ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

যাত্রাশিল্পের রুগ্‌ণ দশা (শেষ কিস্তি)

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ৩০ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যাত্রাশিল্পের রুগ্‌ণ দশা (শেষ কিস্তি)

রুহুল আমিন, লালপুর থেকে ফিরে : মায়া রানী, মুক্তি রানী ও ঝনু রানী।  এই তিন রানী আমাদের অঞ্চলে পালা করে মানুষের মন জয় করেছিলেন। এর মধ্যে মুক্তি রানীর বয়স ছিল তখন কম। নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। আর বাকি দুইজন পুরুষ ও নারী দুই চরিত্রেই অভিনয় করতেন। তবে মায়া রানী পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করে আপামর জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সবচেয়ে বেশি। আর নারী চরিত্রে ঝনু রানী ছিলেন অতুলনীয়। মুক্তি বিচ্ছেদ গান ধরলে দর্শকের অনেকে চোখের জল ফেলতেন।

 

এই তিনজনই এখন ‘নিখোঁজ’। পালাও আগের মত হয় না। তবুও আমার খুব জানাতে ইচ্ছে করলো তারা এখন কোথায় আছে। আমাদের এলাকার পালায় ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করত, কোথায় পালা হয় খবর রাখে, সর্বোপরি বলা যায় পালা পাগল কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। কেউ তাদের খোঁজ দিতে পারে না। মায়া ও মুক্তি প্রকৃত অর্থেই আমাদের এলাকার যাত্রাপালার মঞ্চ থেকে নিখোঁজ। আর ঝনু রানীর যে খোঁজ আছে তাতে আশার চেয়ে হতাশ হয়েছি বেশি। এককালের প্রতাপশালী, মঞ্চকাপানো সেই ঝনু এখন চা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। বন্ধু খোকা জানাল, ঝনুর অনেক ভক্ত অনুরাগী এখনো ঝনুর দেখা পেতে সেই চায়ের দোকানে ভিড় জমান। ‍ঝনুর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েই বিয়ে করেছিলেন নিলক্ষ্যার এক পালা পাগল ব্যক্তি। ঝনু এখন পুরোদস্তর সংসারী মানুষ। চা-পান বিক্রি করে সংসার চালান।

 

খোকা তার পালা দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলে, ‘আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। কাশেম মালার প্রেম মঞ্চস্থ হয়েছিল। মায়া রানী নায়কের ভূমিকায় ছিল, আর নায়িকার ভূমিকায় ছিল মুক্তি। আমার জীবনে যাত্রায় এত লোক আগে কখনো দেখিনি। আর মায়ার অভিনয় ছিল আমার দেখা সেরা অভিনয়। মায়া এমনিতে অনেক লম্বা ছিল। পুরুষের ভূমিকায় তাকে মানিয়েও ছিল বেশ। পালার এক পর্যায়ে নায়িকাকে (মুক্তি) সাপে দংশন করে। তখন নায়ক (মায়া) একটি গান ধরেন। এখনো আমার চোখে সেই স্মৃতি জ্বলজ্বল করে।’

 

খোকা সাধক দূরবীন শাহ্‌’র বিখ্যাত সেই গানের কয়েক লাইন আমাকে শুনাল ও, 

“আমার অন্তরায় আমার কলিজায়,

প্রেমশেল বিন্ধিলো বুকে, মরি হায় হায়।

মারিয়া ভুজঙ্গ তীর

কলিজা করিলো চৌচির

কেমন শিকারী তীর মারিলো গো

বিষ মাখিয়া তীরের মুখে

মারিলো তীর আমার বুকে

দেহ থুয়া প্রাণটা লয়া যায়।”

 

খোকা জানাল সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান লোকনাট্যে দানবের একটি চরিত্র আছে। দর্শকরা এই দৃশ্য দেখতে ভিড় করত। যেখানে একটি জলজ্যান্ত মোরগ মঞ্চে ছেড়ে দেওয়া হয়। দানব মোরগটি ধরে টেনে ছিঁড়ে কাঁচা খেয়ে ফেলে। এই চরিত্রে অভিনয় করে আমাদের পাশ্ববর্তী ইউনিয়ন নিলক্ষ্যার সিরাজ নামের এক ব্যক্তি বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। সিরাজের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে একটি যাত্রাদল তাকে দলের সঙ্গে নিয়ে নেয়। ভাল অভিনয় করে দর্শকদের মন কেড়েছেন মনিপুরার মোর্শেদ নামের আরেক ব্যক্তিও। আমার খুব ইচ্ছা হলো ঝনু, মোর্শেদ ও সিরাজের সঙ্গে কথা বলার।কিন্তু ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ায় সেই সুযোগ হয়নি। আশা রাখি আবার বাড়ি গেলে সময় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলে আসব। খোকাকে এ কথা বলেও রাখলাম।

 

প্রসঙ্গক্রমে খোকা জানাল, কাশেম মালার প্রেম মঞ্চস্থ হওয়ার পরের দিন সকালে বেশ কয়েকজন দর্শক পালা আয়োজকদের কাছে যান। তারা নায়ক (মায়া) অভিনয় করতে গিয়ে মঞ্চের যে বাঁশে একটু আধটু ধরেছিলেন সে বাঁশটি কিনতে চান। অনুভব করতে চেষ্টা করলাম মায়া কেমন অভিনয় করেছিল। এই রকম শত শত গল্প চালু আছে আমাদের এলাকায়।

 

গুনাইবিবি, রূপবান, মহুয়া, কাশেম-মালার প্রেম, আলোমতি-প্রেমকুমার, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, পাতালপুরির রাজকন্যা, কাজলরেখা, সাত ভাই চম্পা ও সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামান নিয়মিত মঞ্চস্থ হত আমাদের এলাকায়। এসব লোকনাট্য ও পালাগানের বিয়োগান্তক দৃশ্য দেখে বহু দর্শক চোখের পানিতে ভাসত। আর হাস্যরস ভরা পালা দেখে দর্শকরা মাটিতে গড়াগড়ি খেত। খোকা জানাল।

 

নিয়মিত যাত্রা হলেও সবাই তা দেখতে যেতে পারত না। এই কথা প্রথম কিস্তিতেই বলেছিলাম। খোকাকেও পড়তে হয়েছে বিভিন্ন বাধায়। কিন্তু তার যাত্রা দেখার নেশা ছিল তখন তুঙ্গে। তারপরও কখনো কখনো পড়তে হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। তখন খোকার বড় ভাই ছিলেন তার অভিভাবক। তো খোকার যে যাত্রা দেখার নেশা আছে তা তিনি জানেন। মজার ব্যাপার হলো খোকার বড় ভাইও যাত্রায় যেতেন। তো খোকাকে সব সময় বলতেন, যাত্রায় যাবি না, পড়াশোনা কর। খোকা জানায়, টানা মাসব্যাপী যাত্রা হয়েছিল একবার। আর বড় ভাই প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওই একই কথা বলতেন। যাত্রায় গেলে প্রায় অর্ধেক সময় কাটত তার ভাই তাকে দেখছে কিনা তা দেখে দেখে। এমনও হয়েছে পালায় বুঁদ হয়ে ভুলে গেছেন তার ভাইও পালা দেখতে এসেছেন। এক সময় দেখা গেছে দুই ভাই মুখোমুখি হয়ে গেছেন। কী আর করবে বড় ভাই। কয়েকটি টাকা হাতে দিয়ে বলতেন, যা বাড়ি চলে যা। এই রকম অনেক মজার ঘটনা শুনলাম তার মুখ থেকে। তাই তো বলি যাত্রা দেখতে যাবে কি না বলতেই কেন খোকা মুহূর্তেই রাজি হয়ে গেল। এই তাহলে কাহিনী।

 

যাত্রাশিল্প কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না তা বহমান কালই ভাল জানে। সময়ের স্রোতে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসে। জীবন ধারা পাল্টে যায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে মানুষও মার্চ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরও কখনো কখনো সময় আসে শেকড়ে টান পড়ে। ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে। এই টান আদিমকালেও ছিল। মধ্য যুগেও ছিল। এখনো আছে। মানবজাতির ইতিহাসে বিরল কিছু না এই টান। সভ্যতা এক পা এগিয়ে গেলে পিছিয়েছে দুই পা। আধুনিক চকচকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভিড়ে যাত্রার মতো সেকেলে সংস্কৃতির জন্য সময় ব্যয় করা সত্যিই অপচয়। তারপর শেকড়সম্পর্ক বলে কথা। লোকজ সংস্কৃতির অংশ যাত্রার বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। যাত্রাশিল্পীরা জীবনের তাগিদে পেশা পরিবর্তন করছেন। যাত্রাশিল্পের   এই করুণ দশা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে এর সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে দেশের সংস্কৃতিমনা সকলকে। হয়তো তাদের পৃষ্টপোষকতায় বেঁচে যাবে আমাদের লোক সংস্কৃতির বড় অংশ যাত্রা পালা। বেঁচে যাবে এর সংশ্লিষ্টরা, বেঁচে যাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উত্তরপুরুষরা। আকাশ সংস্কৃতি পুরোপুরো গ্রাস করার আগে এখনই সময় যাত্রাশিল্পকে রক্ষা করার। যাত্রা শিল্পের ডুবি ডুবি তরীকে রক্ষা করা সবার দায়িত্ব।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ আগস্ট ২০১৫/ইভা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়