ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যেমন কাটছে ভাষাসংগ্রামী সৈয়দ আব্দুল হান্নানের দিনকাল

শাকিল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেমন কাটছে ভাষাসংগ্রামী সৈয়দ আব্দুল হান্নানের দিনকাল

স্ত্রী সৈয়দা সালেহা খাতুনের সঙ্গে ভাষাসংগ্রামী সৈয়দ আব্দুল হান্নান

শাকিল আহমেদ, শেরপুর : ভালো নেই ভাষাসংগ্রামী সৈয়দ আব্দুল হান্নান। ইতিমধ্যে জীবনের ৮৪টি বছর অতিক্রম করেছেন এ বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ। এখন তার বিস্তর অবসর সময়। খোঁজখবর নেওয়ার লোকজনও কমে গেছে। একা চলাফেরা করতে পারেন না। কানে কম শোনেন, স্মৃতিশক্তিও লোপ পেয়েছে। বর্তমানে তিনি পৌর শহরের মধ্য শেরীপাড়া এলাকার নিজ বাড়িতে স্ত্রী সৈয়দা সালেহা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে শেষ জীবন অতিবাহিত করছেন।

 

ভাষাসংগ্রামী ও প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ হিসেবে সৈয়দ আব্দুল হান্নান শেরপুরের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। ১৯৫২ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে পড়ার সময় তিনি সক্রিয় কর্মী হিসেবে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় শেরপুরে সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকা-ের নেতৃত্বে যে ক’জন তরুণ অগ্রগামী ছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি।

 

তার বড় ভাই ছাত্রনেতা সৈয়দ আব্দুস সোবহান ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে শেরপুর থেকে গ্রেফতার হন। ভাষা আন্দোলন ছাড়াও তিনি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকহানাদার ও দেশীয় দোসরদের হাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। ২০০৫ সালে তিনি ভাষাসংগ্রামী হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হন।

 

সৈয়দ আব্দুল হান্নান ১৯৩২ সালে ২৫ ডিসেম্বর শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ আব্দুল হালিম ও মা রাবেয়া খাতুন। তিন মেয়ে ও দুই ছেলের বাবা তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫৬ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এমএ এবং ১৯৬৪ সালে এলএলবি পাস করেন। ১৯৬৪ সালের ১৬ জুলাই তিনি শেরপুর কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৯৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ওই কলেজ থেকেই অবসর নেন।

 

ভাষাসংগ্রামী সৈয়দ আব্দুল হান্নান বলেন, ১৯৫২ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে তিনি আইএসসি পাস করেন। সে সময় তিনি একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে শেরপুরের বিভিন্ন ছাত্র সমাবেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি আরো বলেন, ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন বেগবান হয়েছে। এক কথায় বললে, ভাষা আন্দোলন থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছি।

 

ভাষাসংগ্রামী সৈয়দ আব্দুল হান্নান

 

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস : ১৯৪৮ সালে শেরপুর শহরের স্কুলগুলোতে ছাত্ররা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দু-তিন দিন ক্লাস বর্জন করে। কমিউনিস্ট নেতা হারু পাল ছাত্রদের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে বৈঠক করতেন। হেমন্ত ভট্টাচার্য ও রবি নিয়োগী তাদের বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা দিতেন। ভাষা আন্দোলন শেরপুরে দানা বাঁধে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্র মিছিলে গুলির প্রতিবাদে। অবশ্য বাংলা ভাষার দাবিতে ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ থেকেই ছাত্রদের মিছিল, জনসমাবেশ ও ধর্মঘট চলতে থাকে। এসব কর্মকা-ের নেতৃত্বে ছিলেন তরুণদের মধ্যে হাবিবুর রহমান, নিজামউদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, আব্দুর রশীদ, আহসান উল্লাহ, সৈয়দ আবদুস সোবহান, সৈয়দ আব্দুল হান্নান প্রমুখ। তারা ছাত্রদের সমবেত করে বিভিন্ন জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাদেরকে রাজনৈতিক পরামর্শ ও সহায়তা দিতেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও শেরপুর থানা যুবলীগের সভাপতি খন্দকার মজিবুর রহমান, আওয়ামী মুসলিম লীগের নূর মোহাম্মদ উকিল ও সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান।

 

শেরপুরের  জি.কে.পি.এম. ইনস্টিটিউট, ভিক্টোরিয়া একাডেমী, শেরপুর মাদ্রাসা ও কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। আনোয়ারুল ইসলাম ডিম, খন্দকার নুরুল হক,  আহমেদ  সালেহ, অরুণ বক্সী, অমিত বক্সী, চিত্ত বক্সী,  সিরাজুল হক, শওকত জাহান লুদু মিয়া, আব্দুল হারুন, সাদেকুর রহমান, শফি উদ্দিন, নাসির উদ্দিন, সৈয়দ আলী, শামসুল হুদা, হিরা মিয়া, জাহানারা বেগম, টিপু সিং, মোহাম্মদ ইউসুফ (মাদ্রাসার ছাত্র), কলিম উদ্দিন এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলির সংবাদ সেদিন সন্ধ্যায় শেরপুরে পাওয়া যায় রায়চরণ সাহার রেডিওতে। সেটিই ছিল শেরপুরে তৎকালীন একমাত্র রেডিও। এছাড়া লোকমারফত পরদিন দুপুর ১২টায় ঢাকার সংবাদ পৌঁছে শেরপুরে। এ ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন বিকেলে শহরে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হয়। স্থানীয় স্কুলের ছাত্ররা মিছিলে অংশ নেয়। ছাত্ররা ছাড়াও সচেতন জনগণও মিছিলে যোগ দেয়। এই মিছিলে প্রায় এক হাজার লোক অংশগ্রহণ করেন।

 

১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের শুকল বিল্ডিংয়ে ‘সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের শেরপুর থানা শাখার সভাপতি নূর মোহাম্মদ উকিল। পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি নয়ানি বাড়ি মাঠে এই কমিটির উদ্যোগে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় ৪-৫ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন। এ ধরনের বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ সভা শেরপুর পৌরসভার পার্শ্ববর্তী এলাকার হাটবাজারেও অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালের মার্চে সারা দেশে যে হরতাল আহ্বান করা হয় সেটিও শেরপুরসহ পার্শ্ববর্তী সব থানা ও ইউনিয়নে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়।

 

ভাষাসংগ্রামী সৈয়দ আব্দুল হান্নানের সঙ্গে প্রতিবেদক শাকিল আহমেদ

 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শেরপুরের চকবাজার নামক স্থানে একটি খোলা মাঠে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্থানীয় প্রগতিশীল নেতারা। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট নেতা হাবিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৫৩ সালের ২৮ নভেম্বর শেরপুর পৌরসভা কার্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্থানীয় জি.কে.পি.এম. ইনস্টিটিউট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল স্কুল, শেরপুর মাদ্রাসা ও গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে ১৩ সদস্যের একটি ‘শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটি’ গঠন করা হয়। মনসুর আলী ও নিজাম উদ্দিন আহমদ শহীদ মিনারের জন্য ইট দিয়ে সাহায্য করেন। তৎকালীন আড়াই আনি জমিদারের বড় তরফের ম্যানেজার ক্ষীতিধর রায়ের কাছে রবি নিয়োগীর নেতৃত্বে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য জায়গা ব্যবহারের অনুমতির আবেদন করা হয়। তার মৌখিক স্বীকৃতি নিয়ে চকবাজারে দেবোত্তর সম্পত্তির উপর শহীদ মিনার নির্মাণ শুরু হয়। রাজমিস্ত্রি বিশ্বনাথ চৌহান রাতের অন্ধকারে আলো জ্বেলে গোপনে তিন ধাপের একটি বেদি নির্মাণ করে সেটির উপর একটি পিলার তুলতে সক্ষম হন। টাকার অভাবে মিনারের গায়ে পলেস্তারা লাগানো সম্ভব হয়নি। এভাবেই ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর গোলার আঘাতে ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই শহীদ মিনারেই শেরপুরের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- অনুষ্ঠিত হতো।

 

তথ্যসূত্র : ভাষা আন্দোলনে শেরপুর : ড. এ.কে.এম. রিয়াজুল হাসান

 

 

রাইজিংবিডি/শেরপুর/১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/শাকিল/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়