রজনীগন্ধাপুর : তৃতীয় পর্ব
ইমদাদুল হক মিলন || রাইজিংবিডি.কম
আমি নিজেকে নিয়ে থাকি। কাউকে কিছু বলি না। যে যার মতো চলছে, চলুক। অপুকে নিয়ে তেমন চিন্তা করি না, মিতুয়াকে নিয়ে ভয়। এফেয়ার টেফেয়ারে জড়িয়ে বড় রকমের কোনও ভুল না করে ফেলে! মায়ের ঘটনা জানে। এই কারণে মায়ের শাসন কি সে মানবে? আমার কি কিছুই করার নেই? বাতিল মানুষের আসলে কি কিছু করার থাকে!
তার পরও মিতুয়ার সঙ্গে দুয়েকবার কথা আমি বলেছি। কী সুইট সিক্সটিন, এফেয়ার টেফেয়ার হল? কার কার মাথা ঘোরাচ্ছো?
প্রথম প্রথম মজার ভঙ্গিতেই জবাব দিতো মিতুয়া। তারপর দেখি রিয়্যাক্ট করে। ফালতু কথা বলো না তো, দাদু।
একটু রুড টাইপের মেয়ে। কথা বলার ভঙ্গি ভাল না। মিলিয়াকেও রিপোর্ট করলো একদিন। মিলিয়া খুবই শান্ত ভঙ্গিতে আমাকে বলল, বাবা, আপনি ঠাট্টা করলে মিতুয়া মাইন্ড করে।
জুলেখার মাও বলল একই কথা। সাহেব, মিতুয়া বিরক্ত হয়।
ব্যস খবর হয়ে গেল আমার। একদম থেমে গেলাম।
তো আউটিংয়ের কথা ওঠায়, জামি ব্যবস্থা করেছে শুনে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। মিলিয়াকে বুঝতে দিলাম না। বললাম, কোথায় যাবে?
এই তো ঢাকার কাছেই। ভালুকা থেকে পশ্চিমে। কী যেন নাম জায়গাটার। পাড়াগাঁও বা এ রকম। জামির এক ক্লায়েন্ট সাত আটশো বিঘা জমি কিনেছে। এখনও কিছু করেনি সেখানে। শুধু গাছপালা মাঠ ডোবা, এ রকম জায়গা। দুটো পরিবার আছে দেখাশোনার জন্য। মাটির কয়েকটা ঘর আছে। ভদ্রলোক আরও জমি কিনবেন। বায়না করেছেন অনেক জমি। দেড় দুহাজার বিঘা কিনে রাখবেন। করবেন না কিছুই। একটু অদ্ভুত টাইপের লোক। লোকে বাংলোবাড়ি, এগ্রিকালচারাল প্রজেক্ট বা কম দামে কিনে বেশি দামে জমি বিক্রির আশায় জমি কেনেন। এই ভদ্রলোক কিনেছেন একটা গ্রাম বানাবার জন্য।
আমি অবাক। মানে?
তিনি একটা গ্রাম তৈরি করবেন। লোকজন তেমন থাকবে না। নির্জন নিরিবিলি গ্রাম। মাটির ঘরদুয়ার থাকবে। দুচারটা পরিবার থাকবে। গাছপালা ডোবা নালা ফসলের মাঠ যা যা থাকে গ্রামে সবই থাকবে। কোনও কিছুই বদলাবেন না। যেখানে যে গাছটি আছে, যে ঝোপটি আছে, ডোবানালা যা আছে ঠিক তাই থাকবে। নিজে করবেন না কিছুই। গ্রামটির নাম তিনি ঠিক করেছেন ‘রজনীগন্ধাপুর’।
বাহ, বেশ নতুন চিন্তা তো। নামটাও খুব সুন্দর দিয়েছেন। রজনীগন্ধাপুর।
হ্যাঁ। ওই জায়গায়ই আমাদের নিয়ে যাবেন। বড় বিজনেস ম্যান। জামিদের চেয়ে বছর তিনেকের বড় হবেন। কয়েকজন মাত্র মানুষ আমরা যাচ্ছি। ভদ্রলোকের বউ ছেলেমেয়ে, আমাদের ফ্যামিলি আর জামি। এই কয়জনই মানুষ।
রুবানা যাচ্ছে না?
ও তো দেশে নেই। ছেলে পড়ে কানাডায়। ছেলের কাছে গেছে।
আমি একটু দমে গেলাম। কিন্তু বুঝতে দিলাম না মিলিয়াকে। আমি না গেলে হয় না মা?
কেন?
না এমনি। তোমরা ঘুরেটুরে বেড়ালে, আনন্দ করলে। আমি বুড়ো মানুষ আমি বাড়িতেই থাকি।
আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু অপু আপনাকে না নিয়ে যাবে না।
আমি অপুকে বুঝিয়ে বলি।
তা না করে আপনি চলুন না, বাবা। ঢাকার বাইরে তো আপনার যাওয়াই হয় না। গেলেন একদিন। আউটিংয়ে গেলে ভাল লাগবে। আর ওরকম একটা গ্রাম...। চলুন।
বাতিল মানুষদের বাড়াবাড়ির ক্ষমতা থাকে না। কথা বেশি বলারও ক্ষমতা থাকে না। তারা কথা বলে নিজে নিজে। মনে মনে।
আমি মনে মনে অনেক কথা বললাম। কেন এই বাতিল মানুষটাকে নিয়ে টানাটানি? কী না কী দৃশ্য দেখতে হয় ওখানে? হয়তো জামির সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে হাসিমুখে কথা বলছে মিলিয়া, রোমান্টিক চোখে তাকাচ্ছে। ওরকম কিছু কি আমি সহ্য করতে পারবো? আমার কলিজাটা পুড়ে যাবে না! দিপুর কথা ভেবে জ্বলে খাক হয়ে যাবে না বুক!
এতদিন যা শুনে আসছি, মিতুয়া মিলিয়ার ঝগড়াতে যা স্পষ্ট হয়েছে আমার কাছে, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই যে জামির সঙ্গে মিলিয়ার সম্পর্কটা বেশ গাঢ়। তার ওপর রুবানা নেই দেশে।
সব মিলিয়ে আমার বেশ কাতর অবস্থা।
কী করবো?
অপুকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করবো?
সেটা করতে গেলে না মিলিয়া যদি মাইন্ড করে! আপনাকে আমি এত করে বললাম বাবা, তার পরও আপনি আবার অপুর সঙ্গে কথা বলতে গেলেন? তার মানে আমার কথার কোনও দাম নেই আপনার কাছে?
কী জবাব আমি দেবো?
মিলিয়া হয়তো শেষ পর্যন্ত বলল, ঠিক আছে যেতে হবে না আপনাকে।
আমি হয়তো গেলামও না। কিন্তু মিলিয়া কি তারপর থেকে স্বাভাবিক আচরণ আমার সঙ্গে করবে? গম্ভীর হয়ে থাকবে। নিজ থেকে কথা বলবে না। আমি তিনটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটার হয়তো জবাব দেবে। ওই আচরণে ভিতরে ভিতরে জ্বলেপুড়ে খাক হবো আমি।
কী দরকার এসব অশান্তির?
বাতিল মানুষদের নিজের কোনও স্যে থাকে না। যে যা বলে তাই শুনতে হয়।
আমিও শুনলাম।
আজ আর হাঁটতে যাওয়া হয়নি। সকাল সাতটার দিকে জামির সিলভার কালারের পাজেরো জিপ চলে এল আমাদের বাড়ির কাছে। জামি ড্রাইভিং সিটের পাশে। আমরা চারজন পেছনে। গাড়ি ছুটলো।
আমি অনেকদিন পর ভাল প্যান্ট শার্ট পরেছি, জুতো পরেছি। যে ধরনের পোশাক পরে অফিস করতাম সেই ধরনের পোশাক। শুধু টাইটা পরিনি। সঙ্গে একটা কাঁধে ঝোলাবার ছোট ব্যাগ নিয়েছি। তাতে আমার অষুদ, সুগার ফ্রি বিস্কুট, এক বোতল পানি, কয়েকটা চকলেট।
একটা মোবাইল ফোন আছে। পুরনো নকিয়া সেট। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার জন্য, বিদেশে থাকা ছোট বোনটির সঙ্গে কথা বলার জন্য রেখেছি। বড়ভাই বোন দুজনেই তো চলে গেছে। ভাবি, দুলাভাই নেই। থাকার মধ্যে আছে আমেরিকার ওই বোন। আঁখি। ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা আছে ঢাকায়, তাদের বউঝি স্বামী ছেলেমেয়েরা আছে। ভাগ্নে ভাগ্নিরা আছে। তাদেরও পরিবারের ডালপালা ছড়িয়েছে। আমার চাচা ফুফুর দিককার লোকজন, খালা মামাদের দিককার লোকজন, সব মিলিয়ে লোকজন আছে কম না। কিন্তু যোগাযোগ সেভাবে কারও সঙ্গে নেই। হঠাৎ কারও কথা মনে পড়ল, তাকে একটা ফোন করলাম। বা কারও হঠাৎ মনে পড়ল তাদের একটা বাতিল আত্মীয় এখনও বেঁচে আছে, হয়তো একটা ফোন করল। কিছুক্ষণ কথা বলল।
এই ধরনের আত্মীয়দের ক্ষেত্রে দেখেছি, ফোন করলে দ্রুত কথা শেষ করে ফোন রেখে দেয়। আমার ইচ্ছে করে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলি, অনেক কথা বলি। তাদের সময় কোথায় আমার কথা শোনার? তাদের সময় নেই, আমার তো অঢেল সময়! তারা নেহাতই দায়িত্ব পালনের জন্য খোঁজ খবরটা করে।
বাতিলদের সঙ্গে কে কতক্ষণ কথা বলতে চায়?
আমার এখন প্রায়ই মনে হয়, মিলিয়া বা মিতুয়া চায়, যত দ্রুত আমি মরি। তাহলে ওদের আর কোনও চক্ষু লজ্জারও জায়গা থাকে না।
শুধুমাত্র অপুটা বোধহয় চায় না।
সে মাঝে মাঝে আমার রুমে আসে। কী করো দাদু?
আমি হয়তো টিভি দেখছি বা অসহায় ভঙ্গিতে বারান্দায় বসে ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবছি। অপুকে দেখে ভাল লাগে। টেলিভিশন দেখতে থাকলে বন্ধ করি। বারান্দায় বসে থাকলে হাসিমুখে অপুর দিকে তাকাই। আচমকা হয়তো বলি, তোর নাম অপু কেন, জানিস?
জানি। বাবার ডাকনাম ছিল দিপু তার সঙ্গে মিলিয়ে আমার নাম অপু। মার নাম মিলিয়া, তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে অপুর নাম মিতুয়া।
আপুরটা ঠিক আছে। তোর অপু নামের পেছনে আরেকটা কারণ আছে।
বলো।
বোস বলছি।
কোথায় বসবো?
আমার চেয়ারের হাতলে বোস। ছেলেবেলায় এভাবে তোর বাবা আমার চেয়ারের হাতলে বসতো।
অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার
অপু বসে আর আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তারপর মনে হয় আমি যেন চলে গেছি বহু বহু বছর পিছনে ফেলে আসা এক জীবনে। দিপু তখন অপুর বয়সি। আমরা থাকি ইস্কাটনের একটা বাড়িতে। পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। দোতলায় থাকি আমরা। সামনে চওড়া বারান্দা। ছুটিছাটার দিনে বারান্দায় মায়াকে নিয়ে বসে বিকেলবেলা আমি চা খেতাম। দিপু খুবই দুরন্ত স্বভাবের ছিল। ছটফটে, চঞ্চল। এই এটা করছে, এই ওটা করছে। এক মুহূর্ত কোথাও স্থির নেই। ওই ছটফটে ভঙ্গিতেই খাচ্ছে, স্কুলের পড়া করছে, খেলছে, ছুটোছুটি করছে।
আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কলোনি। মাঠ বাগান আছে। নানান বয়সি ছেলেমেয়ে। দিপুর বয়সিও আছে অনেক। স্কুল থেকে ফিরে, নাকে মুখে কোনও রকমে কিছু গুঁজে ছুটলো কলোনির মাঠে। সন্ধ্যাবেলায় খেলা শেষ করে ফিরলো।
কোনও কোনও ছুটির বিকেলে হঠাৎই ছুটতে ছুটতে এল বাড়িতে। আমি আর মায়া বসে চা খাচ্ছি। মায়ের কাছে ওর কোনও আবদারই নেই। সব আবদার আমার কাছে।
চেয়ারের হাতলে বসে বলল, পাঁচটা টাকা দাও বাবা।
আমার কোনও প্রশ্ন নেই। মায়াকে বললাম, পাঁচটা টাকা দাও ওকে।
মায়ার কিন্তু প্রশ্ন থাকতো। কী করবি পাঁচ টাকা দিয়ে?
চাঁদা দিতে হবে।
কিসের?
ক্রিকেট বল কিনবো। আমাদের বল নষ্ট হয়ে গেছে।
আমি বিরক্ত হয়ে মায়াকে বললাম, এত প্রশ্ন করছো কেন? ছেলে টাকা চেয়েছে, দিয়ে দাও।
মায়া তখনই টাকা এনে দিপুর হাতে দিল। দিপু কি আর দেরি করে! সঙ্গে সঙ্গে দৌড়।
মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সে বিরক্ত।
এই বিরক্তি তার নিত্যনৈমিত্তিক। ছেলের ব্যাপারে আমার এটিচুড সে পছন্দ করতো না। বলতো, বাচ্চারা যা চায় সঙ্গে সঙ্গে তা দিতে হয় না।
কী হয় দিলে?
লোভ বেড়ে যায়। পরে অবস্থা এমন হবে, যখন যা চাইবে না দিলে তুলকালাম করবে। বাচ্চাদের একটু টাইটে রাখা উচিত।
দিপু আমার একমাত্র ছেলে।
তাতে কী? ওকে তো তুমি কিছু বলো না। আমাকেও কিছু বলতে দাও না। যখন যা চাইছে দিচ্ছো।
কেন বলবো, বলো? ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। স্কুলের রেজাল্ট কত ভাল। প্রাইভেট টিউটর লাগে না। স্কুলের পড়া সব নিজে নিজে করে। তেমন পড়েও না। তার পরও কী রেজাল্ট!
এ জন্য কি ছেলেকে শাসন করবে না?
কী শাসন করবো? শাসন করার কী আছে? ও তো খারাপ কিছু করছে না!
সব যে ভাল করছে তাও না। মাঝে মাঝে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে ঝগড়া মারামারি করে। তুমি টের পাও না। আমি পাই।
যেমন?
চারদিন আগে বিলুকে ঘুষি মেরেছে। বিলুর মা এসে বিচার দিয়ে গেছেন। আমি বলার পর দিপু আমার ওপরই রেগে গেল। ও আমাকে বকা দিল কেন? ওকে আমি আরও মারবো।
ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা একটু রাগিই হয়। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো।
মায়া এবার খুবই বিরক্ত। তোমার লাই পেয়ে ছেলেটার যে কী ক্ষতি হবে, তুমি একদিন বুঝবে। তখন আফসোস করে লাভ হবে না।
এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, মায়া ঠিকই বলতো। মা তো! ছেলেকে আমার চেয়ে অনেক ভাল চিনেছিল। দিপুকে একটু শাসন করা উচিত ছিল। তাহলে হয়তো...
অপু বলল, আমার নাম অপু রাখার আর কী কারণ, বলো দাদু।
তোর বাবার খুব গল্প উপন্যাস পড়ার অভ্যাস ছিল।
তা জানি। আমি ছোট ছিলাম, তাও দেখেছি। মনে আছে আমার। তাছাড়া তুমিও অনেকবার বলেছো, মা বলেছে।
‘পথের পাঁচালি’ বইটা ওর খুব পছন্দ ছিল। বিভূতিভূষণের ওই বইটা সে বারবার পড়তো। ওই বইয়ের নায়কের নাম ‘অপু’। অপুকে তার খুব পছন্দ ছিল। ‘পথের পাঁচালি’ সিনেমা করেছেন সত্যজিৎ রায়। সিনেমাটা ভিসিআরে সে প্রায়ই দেখতো।
বুঝলাম।
আর আমার কাছে যখনই কোনও আবদার নিয়ে আসতো, আমি বারান্দার চেয়ারে বসে থাকলে তোর মতো এইভাবে চেয়ারের হাতলে বসতো।
অপু বাচ্চা ছেলে। বাবার আদর পুরোপুরি পাওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়েছে। আমার কথা শুনে উদাস হয় ছেলেটি। আনমনা হয়। একদিকে আমি ডুবে যাই আমার স্মৃতিতে, অপু ডুবে যায় অপুর স্মৃতিতে। গায়ে গা ঘেঁষে বসা দুই বয়সের দুজন মানুষের একজন ডোবে ছেলের স্মৃতিতে আরেকজন বাবার স্মৃতিতে। (চলবে)
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ জানুয়ারি ২০১৬/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন