ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

রংপুরের পাঁচ ভাষাসংগ্রামীর স্মৃতিকথা

নজরুল মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৩, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রংপুরের পাঁচ ভাষাসংগ্রামীর স্মৃতিকথা

ছবির কোলাজ

নজরুল মৃধা, রংপুর : রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশ যখন উত্তাল সে সময় রংপুরের দামাল ছেলেরাও বসে ছিল না। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তারা রাজপথে মিছিল-মিটিং সমাবেশ করে জানিয়েছে তীব্র প্রতিবাদ। এদের মধ্যে কেউ কেউ জেল খেটেছে। কেউ কেউ আত্মগোপনে থেকে সংগ্রাম চালিয়েছে। আবার কারো কারো ছাত্রত্ব চলে গেছে।
’৫২-এর রক্তঝরা দিনগুলো নিয়ে কথা হয় রংপুরের পাঁচ ভাষাসংগ্রামীর সঙ্গে। তাদের স্মৃতিপট থেকে উঠে আসা কিছু কথা তুলে ধরা হলো রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য।

 

ভাষাসংগ্রামী শাহ আব্দুর রাজ্জাক (সাবেক এমপি)

 

 

১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রংপুর কারমাইকেল কলেজে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্ররা। তখন থেকেই রংপুরে ভাষা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়ি আমরা। ভাষা আন্দোলনে পুলিশি নির্যাতনে হাঁটুতে আঘাত পেয়েছিলাম, সেই আঘাতের চিহ্ন আজো বয়ে বেড়াচ্ছি।

 

নগরীর মাহিগঞ্জ নিজ বাসভবনে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শাহ আব্দুর রাজ্জাক ১৯৫২ সলের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ কথাগুলো বললেন ভাঙা ভাঙা গলায়।

 

তিনি বলেন, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন থেকেই ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। ’৫২ সালে কারমাইকেল কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলাম। ১৯৪৮ সালে ইস্ট পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং জেলা কমিটির সদস্য ছিলাম। ১৯৫৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইস্ট পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়। সেই কাউন্সিলে সদস্য নির্বাচিত হই।

 

ভাষা আন্দোলনে রংপুরে তার সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন আজিজুর রহমান, নূরুল ইসলাম, মতিয়ার রহমান, কাজী আব্দুল হাকিমসহ আরো অনেকে। তাদের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রায় প্রতিদিনই আমরা ভাষা আন্দোলনের দাবিতে মিছিল-মিটিং করতাম। তাদের এই আন্দোলনে কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক জমির উদ্দিন এবং কলিম উদ্দিন উৎসাহ যোগাতেন এবং জ্বালাময় বক্তৃতা দিতেন। আন্দোলন করতে গিয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। এ সময় পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কোনপ্রকার যোগাযোগ হতো না। ১৯৫৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সরাসরি পরিচয় হওয়ার পর দেশপ্রেমে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ হই। স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।

 

বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের এই মানুষটি বলেন, ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন। জেল থেকে বের হয়ে ভাষা আন্দোলনের দাবিতে আরো সোচ্চার হন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এখন আর বাড়ি থেকে বের হন না। কেউ এলে তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং পত্রিকা পড়ে এখন সময় কাটছে এই ভাষাসংগ্রামীর।

 

ভাষাসংগ্রামী শাহ তবিবর রহমান প্রধান

 

 

সারা দেশে যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল সে সময় রংপুরের দামাল ছেলেরাও বসেছিল না। বিশেষ করে যারা ছাত্র তারা আন্দোলনে নেমে পড়ে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারা দেশে রাষ্ট্রভায়া বাংলার দাবিতে হরতাল হলে রংপুরেও স্বতঃস্ফূতভাবে হরতাল পালিত হয়। তিনি স্মৃতিচারণে বলেন, ’৫২ সালের আগ পর্যন্ত মার্চই রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যখন সালাম, রফিক, বরকত, শফিকসহ আরো বেশ কজন মারা গেল তখন রংপুরের রাজপথে নামি আমরাও। ২৩ ফেব্রুয়ারি কারমাইকেল কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে আসা হলে পুলিশ বাধা দেয়। প্রায়ই তাদের মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করত। সে সময় ছাত্র মতিয়ার রহমানসহ অনেকেই গ্রেফতার হয়। সুফি মোতাহার হোসেনসহ অনেকেই আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যায়। ১৯৫২ সালে সালে তিনি রংপুর জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন। রংপুরে কাদামাটি দিয়ে গড়া আজকের শহীদ মিনার তারাই গড়েছেন।

 

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারিতে তখন সারা দেশে হরতাল চলছিল। দোকানপাট থেকে আরম্ভ করে অফিস-আদালত অচল হয়ে পড়েছে। রংপুরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল চলছিল। সে সময় মিলি চৌধুরী নামে এক ছাত্রীনেত্রী আদালত চত্বরে গিয়ে দেখেন এক জজ আদালত বিচারকাজ করছেন। মিলি চৌধুরী জজের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানাল ‘সারা দেশে হরতাল চলছে। আর আপনি আদালতে বিচার করছেন।’ এ কথা বলে মিলি চৌধুরী ওই জজের কলম কেড়ে নেন। এ ঘটনায় জজ হতভম্ব হয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মিলি চৌধুরী ও তার স্বামী ভিকু চৌধুরীকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। ’৫২-এর আন্দোলনে মিলি চৌধুরীর বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় তারা মিটিং করতেন।

 

মোহাম্মদ আফজাল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি করতেন। পরে তিনি গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে পার্টির উপদেষ্টাম-লীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮২ সাল এবং ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তিনি এক প্রকার নিঃসঙ্গ অবস্থায় নগরীর মুন্সিপাড়া বাড়িতে অবস্থান করছেন।

 

ভাষাসংগ্রামী আলহাজ মীর আনিছুল হক পেয়ারা মাস্টার

 

 

ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যাওয়ার জন্য রংপুর জিলা স্কুল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। পরে আদর্শ স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে ১৯৫২ সালে কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন তিনি।
স্মৃতির আয়না খুলে তিনি জানালেন, ১৯৫২ সালে আন্দোলনে তখন নেতৃত্ব দিতেন শাহ তৈয়বুর রহমান, নুরুল ইসলাম, সুফি মোতাহার হোসেনসহ অনেকে। তাকে ভাষা আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তার বাবা মরহুম মীর আব্দুস সামাদ ও মা মাহামুদা পেয়ারুন নেছা।

 

২১ ফেব্রুয়ারির ওই দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা যখন শুনলাম ভাষার দাবিতে ঢাকায় বেশ কজন মারা গেছে, তখন কারমাইকেল কলেজ থেকে একটি মিছিল নিয়ে আমরা শহরের দিকে আসছিলাম। আদর্শ স্কুল পার হওয়ার পরপরই পুলিশ মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশ তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করলে আত্মগোপনে চলে যান। তাই ১৯৫৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে ১৯৫৫ সালে পরীক্ষা দেন।  আন্দোলনের কারণে আবার ১৯৫৬ সালে তাকে পলাতক হতে হয়। ১৯৬১ সালে আফানুল্লাহ স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা।

 

ভাষাসংগ্রামী আশরাফ হোসেন বড়দা

 

 

এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাসংগ্রামী আশরাফ হোসেন বড়দা রংপুর শহীদ মিনারে যাবেন অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ভিন্ন বেশে। সত্যিকারের ভাষার স্বাধীনতার জন্য প্রতিবাদ জানাবেন ভিন্ন আঙ্গিকে।

 

ভাষা আন্দোলনে কেমন করে জড়ালেন এ প্রসঙ্গে বড়দা বললেন, জ্ঞানতাপস শহীদুল্লাহর একটি অর্টিকেল পড়ে রাষ্ট্রভাষার প্রতি উদ্বুদ্ধ হই। প্রগতিশীল শিক্ষক স্যার সন্তোষ গুহ ও কবি শাহ আমানত আলীর কাছ থেকেই পেয়েছেন প্রাণের ভাষা বাংলার অনুপ্রেরণা ভাষাসংগ্রামী আশরাফ হোসেন বড়দা।

 

১৯৫২ সালে তিনি লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৫২ সালে লালমনিরহাটের আবুল হোসেন, ছামছুল হক, আনিছুল হক, ষষ্টী সরকার, নাসির উদ্দিন, নাসিম আহমেদ, টুকু চৌধরীসহ অনেকের সঙ্গে মিছিলে শরিক হতেন তিনি। ’৫২ সালে যখন শুনলেন ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে সালাম, রফিক, বরকতসহ অনেকেই।  তখন তারা রাজপথে নামেন। সে সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। তখনকার মিছিলে স্লোগান ছিল, ‘নাজিম-নুরুল দুই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’

 

১৯৫১ সাল থেকেই রংপুরের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। ’৫৪ সালে আত্মগোপনে চলে যান আন্দোলনের কারণে। ১৯৫৫ সাল থেকে রংপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার রাজনৈতিক গুরু শাহ আমানত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। তিনি সে সময় গ্রেফতারও হয়েছেন। তার হাত ধরেই ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসা।

 

প্রথমে ন্যাপ-ভাসানী করলেও পরে ইউনাইটেট পিপলস পার্টি করেন। এরপর ৭ দলের হয়ে বিএনপিতে কিছুদিন থেকে পদত্যাগ করেন।  তিনি জানান, যে আকাক্সক্ষায় ভাষা আন্দোলন করেছিলাম তা আজো পাইনি। সুন্দর একটি সমাজ গড়তে পারলাম না। সত্যিকারের ভাষা যার স্বাধীনতা আনতে হলে বিভিন্ন মিডিয়ায় ভাষার আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে।

 

 

রাইজিংবিডি/রংপুর/১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/নজরুল মৃধা/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়

নির্বাহী সম্পাদক: তাপস রায়

প্রকাশক: এস এম জাহিদ হাসান

ঠিকানা: ১৯৮-১৯৯, মাজার রোড,
মিরপুর-১, ঢাকা ১২১৬

একটি স্কাইরুট মিডিয়া লিমিটেডের প্রতিষ্ঠান

টেলিফোন: +৮৮-০১৬৭৮০২৮১৩৬

মার্কেটিং : +৮৮-০১৬৮৬৬৯৩৫৪৯
+৮৮-০১৬৮৬৬৯০২৬৬

ইমেল: [email protected]

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.risingbd.com কর্তৃক সংরক্ষিত