ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রাতের বেইজিং

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ২৬ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাতের বেইজিং

হোওহাই এর তীরে

(চকবাজার টু চায়না : পর্ব-২৩)

শান্তা মারিয়া : আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে সামগ্রিকভাবে বেইজিং শহরের কোন দিকটা তোমার সবচেয়ে পছন্দ?

আমি উত্তর দেব, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এমন একটি তুখোড় আধুনিক ও ব্যস্ত শহরেও প্রকৃতির শোভা এত অকৃপণ যে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। এই শহরের অসংখ্য পার্কে তো বটেই এমনকি সাধারণ রাজপথেও সবুজ গাছগাছালি ও ফুলের সমারোহ আমাকে বেইজিংয়ের প্রেমে পড়তে বাধ্য করেছে।
বেইজিংয়ের একটি অসাধারণ সুন্দর জায়গা হলো হোওহাই লেক এবং সেই লেকের তীরে দীর্ঘ হাঁটাপথ। হোও হাই সম্পর্কে জানতে পারি ট্রাভেল চায়না পড়ে। তারপর গুগল ম্যাপ দেখে সেখানে হাজির হই গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায়। ব্যস, প্রথম দেখাতেই আমার মন জয় করে নেয় হোও হাই। এরপর সন্ধ্যায়, বিকেলে, সকালে কত রূপেই না এই লেকের তীরভূমি দেখেছি।

বেইজিংয়ে থাকার সময় এই শহরের রাতের জীবন বা নাইটলাইফ সম্পর্কে জানার আগ্রহ হয় আমাদের। চীনারা সাধারণ বিকেল পাঁচটা-ছটার মধ্যে ডিনার সেরে নেয়। তারপর একটু এদিক ওদিক ঘুরে রাত নয়টার মধ্যে ঘুমের রাজ্যে চলে যায়। রাত দশটার পর সাধারণত কোনো চীনার বাড়িতে ফোন করা অভদ্রতা বলে গণ্য। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করত বেইজিংয়ে রাতের জীবন কেমন। ট্রাভেল চায়না জানাল বেইজিং শহরে রাতের বেলা বেড়ানোর জন্য হোওহাই লেক এবং তার তীরের রেস্টুরেন্ট ও বারগুলো খুবই চমৎকার।

মূলত ওদের কথা পরীক্ষা করবার জন্যই একদিন বিকেলে ওখানে গেলাম আমি আর শিহাব। জায়গাটা শহরের প্রাণকেন্দ্রে। ওখানে মূলত তিনটি লেক একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত। সবচেয়ে বড় লেকটির নাম হোওহাই। অন্য দুটির নাম ছিয়ানহাই ও শিহাই।  একসাথে তিনটিকে বলা হয় শিচাহাই। লেক বা বড় জলাশয়কে চীনা ভাষায় হাই বলা হয়।

লেকের বুকে আলোর রাশি আর আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ


গিয়ে দেখি বিশাল লম্বা লেক। এর কাছেই হলো নানলোকুশিয়াং হুথোং। হুথোং মানে গলি। হোওহাই লেক ও নানলোকুশিয়াং হুথোং মিলেই পুরো এলাকা। বিশাল এলাকা। আমাদের ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, কলাবাগান, নিউমার্কেট, কাওরানবাজার মিলে যদি ধরা হয় তাহলে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।

লেকের তীর ধরে হাঁটা পথ। দুই তীরে রেস্টুরেন্ট আর বার। লেকের তীরে গাছপালা রয়েছে। স্থানে স্থানে পাথরের বেদী রয়েছে বসার জন্য। তিব্বতী আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন দোকান ও ঐতিহ্যবাহী চীনাসামগ্রী বিক্রির দোকান রয়েছে। হাইরাইজ কোনো ভবন নেই এখানে। ভবন তোলার অনুমতিও নেই। তাহলে লেকের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। বিভিন্ন রকম লোকজ খেলা বা ম্যাজিক দেখানো হচ্ছে ছোট ছোট জায়গায়। লেকের বুকে ভাসছে নৌকা, প্যাডেলবোট ইত্যাদি।

বিকেলের রোদ মিলিয়ে আসে, অপূর্ব শোভা ছড়িয়ে একসময় টুপ করে ডুব দেয় সুয্যিমামা। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে লেকের বুকে। চারিদিকে ঝলমলে আলো জ্বলে ওঠে। রেস্টুরেন্টগুলোর আলো আর নৌকা ও ছোট্ট বোট থেকে আলোর প্রতিফলন ঘটে লেকের বুকে। এরপর আকাশে ওঠে চাঁদ। তার শোভা অন্য আলো ম্লান করে দেয়।

রাতের রেস্টুরেন্ট


এখানে মূলত বিদেশি লোকের ভিড়। অবশ্য স্থানীয় লোকজনও প্রচুর সংখ্যায় আছেন। বেইজিংয়ে যেসব বিদেশি অনেকদিন ধরে আছেন হয়তো চাকরি, লেখাপড়া বা অন্য কোনো কারণে তাদের অনেকেই এখানে সন্ধ্যা কাটাতে আসেন। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে তো বটেই, পথের পাশেও গানের আয়োজন রয়েছে। চীনা শিল্পীরা গান পরিবেশন করছেন। পাথরের বেদীতে বসে গল্প করছে অনেকে, কেউ বা গান শুনছে। কোথাও আবার কয়েকজন মিলে নাচছে। এখানে অনেক রাত পর্যন্ত লোক সমাগম থাকে।

রেস্টুরেন্টগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চীনা খাবার যেমন হটপট, বেইজিং ডাক, সাপের মাংস, ঝিনুক ও শামুকের ডিশ ইত্যাদি আছে। আছে তিব্বতী, উইগুর ও মোঙ্গোলীয় খাবার। এত লোক, এত তরুণ-তরুণী কিন্তু কোনো অশোভন আচরণ, ইভটিজিং, এমনকি অশালীন ঘনিষ্টতাও চোখে পড়লো না। চারপাশে বার, কিন্তু কোনো মাতালের হৈহল্লা নেই। খুবই নিরাপদ, সুখী একটা পরিবেশ।

একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে ঝাওফেন বা ফ্রাইড রাইস খেয়ে লেকের তীর ধরে হাঁটছিলাম। কখন যে রাত এগারোটা বেজেছে খেয়াল করিনি। মোবাইলে চোখ পড়তে চমকে উঠলাম। সাড়ে এগারোটায় সাবওয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা হোওহাইতে এসেছিলাম থিয়েনআনমেন স্কোয়ারের সামনের সাবওয়ে স্টেশন থেকে। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি নানলোকুশিয়াং স্টেশনের কাছে। আমি প্রস্তাব করলাম তাহলে একটা ব্যাটারি রিকশা ভাড়া করে নানলোকুশিয়াং স্টেশনেই যাই। পাঁচ মিনিটে সেখানে পৌঁছানো গেল বটে, কিন্তু স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। এই স্টেশন ছোট বলে এগারোটায় বন্ধ হয়ে যায়।

মহামুশকিল। শিহাব তো আমার উপর মহা খাপ্পা। বলে, ‘এ জন্যই আমি বলি, যেদিক দিয়ে আসব, সেদিক দিয়েই ফিরব’।

জলের তীরে ভাস্কর্য


কড়া জবাব মুখে এসে গিয়েছিল কিন্তু ভেবে দেখলাম এই সময় তর্ক-বিতর্ক না করে ঝটপট বিকল্প ভাবা ভালো। আরেকটা ব্যাটারি রিকশা নিয়ে আমরা দৌড়ালাম থিয়েনআনমেন স্কোয়ারের স্টেশনের দিকে। বড় রাস্তা বলে স্টেশনের সামনে রিকশা যাওয়া নিষেধ। কাছাকাছি নেমে ত্রিশ ইউয়ান ভাড়া চালকের হাতে দিয়ে দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে কোনোভাবে স্টেশনের তিনতলা সিঁড়ি দিয়ে নেমে প্লাটফর্মে পৌঁছালাম আর সাথে সাথে ঢুকল শেষ ট্রেন। লাফিয়ে ট্রেনে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বেঞ্চে বসে এবার দুজনেই হো হো করে হেসে ফেললাম।

দিনের বেলাও হোওহাইতে গিয়েছি অনেক দিন। দিনের বেলাতেও দারুণ সুন্দর এই লেক। লেকের তীরে তীরে ভাস্কর্য আরও বেশি সুন্দর লাগে ঝলমলে রোদে। লেকের পানিতে অনেক হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। একটা মজার জিনিস দেখলাম। লেকের এক জায়গায় হাঁসের বাড়ি বানানো হয়েছে। বাঁশের তৈরি ছোট ছোট হাঁসের ঘর। তার সঙ্গে ছোট্ট বাগান। দূর থেকে দেখলে মনে হয় ছোট্ট একটি প্রাসাদ।

হোওহাই একসময় হয়ে উঠেছিল আমার বেড়ানোর প্রিয় স্থান। লেকের জলে সূর্যডোবা দেখে কাটিয়েছি অনেকগুলো সন্ধ্যা। সেসব স্বর্ণালী সন্ধ্যার স্মৃতি লুকিয়ে আছে মনের ভিতর।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ নভেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়