ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যে কমরেডে আশ্চর্য হতেন ড. দেবপ্রিয়

টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫৯, ৮ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যে কমরেডে আশ্চর্য হতেন ড. দেবপ্রিয়

কমরেড ফরহাদ

শাহ মতিন টিপু : তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির আন্দোলনের অগ্রপথিক। মেহনতি মানুষের নেতা। শোষণহীন একটি সুন্দর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল যার আজন্ম স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন। সমাজতন্ত্রই মানবমুক্তির একমাত্র পথ- এই রাজনৈতিক মতাদর্শে জীবনভর লড়ে গেছেন তিনি। সমাজটাকে সবমানুষের জন্য সমান করা চাই। বাংলাদেশে সেই সমাজ বদলের রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ।

 

যাকে আমরা বলি কমরেড ফরহাদ। রাজনীতির এই আদর্শ পুরুষের জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের সর্বউত্তরের ছোট জেলা শহর পঞ্চগড়ের বোদায়। বিপ্লবী এক জননায়কের নাম কমরেড ফরহাদ। সমাজ বদলের সংগ্রাম করতে গিয়ে যিনি জীবনের একটা বড় সময় অতিক্রম করেছেন জেল-জুলুম আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে। শত নিপীড়নেও যিনি সংগ্রামী জীবন ও আদর্শচ্যুত হননি। তিনি শুধু রাজনীতিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।

 

কমরেড ফরহাদের ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এই দেশপ্রেমিক রাজনীতিক ১৯৮৭ সালের ১০ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় রাশিয়ার মস্কোতে। ৯ অক্টোবর প্রথাবিরোধী এই রাজনীতিকের জীবনাবসান ঘটে। হেলিকপ্টারযোগে মোহাম্মদ ফরহাদের লাশ আনা হয়েছিল বোদা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। লাখো জনতার ঢল নেমেছিল সেদিন প্রিয় এই মানুষটিকে এক নজর দেখার জন্য।

 

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এই জননেতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এক নিবন্ধে লেখেন, ‘আমার দৃষ্টিতে মোহাম্মদ ফরহাদ হলেন সেই প্রজন্মের প্রতিভূ, যাদের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্জন্ম লাভ করে। ১৯৪৭-এর প্রাক্কালে এই অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বে হিন্দু পরিবার থেকে আসা ব্যক্তিদেরই প্রাধান্য ছিল। সে সময় বিকাশমান নব্য মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং তাদের দ্রুত নেতৃত্বে নিয়ে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। মোহাম্মদ ফরহাদ নিজ গুণে এই উত্তরণকালীন-প্রক্রিয়ার মূল ধারক ছিলেন।’

 

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য লেখেন, ‘আমার সঙ্গে মোহাম্মদ ফরহাদের পরিচয় স্বাধীনতার পর, যখন আমি ছাত্রকর্মী হিসেবে সিপিবির রাজনীতিতে সক্রিয়। পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের (১৯৭৩) প্রস্তুতিকালে তার কাজ আমার আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। তবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয় যখন আমি মস্কোতে অধ্যয়নরত। ১৯৮৪ সালে দেশে ফেরার পরবর্তী বছরগুলোতে এই বিরল রাজনৈতিক বীক্ষাসম্পন্ন, অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতাধর ও ব্যাপক মানবীয় গুণাবলিসিক্ত মানুষটির সঙ্গে প্রতিনিয়ত তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। একটাই প্রশ্ন, কোন রাজনৈতিক পথে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের আর্থসামাজিক বিকাশ নিশ্চিত হবে তা নিয়ে। কঠিন আদর্শবাদী একজন মানুষের সংবেদনশীল এই বাস্তবতাবোধ আমাকে আশ্চর্য করত।

 

তিনি লেখেন, ‘মনে পড়ে, ১৯৮২ সালে মস্কোতে গভীর রাতের প্রলম্বিত এক আলোচনায় ফরহাদ ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম, দলকে নিয়ে তার স্বপ্ন কী? তিনি তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন: বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কমিউনিস্টদের একটি গ্র“প গঠন, দলের একটি নিজস্ব ভবন থেকে কর্মকান্ড পরিচালনা এবং দলের পত্রিকা একতাকে দৈনিকে পরিণত করা। তার অবশিষ্ট সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি ১৯৮৬-র নির্বাচনে সংসদে পাঁচজন সিপিবির সদস্য পান। সিপিবিকে একটি স্থায়ী ঠিকানা দেওয়াকেও তিনি নিশ্চিত করেন। এবং আশির দশকে একতার প্রচারসংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।’

 

১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই ফরহাদের জন্ম। তার পিতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আহমেদ সাদাকাতেল বারী। ফরহাদ ছিলেন একজন মেধাবি ছাত্র। দিনাজপুর জেলা স্কুলের ছাত্র থাকাকালে ভাষা আন্দোলনে যোগদান করেন। এবং এরমধ্য দিয়েই তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সংগঠনটির জন্মকালে ফরহাদ দিনাজপুরে ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করেছিলেন।

 

সেই শুরুতেই ফরহাদের রাজনৈতিক জ্ঞান আর সাংগঠনিক দক্ষতা দারুণভাবে দৃষ্টি কাড়ে সিনিয়র নেতৃত্বের কাছে। খুব অল্প সময়েই ফরহাদ জনপ্রিয় ছাত্রনেতায় পরিণত হয়েছিলেন। পাশাপাশি তৎকালিন কমিউনিষ্ট নেতাদের নজর কাড়েন কমরেড ফরহাদ। তৎকালিন বৃহত্তর দিনাজপুরের কমিউনিষ্ট নেতারা ফরহাদের চৌকস রাজনৈতিক মেধা ও সাংগঠনিক দক্ষতায় মুগ্ধ হন।

 

গণমানুষের এই নেতা দৈনিক আজাদ পত্রিকায় কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন শিশু সংগঠকও। মুকুল ফৌজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন আবৃতিকার এবং নাট্যাভিনেতা। ছাত্রাবস্থায় তার এই বহুমুখী প্রতিভার বিকাশ ঘটে। মোহাম্মদ ফরহাদ দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি তৎকালিন ছাত্রী আন্দোলনের নেত্রী রাশেদা খানম এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী রিনা খান নামেই সমধিক পরিচিত। ফরহাদ দুই সন্তানের জনক। কমরেড ফরহাদ বঙ্গবন্ধুর বাকশালের কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন এবং ওই দলের রাজনৈতিক প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পান।

 

ফরহাদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই নেমে আসে নিপীড়নের স্টিমরোলার। নিরাপত্তা আইনে ফরহাদকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৫৪ সালে। সেইসময় তাকে আটক রাখা হয়েছিল বিনাবিচারে। মাত্র সতেরো বছর বয়সে ১৯৫৫ সালে ফরহাদ কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্যপদ পান। ১৯৫৮ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্র“য়ারি ঢাকায় আইয়ুববিরোধী মিছিল বের করা হয়। ১৯৬২ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ এর সহকারি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।

 

১৯৭১ সালে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ গেরিলা বাহিনী গঠনের অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন মোহাম্মদ ফরহাদই।

 

দেশ স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি-সিপিবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কমরেড ফরহাদকে কারাবন্দি করে জিয়া সরকার। তবে ১৯৭৮ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন। জিয়ার আমলেই ১৯৮০ সালে পুনরায় ফরহাদকে গ্রেফতার করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহের তথাকথিত অভিযোগে। ১৯৮১ সালে মুক্তি পান।

 

১৯৮২ সালে ফরহাদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ১৫ দল গঠনে। এরশাদ আমলে ১৯৮৩ সালে ফরহাদকে ফের গ্রেফতার করা হয়। কমরেড ফরহাদ তিন তিনবার সিপিবির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৫ দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৮৬ সালে তিনি পঞ্চগড়-২ আসন তথা বোদা-দেবীগঞ্জ নির্বাচনি এলাকা থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। কমরেড ফরহাদ ছিলেন অনলবর্ষী তুখোড় বক্তা। জাতীয় সংসদের ইতিহাসে তার দেওয়া ভাষণ আজও ইতিহাস হয়ে রয়েছে।

 

অসাধারণ মেধা, বুদ্ধি আর প্রজ্ঞার অধিকারি কমরেড ফরহাদ অত্যন্ত সাধারণ ও সাদামাটা জীবন-যাপন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হয়েও তিনি কোন লোভনীয় চাকরির পেছনে ছুটে যাননি। অথচ তিনি চাইলে সেটা অনায়াসে পেতে পারতেন। কিন্তু তা না করে মানব মুক্তি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন সারাটা জীবন।

 

১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য নিজ হাতে লিখিত জীবনবৃত্তান্তের একাংশে তার বিনীত ভাষ্য ছিল এ রকম : ‘বাল্য বয়স থেকে আমার গোটা জীবনই হলো রাজনৈতিক জীবন। নীতি-আদর্শ, দল কখনো পরিবর্তন করি নাই। ’৫২-র বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এ দেশের সকল গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল আন্দোলনে কোনো না কোনোভাবে শরিক থেকেছি এবং এখনো আছি।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ৯ অক্টোবর ২০১৫/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়