 

এখানে রয়েছে ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক মূলকেন্দ্র ও সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে একে প্রযুক্তি ও ক্যাথেড্রাল নগরীও বলা হয়ে থাকে। শহরটিতে রয়েছে ইংল্যান্ড রাজের ঐতিহ্যবাহী রাজপ্রাসাদ। অধিকন্তু শহরটিকে ঘিরে রেখেছে কেন্সিংটন, চেলসিয়া, ব্ল-মসাবেরি, মেফেয়ার প্রভৃতি।

 

টাওয়ার ব্রিজ

 

কয়েকদিনের মধ্যেই নিজেকে লন্ডন শহরে বেশ খানিকটা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আশপাশের পথঘাট, বাজার, পার্ক চেনা থেকে শুরু করে বাস, ট্রেনে চলাচল ইত্যাতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। এবার দর্শনীয় স্থান দেখার পালা।

 

রায়হান ভাই থাকেন সাউথ লন্ডনে। একদিন দুজনে বেরিয়ে পড়ি টাওয়ার ব্রিজ দেখার উদ্দেশ্যে। পাতাল রেলে গিয়ে অবতরণ করতে হল টাওয়ার হিল রেল স্টেশনে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে অল্পকিছু দূরেই টাওয়ার অব লন্ডন। তার পাশদিয়ে কিছুদূর এগোলেই কাঙ্খিত টাওয়ার ব্রিজ। অনেকেই টাওয়ার ব্রিজকে লন্ডন ব্রিজ বলে ভুল করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে টাওয়ার অব লন্ডনের নিকটে অবস্থিত হওয়ার কারণে এর নাম টাওয়ার ব্রিজ।

 

অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকে টেমস নদীর উভয়তীরের সংযোগ সাধনের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সেতু নির্মিত হয়েছিল। যার মধ্যে লন্ডন ব্রিজ ছিল প্রধান। ১৭৫০ সালে নির্মিত ব্রিজটি পর্যাপ্ত পরিমাণ যানবাহন চলাচলের জন্য যথেষ্ট ছিল না।

 

পাতাল রেল স্টেশন

 

জানা যায়, এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অসংখ্য জাহাজের ভিড় লেগে যেত। পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিও ঘটনা ছিল প্রতিদিনের  ঘটনা। যাকে বলে একেবারে গিজগিজে পরিস্থিতি। এমনও জনশ্রুতি রয়েছে যে, পাশাপাশি নোঙর করা জাহাজগুলোর পাটাতনের ওপর দিয়ে নাকি কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যেত। প্রায় সোয়াশ বছর পুরনো এই ব্রিজের ইতিহাস বলে, লন্ডন শহরটি জনবহুল হয়ে ওঠার কারণে নদীর অপরপারে বর্ধিত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। সে লক্ষ্যে ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে টাওয়ার অব লন্ডনের গভর্নরের আপত্তি সত্বেও ইংল্যান্ড আইনসভা নদীর ওপর একটি আধুনিক সেতু নির্মাণের বিল পাস  করে। তবে এই শর্তে য়ে, ব্রিজের নকশা হবে লন্ডন টাওয়ারের আদলে।

 

তৎকালীন প্রখ্যাত পঞ্চাশ জন প্রকৌশলীর জমা দেওয়া নকশার মধ্যে নির্বাচিত হয় স্যার হর্স জনের নকশাটি। তারপর ১৮৮৬ সালে শুরু করে আট বছর অর্থাৎ ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত চলে এই ব্রিজের কাজ। ব্রিজের দৈর্ঘ্য ২৪৪ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ মিটার। নির্মাণে ব্যায় হয় ১১,৮৪,০০০ পাউন্ড স্টার্লিং। উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাজা এডওয়ার্ড-৪ ও রাণী আলেকজান্ডারা। ব্রিজ নির্মাণে প্রয়োজন হয় প্রায় এগার হাজার টন স্টিল। শোনা যায়, ভিক্টোরিয়ান গথিক নকশার এই ব্রিজটি নাকি সে সময় তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি।

 

কিন্তু কালক্রমে দেখা গেল, তা লন্ডনের এক প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। পৃথিবীতে অনেক নান্দনিক ও ব্যতিক্রম ব্রিজ থাকলেও দর্শনার্থীদের নিকট টাওয়ার ব্রিজের মত গুরুত্ব অন্য কোনটির নেই বলা যায়। যা যুগ যুগ ধরে এক বিশেষ আবেদন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 

প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী  ব্রিজটিকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় জমায়। সেতুর পাটাতন দুইটি বিশাল আকারের পাত দ্বারা সংযুক্ত। একেকটির ওজন এক হাজার ২০০ টন। নিচ দিয়ে বড় বড় জাহাজ পারাপারের পাত দুটি ৮৬ ডিগ্রি কোণে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, যাতে করে জাহাজগুলো অনায়াসে তার নিচ দিয়ে পারাপার করতে পারে। জাহাজ পেরিয়ে গেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে সিগনাল পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং পাতগুলো নেমে সাবেক অবস্থায় ফিরে আসে। বর্তমানে অবশ্য বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আগের দিনে নাকি পাত দুটি দিনে অন্তত ৫০ বার ওঠানামা করত। বর্তমানে তা দিনে মাত্র ৬-৭ বার ওঠানামা করে। এই ব্রিজটি টেমস নদীর উত্তর পাশের আয়রন গেট ও দক্ষিণ পাশের হর্সলি ডাউন লেনকে সংযুক্ত করেছে।

 

হেঁটে হেঁটে আমরা উপরে পৌঁছে যাই। এখান থেকে উপভোগ করা যায় শহরের অসাধারণ সব দৃশ্য। ব্রিজের দুইপাশে রয়েছে ৬৫ মিটার উচ্চতার বিশাল দুইটি টাওয়ার। দুই টাওয়ারের উপরের দিকে সংযোগকারী পায়ে হাঁটা পথ আছে। যেখান থেকে শহরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। বর্তমানে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ এখান থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা নাকি দিনকে দিন বেড়েই চলছিল। আগ্রহী পর্যটকদের জন্য ব্রিজের ইতিহাস জানার জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। তার জন্য প্রবেশ করতে হয় উত্তর টাওয়ারে। সেখানে সয়ংক্রিয়ভাবে সম্পূর্ণ কিছু বর্ণনা করা হয়ে থাকে।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুন ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়