ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রাত কাটে স্টেডিয়ামের বারান্দায়

কুমারেশ বিশ্বাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৯ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাত কাটে স্টেডিয়ামের বারান্দায়

গুলিস্তানের মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের মাঝের রাস্তায় ঘুমিয়ে আছে ছিন্নমূল মানুষ

কুমারেশ বিশ্বাস : প্রতিদিন শত শত নারী-পুরুষ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকে। বেশিরভাগ মানুষের ঘুমানোর অনুষঙ্গ হিসেবে মাথার নিচে থাকে দুটি স্যান্ডেল আর পত্রিকা। অনেকেই ব্যানার বিছিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। আবার যাদের আয়-রোজগার একটু ভাল তারা মশারি খাটিয়ে ঘুমায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানাসহ ব্যবহৃত কাপড় স্টেডিয়ামের বাইরের সানসেটের ওপর রেখে দেয়। এভাবেই তাদের কেটে যায় বছরের পর বছর।

 

সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাতে রাজধানীর গুলিস্তানের মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের বারান্দাসহ মাঝের রাস্তায় আশ্রয় নেয় এই সব ছিন্নমূল মানুষ। অনেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে। এখানে থাকতে থাকতে অনেকে জীবনসঙ্গীও খুঁজে পেয়েছে। এখানেই সন্তানের জন্ম দিয়েছে। 

 

এ সব ছিন্নমূল মানুষের কেউ কাগজ কুড়ায়, কেউ রিকশা চালায়, কেউ পান-সিগারেট বিক্রি করে, আবার কেউ মাদক ব্যবসায় জড়িত। অনেকে জীবিকার প্রয়োজনে দেহ ব্যবসা করে। এদের একটা অংশ ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত। আছে মাদকসেবীও।

 

সারাদিনের কাজ কর্ম শেষে রাত নয়টার পর থেকে এখানে আশ্রয় নেয়া লোকজন আসতে শুরু করে। অনেকেই নির্ধারিত জায়গায় এসে ঘুমিয়ে পড়ে। আর যাদের জায়গা নির্ধারিত থাকে না তারা ফাঁকা জায়গা পেলে সেখানে ঘুমায়। অনেক সময় ঘুমানোর জায়গা নিয়ে এদের মধ্যে ঝগড়া কিংবা হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।

 

দীর্ঘদিন এক সঙ্গে থাকার ফলে এদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই বন্ধুত্বের খাতিরে এরা সংঘবন্ধ হয়ে অনেক অপরাধমূলক কর্মকা- করে।  রাত ১১টার পর স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল করতে ভয় পায়। কারণ প্রায়ই এলাকার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

 

গভীর রাতে জমে মাদকের জমজমাট আসর। এ সব ছিন্নমূল মানুষের বেশির ভাগ মদ, গাজা ও ইয়াবা সেবন করে। অনেকে সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক নেয়। মাতাল হয়ে অনেকেই অপরাধমূলক কর্মকা- করে। ফলে রাতে এ এলাকা অনিরাপদ হয়ে পড়ে।

 বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের বারান্দায় ঘুমিয়ে আছে ছিন্নমূল মানুষ

 

এ ছাড়া এখানে আশ্রয় নেয়া অনেকেই বেঁচে থাকার তাগিদে দেহ ব্যবসা করে থাকে। এদের সঙ্গে যোগ দেয় ভ্রাম্যমাণ দেহ ব্যবসায়ীরা। অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়। ফলে এইডস, গণরিয়া, সিফিলিসসহ বিভিন্ন যৌন বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। এদের মাধ্যমে এ রোগ অন্যের মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।

 

প্রায় দুই বছরে ধরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পাশে বসবাস করা ফারুক নামে এক ব্যক্তি জানান, তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বসতভিটা ছাড়া কোন জমি ছিল না। চার বছর আগে যমুনার ভাঙ্গনে বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে যায়। তারপর স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। ঢাকায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন। টাকার অভাবে বাসা ভাড়া নিতে পারেননি। রাস্তার পাশে কিংবা ফুটপাতে খুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করেছেন।  দুই বছর হলো এখানে আছেন। সারাদিন শহরে রিকশা চালান। রাতে গ্যারাজে রিকশা রেখে এখানে ঘুমান। তার স্ত্রী খাবারের হোটেলে কাজ করেন।

 

মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের মাঝের রাস্তায় রাত কাটান জাকির। তিনি বলেন, ‘সারাদিন রাস্তায় কাগজ, বোতল, পলিথিন কুড়াই। এই সব জিনিস দোকানে বিক্রি করি। এভাবে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হয়। প্রতিদিন খাওয়া বাবদ ১০০ টাকার মত খরচ হয়। ১৫ দিন পর পর বাবাকে টাকা পাঠাই। বাড়িতে বাবা-মা ও ছোট ভাই থাকে। যখন স্টেডিয়ামে বড় কোন খেলার আয়োজন করা হয় তখন এখানে পুলিশ  থাকতে দেয় না। তখন কষ্ট হয়।’

 

লাকি (ছদ্দনাম) নামে এক তরুণী জানান, তিন বছর আগে গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন পর স্বামী অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করেন। এরপর থেকে তার খোঁজ নেই। স্বামীর খোঁজে গেলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাড়িয়ে দেয়। এরপর বাবার বাড়ি কিছুদিন থাকেন। যেহেতু  বাবা নাই,  ছোট ভাই খারাপ ব্যবহার করতো। ফলে তিনি ঢাকা চলে আসেন। লাকি এখন মানুষের বাসায় কাজ করে। রাতে এখানে এসে ঘুমায়।

 

এই বয়সে এখানে একা থাকতে সমস্যা হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে লাকি বলেন, ‘প্রায় রাতে মানুষ কু-প্রস্তাব দেয়, টাকা দিতে চায়। একটু ম্যানেজ করে চলতে হয়।’



 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ অক্টোবর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়