ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ম্যান্ডেলার ছেলেবেলার গল্প

কাজী আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৮ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ম্যান্ডেলার ছেলেবেলার গল্প

নেলসন ম্যান্ডেলার আজ জন্মদিন

কাজী আশরাফ : নেলসন ম্যান্ডেলার কথা মনে পড়ে? এই নাম তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বিশ্বের বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি। অথচ ভেবে দেখ, এমন এক লোকের কিনা জীবনের বিভিন্ন সময় মোট ২৭ বছর কেটেছে কারাগারে। তার অপরাধ? অপরাধ হলো, তিনি সাদা-কালো ভেদাভেদ দূর করতে চেয়েছেন। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। এর পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। আর মানুষের ভালোবাসা সে তো এখনও পাচ্ছেন। হ্যাঁ, মরে যাবার পরও তিনি আছেন মানুষের হৃদয়ে। এ জন্যই তো বললাম, এই নাম তো ভুলে যাবার কথা নয়! আচ্ছা, কেমন ছিল ম্যান্ডেলার ছেলেবেলা? তোমরা নিশ্চয়ই জানতে চাও সে কথা। দাঁড়াও বলছি। নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই। তিনি নিজেই তার জীবনের কথা লিখে গেছেন। বইটির নাম ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’। বইটি থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি।  

সবুজ এক উপত্যকায় কুনু গ্রামের (যে গ্রামে ম্যান্ডেলার জন্ম) অবস্থান। তার পাশ দিয়ে বহমান স্বচ্ছ জলের ধারা। কুনুর মাথার ওপর দিয়ে তাকালে নজরে পড়বে সবুজ পাহাড়। খুব বেশি হলে কয়েকশ মানুষের বসবাস ছিল কুনুতে। ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে বাস করত তারা। কুঁড়ে ঘরগুলো দূর থেকে দেখলে মৌচাকের মতো লাগতো। কাঁদা-মাটি দিয়ে তৈরি দেয়াল। মাঝখানে কাঠের লম্বা খুঁটি। তার ওপর খড়ের পাতলা চাল। নিচ থেকে মাটি উঠিয়ে নিজেদের কলোনিতে পিঁপড়ারা যে শক্ত ঢিবি বানিয়ে রাখতো, কুনু গাঁয়ের কুঁড়ে ঘরগুলোর মেঝে ছিল ওই উইঢিবি দিয়ে তৈরি। আর মেঝে ঝকঝকে রাখতে গোবর দিয়ে নিয়মিত লেপে নিতে হতো।


ঘরের ভেতর আখা জ্বলতো, খড়ের চালা দিয়ে দিব্যি বের হয়ে যেতো আখার ধোঁয়া। ঘরের দরজা ছিল খুবই ছোট। মাথা নুইয়ে বাইরে বেরুতে বা ভিতরে ঢুকতে হতো। কুঁড়ে ঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে থাকতো। গ্রামে কোনো রাস্তা ছিল না। তবে ঘাস মাড়িয়ে পায়ে হাঁটার সরু পথ ছিল। কুনু গাঁয়ের চারপাশে কিন্তু বড় কোনো গাছ ছিল না। তবে কুনুর মাথার ওপর দিয়ে তাকালে সরু লম্বা কিছু গাছ চোখে পড়ত পাহাড়ের গায়ে।

খাবারের তালিকায় ছিল মেইজ, পশ্চিমারা যাকে ভুট্টা বলে। খাদ্য তালিকায় আরও ছিল মটরশুঁটি আর কুমড়া। ঐতিহ্য বলে নয়, এসব আমরা খেতাম কারণ, এর চেয়ে বেশি কিছু তৈরি করার সামর্থ ছিল না। আমাদের গাঁয়ে সবচেয়ে বিত্তবান যারা ছিলেন তাদের খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় যোগ ছিল বড়জোর চা, কফি আর সুগার। তবে কুনুর বেশিরভাগ মানুষের জন্য সেসবই ছিল সাধ্যের বাইরে। রান্নাবান্না, ধোঁয়া-মোছা আর সেঁচের জন্য দরকারি পানির উৎস ছিল খালবিল-ডোবানালা। এসব কাজ করতেন নারীরা।  আসলে কুনু ছিল নারী ও শিশুদের গ্রাম। পুরুষেরা দূরে খনিতে কাজ করতেন। বছরে বড়জোর দুবার তারা গাঁয়ে আসতেন, তাও শুধু লাঙ্গল বাইতে। নিড়ানি, আগাছা পরিস্কার আর ফসল কাটার দায়িত্বটা চাপত নারীদের ঘাড়ে। পড়তে বা লিখতে জানতো এমন লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। অনেকের কাছে পড়াশোনা ছিল ভিনদেশি চাল। পাঠশালা বলতে দুটো প্রাইমারি স্কুল ছিল আমাদের গাঁয়ে।

আমার মা মোটে তিনটা কুঁড়ে ঘরের নেতৃত্ব দিতেন। পিচ্চি-পাচ্চা আর শিশুদের চিৎকার-চেঁচামেচি এখনও কানে বাজে। আফ্রিকার সংস্কৃতিতে চাচা-চাচির সন্তানেরা কাজিন নয়, নিজের ভাই-বোন বলে বিবেচিত। সম্পর্কের ব্যাপারে শ্বেতাঙ্গরা যে সংস্কৃতি লালন করে আমরা কিন্তু তেমন নই। সৎ ভাই বা সৎ বোন বলে কিছু ছিল না আমাদের সংস্কৃতিতে। আমার চাচার ছেলে ছিল আমারই ভাই, আমার ভাইয়ের সন্তান মানেই আমার ছেলে, আমার মেয়ে।
আমাদের তিনটা ঘরের মধ্যে একটা ছিল হেঁসেলঘর, একটা শোবার ঘর আর একটা গুদাম ঘর। শোবার ঘরে কোনো আসবাবপত্র ছিল না। আমরা মেঝের ওপর মাদুর পেতে ঘুমাতাম। বসতাম মেঝেতেই। এমনকি ঘুমানার জন্য বালিশও ছিল না। খোলা আগুনের ওপর ত্রিপদী একটা লোহার পাত্রে রান্না করতেন মা। আমরা যা খেতাম সবই ছিল নিজেদের চাষ করা। এর মধ্যে ভুট্টাই প্রধান। ভুট্টা থেকে মূলত রুটি বানানো হতো। এছাড়া গরু ছাগলের দুধ ছিল অঢেল।


মায়ের পিঠে ঝোলার ভেতর সেই আমি ছিলাম মানিক-রতন। ছোটবেলা থেকেই বেশিরভাগ সময় কাটাতাম খেলাধুলা করে, আমার মতো বালকদের সঙ্গে কুস্তি করে। রাতে ওদের সঙ্গেই খেতাম, একই কম্বলের নিচে ঘুমাতাম। পাঁচ বছরে হলাম পাল-বালক। পাল-বালক মানে ভেড়া আর বাছুরের পাল দেখাশোনা করা। শিখলাম গুলতি দিয়ে কি করে উড়ন্ত পাখি মারতে হয়। শিখলাম বন্য মধু আর ফল সংগ্রহ করা আর সরাসরি গরুর দুধ দুইয়ে গরম গরম পান করা। শিখলাম বিলে সাঁতার কাটা আর বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে। প্রেমে পড়লাম খোলা হাওয়া আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের। আবিষ্কার করলাম, জোঝা (যে অঞ্চলে ছিল কুনু গাঁ) আসলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ, সুখের স্বর্গ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুলাই ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়