ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

যেভাবে রক্ষা পেল শিউলি

রণজিৎ সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৩০ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেভাবে রক্ষা পেল শিউলি

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

রণজিৎ সরকার : ক্লাস শেষে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে শিউলি। উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর রোডে। সিএনজিচালিত অটোরিকশার জন্য। কিছুক্ষণ পর একটা অটোরিকশা এল। অটোরিকশার চালককে বলল, ‘পান্থপথ যাবেন?’
অটোরিকশাচালক শিউলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, যাব।’
‘ভাড়া কত?’
‘৩০০ টাকা।’
‘২০০ টাকা দেব, যাবেন?’
‘কম হয়ে যায় আপা।’
‘ভার্সিটিতে নিয়মিত যাওয়া-আসা করি, যাবেন কি না বলেন।’
‘আচ্ছা, ওঠেন।’

 

অটোরিকশাচালক বাঁ পাশের গেট খুলে দিলেন। শিউলি অটোরিকশায় উঠে বসল। কাঁধের ব্যাগটা ডান পাশে রাখল। অটোরিকশা চলতে লাগল। শিউলি বসে ভাবছে, কিছু ঘটনা। যে ঘটনাগুলো সারা দেশের মানুষ জানে। সাম্প্রতিককালে বেশি করে ঘটছে এ ঘটনা। শিউলির মনে পড়ছে পয়লা বৈশাখে টিএসসিতে যৌন নিপীড়ন, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জে ও গারো মেয়েকে গণধর্ষণের ঘটনাগুলো।

 

শিউলি একা অটোরিকশায় বসে আছে। খুব ভয় পাচ্ছে ও। এর আগে এত ভয় লাগেনি কখনো শিউলির। ভাবতে ভাবতে শিউলি ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করল। তারপর মোবাইল অসংখ্যা নম্বরের ভেতর থেকে প্রিয় মানুষের নম্বরটা বের করল। সবুজ বাটুন চেপে কল করল। বলল, ‘রাসেল, আমি সিএনজিতে উঠেছি। দ্রুত চলে আসব। তুমি অপেক্ষা করো। একটু লাইনে থাকো।’ এই বলেই, মোবাইলটা কানের কাছে থেকে একটু সরে নিয়ে শিউলি চালককে বলল, ‘ভাইয়া, আপনার সিএনজির নম্বর কত?’
অটোরিকশাচালক বললেন, ‘কেন আপা?’
‘দরকার আছে। তাড়াতাড়ি বলেন।’
‘ঢাকা মেট্রো-ড ১১০২১২।’
‘ঠিক আছে। ধন্যবাদ আপনাকে।’
মোবাইলটা আবার কানের কাছে নিয়ে শিউল বলল, ‘রাসেল, সিএনজির নম্বর ঢাকা মেট্রো-ড ১১০২১২।’

 

ওপর প্রান্ত থেকে রাসেল বলল, ‘ঠিক আছে। অপেক্ষা করছি। চলে এসো তুমি। রাস্তায় সমস্যা হলে কল করো।’
‘ঠিক আছে। ওকে বাই।’

 

অটোরিকশা চলছে। বিমানবন্দরে এসে জ্যামে পড়ল।
চালক বললেন, ‘আপা, আপনার নামটা কি জানতে পারি?’
শিউলি বলল, ‘আমার নাম জেনে আপনার লাভ কী?’
‘আপা, আমি যখন পড়ালেখা করতাম। তখন নিয়মিত ডায়েরি লিখতাম। এখন সিএনজি চালাই। আমার গাড়িতে যারা ওঠেন, তাদের নাম জিজ্ঞেস করি। এবং তাদের নাম আমার ডায়েরিতে লিখে রাখি।’
‘আমার নামও লিখবেন!’
‘হ্যাঁ, লিখব। আপনি তো আমার যাত্রী।’
‘আমার নাম শিউলি।’
‘ধন্যবাদ আপা।’ এই বলে চালক তার ডায়েরিটা বের করে শিউলির নামটা লিখে রাখলেন। সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। অটোরিকশা চলতে লাগল।

 

কিছুক্ষণ পর চালক বললেন, ‘ আপা, আপনাকে আরো কিছু কথা বলতে চাই।’
শিউলি বলল, ‘কি কথা বলেন?’
‘আপা, আপনি বিবাহিত না অবিবাহিত?’
শিউলি অবাক হয়ে বলল, ‘আপনার জানার দরকার কী?’
‘যদি বলেন আর কি। মন চাইল তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
শিউলি অটোরিকশাচালকের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি হলো। মোবাইল ফোনটা বের করল। তারপর মিথ্যা মিথ্যা করে বলল, ‘আব্বু, আমি  ‘ঢাকা মেট্রো-ড ১১০২১২ নম্বর সিএনজিতে আসছি।’

 

অটোরিকশাচালক মনে মনে ভাবছে, আমার গাড়ির নম্বর তো সবাইকে বলে দিয়েছে। নিশ্চয় নিজের নিরাপত্তার জন্য। খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে।

 

গাড়ি বনানীর জ্যামে পড়ল। চালক আবার বললেন, ‘আপা, আমাকে নিয়ে আপনার ভয়ের কিছু নেই। আমি আর দশজনের মতো না।’
‘আপনি ভালো। অন্যরা খারাপ কেন?’
‘আপা, আপনাকে বলব না। আপনি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। আমার প্রতি আপনি অবিশ্বাস করেছেন। আপনি আগে বলেন, আপনি বিবাহিত না অবিবাহিত।’

 

শিউলি চালকের মুখে থেকে অজানা তথ্য জানার জন্য মিথ্যা করে বলল, ‘আমার বিয়ে হয়েছিল। ডিভোর্স হয়েছে।’
‘ডিভোর্স হলো কেন?’
‘কারণ আছে। অনেক কারণ। এবার বলেন, অন্য চালকেরা খারাপ কেন? তারা কী করেন, সে কথা বলেন?’

 

‘আপা, অনেক ঘটনা আছে। কিছু কিছু সিএনসিচালক নারীকে একা পেলে কত রকমের হয়রানি করে। ছিনতাই করে। ভাড়া বেশি রাখে। মাঝ পথে দালালদের হাতে তুলে দেয়। নাকে কিছু ওষুধ ধরে অজ্ঞান করে নিয়ে যায়। লুকিয়ে রেখে মুক্তিপণ দাবি করে। যৌন হয়রানি করে। এমনকি গণধর্ষণ করে মেরেও ফেল কেউ কেউ। আরো কত কিছু করে।’

 

শিউলির মোবাইলে কল এল। সবুজ বাটুন চেপে মোবাইলটা কানে ধরল। তারপর বললেন, ‘রাসেল, বনানী পার হচ্ছি।’
বনানীর জ্যাম ছাড়ল। গাড়ি চলছে। শিউলি চুপচাপ।
চালক বললেন, ‘আপা, আমার কথাগুলো শুনে মন খারাপ হয়ে গেল।’
শিউলি রেগে বলল, ‘চুপ থাকেন। গাড়ি চালান।’
অটোরিকশা চলছে। মহাখালী পার হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে এসে আবার জ্যামে পড়ল গাড়ি। একটা মেয়ে অটোরিকশার পাশে এসে বলল, ‘আপা, ফুল নেবেন?’
শিউলি তাকিয়ে দেখে অনেকগুলো ফুল। একসঙ্গে বাঁধা। পছন্দ হলো। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কত দিতে হবে?’
‘২০ টাকা।’
‘আচ্ছা। নেব, কিন্তু আমার কাছে তো ভাংতি টাকা নেই। তোমার কাছে কি ১০০ টাকার নোট ভাংতি হবে?’
‘না আপা, আমার কাছে এত টাকা নেই।’

 

হঠাৎ অটোরিকশাচালক বললেন, ‘আপা, আমার কাছে ভাংতি টাকা আছে। আমি দিই।’
শিউলি বলল, ‘আচ্ছা দেন।’
অটোরিকশাচালক মনের আনন্দে ২০ টাকার একটা নোট মেয়েটাকে দিলেন। মেয়েটা টাকা নিয়ে চলে গেল।
 ফুল হাতে নিয়ে চালককে শিউলি বললেন, ‘আপনি চিন্তা করেন না। আপনাকে ভাড়া দেওয়ার সময় একসঙ্গে টাকাটা দিয়ে দেব।’
‘কি যে বলেন আপা। এ জীবনে তো কাউকে ফুল কিনে দেওয়ার সুযোগ হয়নি আমার...।’
চালকের কথা শেষ না হতেই শিউলি বলল, ‘কি বলেন? চুপ থাকেন।’
‘আপা, খারাপ কিছু বলছি?’
‘চুপ থাকেন। কথা বলতে ভালো লাগছে না আমার।’
শিউলির ভয় পাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, যদি অটোরিকশা নিয়ে চালক অন্য দিকে নিয়ে যায়। তাহলে ! দেব চিৎকার।
অটোরিকশা ফার্মগেট পার হলো। চালক বললেন, ‘আপা, নামার তো সময় হয়ে এল। আপনার কাছে একটা জিনিস চাওয়ার আছে আমার।’
কিছুক্ষণ পর শিউলি বলল, ‘জিনিসটা কী?’
‘আপনার মোবাইল নম্বরটা দেবেন?’

 

শিউলি অটোরিকশা চালকের ফোন নম্বরটা চাওয়ার দেখে অবাক হলো।
সঙ্গে সঙ্গে শিউলি মোবাইল ফোনটা বের করে রাসেলকে কল করল। বলল, ‘রাসেল, তুমি কোথায় আছ?’
অপর প্রান্ত থেকে রাসেল বলল,‘বসুন্ধরা সিটিতে আছি।’
‘তুমি নিচে এসো। সিএনজি ভাড়া দিতে হবে।’
অটোরিকশা চলে এল বসুন্ধরা সিটির সামনে। অটোরিকশা থেকে নেমে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল শিউলি।
রাসেল সামনে এসে হাজির। তারপর রাসেল বলল, ‘ভাড়া কত?’
শিউলি বলল, ‘২২০ টাকা দাও।’
রাসেল মানিব্যাগ থেকে ২২০ টাকা বের করল।  রাসেলর হাতে ফুলগুলো দিল শিউলি। অটোরিকশার চালক তাকিয়ে আছে। রাসেলের হাতে থেকে টাকা নিয়ে অটোরিকশার চালককে দিতে দিতে বলল,‘এবার বুঝলেন তো, পাশের মানুষটা আমার কে?’

 

অটোরিকশাচালক আর কিছু না বলে টাকা নিয়ে ভয়ে ভয়ে চলে গেল। শিউলি আর রাসেল হাত ধরে সিটির ভেতর প্রবেশ করতে লাগল। শিউলি বলল, ‘সিএনজিচালককে কিছু কথা বলে বোকামি করেছিলাম। খুব ভয় হচ্ছিল। এ রকম বোকামি আর কোনো দিন করব না।’
রাসেল বলল, ‘কী এমন কথা বলেছিলে।’
‘ওপরে উঠি। বসে সব বলব।’
চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল ওরা দুজন।


 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ মে ২০১৫/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়