ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ইন্দ্রজিৎ সরকারের গল্প || রেললাইনে রক্তের দাগ

ইন্দ্রজিৎ সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ১৯ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইন্দ্রজিৎ সরকারের গল্প || রেললাইনে রক্তের দাগ

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

মর্মান্তিক খবরটি পড়ে আমি রহস্যের গন্ধ পেলাম।

 

‘রহস্যের গন্ধ’ পাওয়ার কথা শুনে মনে হতে পারে আমি পেশাদার কোনো গোয়েন্দা। আসলে তা নয়। আমি খবরের কাগজে কাজ করি। সাদাসিধে ক্রাইম রিপোর্টার। ছোটবেলায় বিস্তর গোয়েন্দা কাহিনি পড়ে অনেকের মতো আমারও গোয়েন্দা হওয়ার শখ জেগেছিল। বাস্তব জীবনের ঘুর্ণিপাকে সেই শখ হারিয়ে যেতেও দেরি হয়নি। তবে হ্যাঁ, পেশাগত কারণে আমাকেও কখনো-সখনো গোয়েন্দার ভূমিকায় নামতে হয়। আর একবার মাঠে নেমে পড়লে নিউজের জন্য যতটা না, তারচে’ বেশি নিজের কৌতূহল মেটাতে ঘটনার নেপথ্যের রহস্য অনুসন্ধান করি। সত্যি বলতে কী, রহস্য উদ্ঘাটন করতে আমার খুবই ভালো লাগে। এটা একই সঙ্গে আমার শখ ও নেশা।

 

আজ আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অভ্যাসবশে সকালে চা খেতে খেতে পত্রিকার পাতা ওল্টাছিলাম। তখনই চোখে পড়ল খবরটি। ভেতরের পাতায় খুব হেলাফেলায় ছাপা হলেও শিরোনামে আমার চোখ আটকে গেল। ‘রেললাইনে কিশোরীর ছিন্নভিন্ন লাশ’। খবরে বলা হয়েছে-শহরতলীর অদূরে একটি নির্জন স্থানের রেললাইনে পরিচয় না জানা এক কিশোরীর রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া গেছে। অসাবধানতায় রেললাইন পার হওয়ার সময় সে ট্রেনে কাটা পড়ে বলে পুলিশের ধারণা। তবে এটি আত্মহত্যা, এমনকি খুন হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। ঘটনাস্থলে তার মাথা পাওয়া যায়নি। ট্রেনে কাটা পড়ার সময় মাথাটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রেললাইনের পাশের জলাশয়ে ছিটকে পড়ে ডুবে যায় বলে অনুমান করা হচ্ছে। আবার রাতের অন্ধকারে ঘটনার পর শেয়াল-কুকুরও খণ্ডিত মুন্ডু টেনে নিয়ে যেতে পারে।

 

এমন ঘটনা যে একেবারেই ঘটে না তা নয়। কিন্তু আমাকে কৌতূহলী করে তুলল কিশোরীর নিখোঁজ কাটা মুন্ডুটি। রিপোর্টার পুলিশের বরাত দিয়ে যা বলেছে, অর্থাৎ জলাশয়ে ডুবে যাওয়া বা কুকুর-শেয়ালে টেনে নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি বলেই আমার মনে হচ্ছে। এখনও স্পষ্ট কোনো কারণ না থাকলেও ক্রাইম রিপোর্টারের সন্দিগ্ধ মন বলছে, এটি দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

 

ঘটনাস্থল মানে যেখানে লাশটা পাওয়া গেছে তা খুব বেশি দূরে নয়। হাতেও তেমন কোনো কাজ ছিল না। তাই একবার জায়গাটা ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। চটপট রেডি হয়ে বেরুলাম। শহরতলীর বাসস্ট্যান্ডে নামার পর কিছুটা পথ যেতে হলো রিকশায়। তারপরও প্রায় ১০ মিনিট হাঁটতে হলো রেললাইনে পৌঁছাতে। বেশ ফাঁকা জায়গা। কাছাকাছি কোনো বাড়িঘর নেই। রেললাইনের দু’পাশের সরকারি জমিতে নিজের গরজে বেড়ে উঠেছে কিছু লতা-গুল্মের ঝোঁপ। মাঝে মাঝে কিছু ডোবার মতো জলাশয়ও আছে। বোধহয় রেললাইন তৈরির সময় উঁচু করার জন্য ওখান থেকে মাটি কাটা হয়েছিল। স্থানীয় এক লোকের সহায়তা নিয়ে সহজেই পৌঁছলাম রেললাইনের নির্দিষ্ট স্থানটিতে। লাশ তো গতকালই উদ্ধার করেছে পুলিশ। এখন তেমন কোনো আলামতও পড়ে নেই। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। তারপরও সরেজমিন ঘটনাস্থল দেখা আমার অভ্যাস।

 

রেললাইনের পাতে লেগে থাকা শুকিয়ে কালচে হয়ে যাওয়া রক্তের দাগ চোখে পড়ল। চারপাশে নজর বুলিয়ে আর তেমন কিছু পেলাম না। ফিরব ভাবছি, এমন সময় দেখলাম রেললাইনের পাশের নিচু জমিতে জন্মানো লতা-গুল্মের ঝোঁপের একটি অংশ যেন দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। খটকা লাগায় এগিয়ে গেলাম। দেখি ছোট ছোট গাছগুলোর ডাল-পাতা ভাঙ্গা। ভালো করে দেখে বুঝলাম, জঙ্গলের ভেতরের দিকে এক বা একাধিক লোক বসেছিল। জায়গাটা এমন যে ওখানে বসে থাকলে জঙ্গলের কারণে চারপাশ থেকে বোঝা যাবে না। একটি খালি পানির বোতল, চুইংগামের মোড়ক ও কয়েকটি সিগারেটের টুকরোও পড়ে থাকতে দেখলাম। কাজে লাগতে পারে ভেবে সাবধানে তুলে রাখলাম ব্যাগে।

 

ফেরার পথে গেলাম জিআরপি থানায়। রেললাইনে কিছু ঘটলে রেলপথ পুলিশ বা জিআরপি তার তদন্ত করে। জিআরপির ওসি আবদুল মজিদ আমার বেশ পরিচিত। আমাকে দেখে বললেন, ‘কী সাংবাদিক সাহেব, আজ আবার কী নিউজ?’

আমি হেসে বললাম, ‘কেন আমরা তো একসঙ্গে চা খেতে খেতে কিছু সময় গল্পও করতে পারি!’

ওসি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘একশ বার।’

আমি কপট উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললাম, ‘না-না, তাই বলে একসাথে একশ বার চা খাওয়া সম্ভব নাকি? একবারই খেয়ে যাই। বাকি ৯৯ বার পাওনা থাক।’

 

ওসি এবার হো হো করে হেসে উঠলেন। চা আর চানাচুর আনতে বললেন তার সহকারীকে। আমিও এই সুযোগে কাজের কথা পাড়লাম-‘কিশোরীর মৃত্যুরহস্য তদন্তের কী অবস্থা?’

তিনি জানালেন- ‘ঘটনার প্যাঁচ কিছু খুলেছে। মেয়েটির খণ্ডিত মাথা রেললাইনের পাশের খাল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মেয়েটির পরিচয়ও জানা গেছে। তার নাম রূপালী, বাড়ি চাপাদহ গ্রামে। মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকত। লাশ উদ্ধারের আগের দিন দুপুর থেকে তার খোঁজ মিলছিল না। পরে তার ভাই মর্গে গিয়ে লাশটি শনাক্ত করেন। লাশ দেখে তো উনি বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন। একটাই বোন ছিল তো। নিখোঁজের দিন সকালে নাকি কী কারণে বোনকে বকুনি দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। বারবার তাই বলছিলেন, তার কারণেই রূপালীর আজ এমন দশা। মনে তো হচ্ছে অভিমান করে আত্মহত্যা।’

 

চা খেতে খেতে ওসির মুখে ঘটনা শুনলাম। তারপর বললাম, ‘আমিও আজ গিয়েছিলাম রেললাইনের ওই জায়গাটায়। পাশেই কিছু সন্দেহজনক জিনিসপত্র পেলাম। তারমধ্যে একটি বোতলও আছে। দেখুন তো এর মধ্যে কারো ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায় কিনা।’ বলে বোতলটি তাকে বের করে দিলাম। আর নোটবুকে লিখে নিলাম মেয়েটির বাড়ির ঠিকানা।

 

২.

আমার গন্তব্য চাপাদহ গ্রাম। রূপালীর ভাই রুবেলের সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। আমার বারবার মনে হচ্ছে, কোথায় যেন একটু ফাঁক থেকে যাচ্ছে। জায়গাটা ঘটনাস্থল থেকে পুরো বিপরীত দিকে। প্রায় দুই ঘণ্টা লাগল পৌঁছতে। গ্রামের বাড়ির উঠোনে খেলতে থাকা এক দল শিশুকে ডেকে জানতে চাইলাম, রূপালীদের বাড়ি কোনদিকে? তাদের মধ্যে এক কিশোর নিজেই আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। হেঁটে যেতে যেতে জানতে চাইলাম, রূপালীর ঘটনাটি সে জানে কিনা। হঠাৎ দেখি সে গম্ভীর হয়ে গেল। একটু পর বলল, ‘রূপালী মরেই ভালো হয়েছে।’

 

আমি তো তাজ্জব! জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমন কথা বলছ কেন?’ সে জানাল, রূপালী তার বন্ধু ছিল। তাই মেয়েটির কষ্ট তারও সহ্য হচ্ছিল না। পাঁচ-ছয় বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সৎ ভাই আর সৎ মা রূপালীকে খুব মারধর করতো। ঠিকমতো খেতেও দিত না। মেয়েটি মাঝেমধ্যেই বন্ধুদের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করতো।

রূপালীদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ছেলেটি বিদায় নিল। গ্রামের ভেতর এমন আলীশান বাড়ি সচরাচর দেখা যায় না। রূপালীর বাবা অবশ্য বেশ টাকা-পয়সাওয়ালা লোক ছিলেন বলেই শুনেছি। রূপালীর সৎভাই রুবেল বাড়িতেই ছিলেন। আমি সাংবাদিক শুনে খাতির করে ঘরে নিয়ে বসালেন। কান্নাভেজা গলায় বললেন, ‘কী আর কমু ভাই, ওরে এত আদর করতাম; কহনও ওরে সৎবোন মনে করি নাই। আপনেই কন, বড়ভাই হিসেবে বোনরে শাসন করার অধিকার তো আমার আছে। তাই বইল্যা কি ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে হইব? আমি মাইন্যা নিতে পারতেছি না এমন একটা ঘটনা।’

আমি বললাম, ‘তা তো বটেই। খুবই দুঃখজনক ঘটনা।’

একটু পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেদিন রূপালী কখন বাড়ি থেকে বের হয়েছিল?’

‘ঘড়ি তো ওইভাবে দেখা হয় নাই। তয় অনুমান বিকাল পাঁচটার দিকে।’

‘হুম। আপনি তখন কোথায় ছিলেন?’

‘আমি তহন বাড়ির কাছেই আছিলাম। জমিজমার কাজ করতেছিলাম। সেইখান থিকা সন্ধ্যায় বাসায় ফির‌্যা শুনি রূপালী বাড়িত নাই।’

‘ওর খোঁজ করেননি?’

‘করি নাই আবার। তহনই আশপাশের বাড়ি, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, অর বন্ধু-বান্ধবগো বাড়িত খোঁজ নিছি। কিন্তু ওই রাইতে আর কোনো খোঁজ পাই নাই। পরেরদিন শুনলাম রেললাইন থিকা নাকি একটা মেয়ের লাশ উদ্ধার হইছে। সন্দেহ হইল। মর্গে গিয়া দেখি, সেইডা যে আমারই বইন...।’

 

ভদ্রলোক কথা শেষ করতে পারলেন না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ফেরার জন্য উঠলাম। তার আগে আমার সাদা কাগজের মলাট লাগানো ডায়েরিটা দিলাম রুবেলের হাতে। তিনি দুই হাতে ডায়েরিটা ধরে বললেন,‘এটা দিয়ে কী করব?’

‘আপনার মোবাইল ফোন নম্বরটা লিখে দেন। দরকার হলে ফোন করব।’ বললাম আমি।

রুবেল ডায়েরির একটা সাদা পৃষ্ঠায় ফোন নম্বর লিখে সেটা আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। ঘর থেকে বেরুনোর আগ মুহূর্তে দেখলাম টেবিলের ওপর একটা সিগারেটের প্যাকেট। একটু চমকে উঠলাম। কারণ এই ব্রান্ডের সিগারেটের টুকরোই রেললাইনের পাশের জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।

 

৩.

জিআরপির ওসি আবদুল মজিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি নিশ্চিত? শুধু সন্দেহের বশে কাউকে গ্রেফতার করা কিন্তু ঠিক হবে না।’

আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম, ‘আমি তো বটেই, একটু পর আপনিও নিশ্চিত হবেন। আর তা নাহলে কাউকে গ্রেফতার করবেন না।’

‘ঠিক আছে।’ গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে-হাঁটতে উত্তর দিলেন ওসি। রূপালী মারা যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর আমরা ফের তার বাড়িতে যাচ্ছি। আমার তথ্য-প্রমান বলছে, দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা নয়, রূপালীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। অবশ্য প্রথম দিনই আমার এমন সন্দেহ হয়েছিল। গত কয়েকদিনে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল আর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তা এখন মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারপরই ওসি সাহেবকে রাজি করিয়ে রওনা হয়েছি।

 

রূপালীর ভাই রুবেলকে আগেই আমাদের আসার খবর দেওয়া হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছে, রূপালীর মৃত্যু সংক্রান্ত মামলার কাজে তার একটু সহায়তা লাগবে। যথারীতি আমাদের খাতির করে ঘরে নিয়ে বসালেন তিনি। একটু পরই লেবু ও চিনি দিয়ে তৈরি ঠান্ডা শরবতও এল। তবে আমরা কেউই তা খেলাম না। এরই মধ্যে উপস্থিত হলেন চাপাদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোতা খান ও তার দুই সহযোগী। আমিই তাদের আসতে বলেছিলাম। এরপর যা ঘটবে, তার জন্য দু’একজন বাড়তি লোক থাকলে ভালো হয়।

আমি হঠাৎ বেশ জোরে প্রশ্ন করলাম, ‘রুবেল, আপনি কেন এমন একটা কাজ করলেন?’

রুবেল যেন কিছুই বুঝতে পারেননি। বললেন, ‘মানে...কোন কাজ? কিছুই তো বুঝলাম না ভাইজান।’

চেয়ারম্যান সাহেবও মাথামুন্ডু বুঝতে পারছেন না। শুধু ওসিই নির্বিকার। তাকে আমি আগেই অনেকটা বলেছি। কিছুটা বাকি রেখেছি সবার সামনে বলব বলে।

 

আমি ঘরে উপস্থিত সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে রুবেলের ওপর দৃষ্টি ফিরিয়ে বললাম, ‘উত্তরটা না দিলেও সমস্যা নেই। কিন্তু সৎ বোন হলেও রূপালী তো আপনার বোনই ছিল। তাকে এভাবে হত্যা করতে আপনার একটুও বাধল না?’

‘স্যার, আপনি এসব কি কইতেছেন? আমি কেন ওরে মারতে যামু?’ রুবেল হঠাৎ ভাই ছেড়ে স্যার সম্বোধন শুরু করলেন।

‘ও, তাহলে আপনি এমনিতে স্বীকার করবেন না? ঠিক আছে, আমিই তাহলে গল্পটা বলি। ভুল হলে আপনি শুধরে দেবেন। ঘটনার দিন অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর বিকেলে আপনি শহর থেকে জামা কিনে দেওয়ার কথা বলে রূপালীকে নিয়ে বাসা থেকে বের হন। শহরে গিয়ে পৌঁছান সন্ধ্যায়। একটি রেস্তোরাঁয় দু’জনে নাশতা করেন। এ সময় আপনি কৌশলে রূপালীর খাবারে ঘুমের ওষুধের গুঁড়ো মিশিয়ে দেন। রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার পরপরই রূপালীর ঘুম পায়। আপনি একটি রিকশায় করে তাকে নিয়ে শহরতলীর দিকে যান। এরপর অন্ধকার নির্জন রাস্তায় বোনকে কাঁধে তুলে রেললাইনের কাছের জঙ্গল পর্যন্ত নিয়ে যান। ট্রেন আসার কিছু আগে রূপালীর অচেতন দেহ লাইনের ওপর শুইয়ে রাখেন। একটু পরই দ্রুতগামী ট্রেনে কাটা পড়ে করুণ মৃত্যু হয় মেয়েটির। তখন আপনি রেললাইনের পাশের ঝোঁপে লুকিয়েছিলেন। ট্রেন চলে যাওয়ার পর আপনি লাইনে উঠে দেখেন রূপালীর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তখন আপনার মাথায় আরেকটি বুদ্ধি খেলা করে। কাটা মাথাটি আপনি পাশের খালে ফেলে দেন, যাতে লাশটি সহজে কেউ শনাক্ত করতে না পারে।’

 

‘সব মিথ্যা কথা। আমি ক্যান আমার বইনরে মারমু।’ দুর্বল কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন রুবেল।

আমি বললাম, ‘কেন মেরেছেন সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে যা বললাম তার প্রমান দেই।’

এতক্ষণে কথা বললেন চেয়ারম্যান তোতা খান, ‘হ্যাঁ সেইটাই ভালো। বিষয়টা তো কেমন গোলমাল ঠেকতেছে।’

‘বেশ।’ আমি ফের রুবেলের দিকে তাকালাম। ‘আপনি আমাকে বলেছিলেন, রূপালী মারা যাওয়ার দিন আপনি গ্রামেই ছিলেন। বিকেলে বাসায় ফিরে তার খোঁজ করেন। কিন্তু আপনার মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে দেখা গেছে, বিকেল ৫টার পরই আপনি গ্রাম ছেড়ে চলে যান। সন্ধ্যায় শহরের নতুন বাজার মোড় এলাকায় ছিলেন। সেখানকার একটি রেস্তোরাঁর ম্যানেজার আপনার ও রূপালীর বর্ণনা শুনে জানান, আপনারা সেখানে খেয়েছেন। এমনকি রূপালী ট্রেনে কাটা পরার আগে ও পরে অনেকটা সময় আপনি ঘটনাস্থলের আশেপাশেই ছিলেন। এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্যই সেদিন আমি আপনার ফোন নম্বর নিয়েছিলাম। ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা আপনার ফোনের অবস্থান নির্ণয় করে এই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে সহায়তা করেছেন।’

 

‘মিথ্যা কথা। সব মিথ্যা কথা।’ ফের প্রতিবাদ করলেন রুবেল। তবে কণ্ঠ এবার আরও দুর্বল।

‘অপেক্ষা করুন। এখনও সবটা শেষ হয়নি।’ এবার ওসির দিকে ফিরলাম আমি। ‘রেললাইনের পাশের জঙ্গলে যে জায়গাটায় রুবেল বসেছিলেন সেখানে একটি পানির বোতল পাওয়া যায়। ওই বোতলে কারো হাতের ছাপ পাওয়া যায় কিনা তা পরীক্ষার জন্য আমি আপানাকে দিয়েছিলাম। পরে দিয়েছি আরও একটি সাদা কাগজ। ওই কাগজটি দিয়ে আসলে আমার ডায়েরি মোড়ানো ছিল। সেদিন আমি ফোন নম্বর লিখে দেওয়ার কথা বলে কৌশলে ওই কাগজে রুবেলের হাতের ছাপ সংগ্রহ করি। বাকিটুকু আপনি জানেন-কাগজ ও বোতলের গায়ে একই ব্যক্তির হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। রূপালীর মরদেহ থেকে সংগ্রহ করা নমুনার ভিসেরা পরীক্ষায় মিলেছে ‘বেনজোডায়াজিপিন ডেরিভেটিভ’ নামে রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি। অর্থাৎ মৃত্যুর আগে তাকে প্রচুর পরিমাণ উচ্চ মাত্রার ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। সেই জঙ্গলে আমি কয়েকটি সিগারেটের টুকরোও পেয়েছিলাম। পরে এই বাসায় এসে দেখি রুবেল সেই ব্রান্ডের সিগারেট খান। এ বিষয়টিও আমার সন্দেহের সূত্রগুলোকে মেলাতে সহায়তা করেছে। আর আমাকে রূপালীর ব্যাপারে তথ্য দিয়ে অনেক সহায়তা করেছে ওর বন্ধুরা।’

 

আমার বর্ণনার এ পর্যায়ে রুবেল দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। তাকে আটকাতে পিছু নেন চেয়ারম্যানের দুই সহযোগী। আমি নির্বিকারভাবে বললাম, ‘উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। এমন ঘটতে পারে তা আমি আগেই অনুমান করেছিলাম। এজন্য ওসি সাহেবকে বলে বাড়ির সামনে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে পাহারায় রেখেছি।’

আমার কথা শেষ না হতেই পুলিশ সদস্যরা রুবেলকে ধরে ফের ঘরে নিয়ে এলেন। ততক্ষণে রুবেলের ঘরের বাইরে আরও অনেক মানুষের ভিড় জমে গেছে। এবার চেয়ারম্যান সাহেব মুখ খুললেন, ‘আপনার যুক্তি-প্রমান শুইনা আমি খুবই মুগ্ধ হইছি। আপনের তো সাংবাদিক না হইয়া গোয়েন্দা হওন উচিৎ আছিল।’

 

ওসি বললেন, ‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু এই হত্যার মোটিভ কি?’

‘খুবই সরল হিসাব। সৎ বোন না থাকলে বাবার বিশাল সম্পত্তির পুরোটাই পাবেন রুবেল। নাকি আরও কোনো কারণ ছিল?’ রুবেলের কাছে জানতে চাইলাম।

‘না স্যার। আসলে আমার মাথায় শয়তান ভর করছিল। বাবা যা রাইখা গেছে, আমি বইসা খাইলেও ফুরাইত না।’ কাঁদতে শুরু করলেন রুবেল।

‘ওয়েল ডান, সাংবাদিক সাহেব। আমরা তো বিষয়টাকে এত জটিল ভাবিইনি।’ বললেন ওসি আবদুল মজিদ। ‘কিন্তু আপনার সন্দেহ হলো কেন, বলুন তো?’

‘আমার সন্দেহপ্রবণ মন তো আছেই, তবে আমাকে পথ দেখিয়েছে পুরনো একটি কেস স্টাডি।’ আমি ব্যাখ্যা করলাম। ‘১৯৬০ সালের ডিসেম্বর ও পরের বছরের মার্চে পাকিস্তানের লারকানা রেলস্টেশনের কাছে ট্রেনে কাটা দু’টি লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনার তদন্তে বের হয়ে এসেছিল এক চতুর খুনির ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের  বৃত্তান্ত। সেদিন খবরের কাগজে রূপালীর মত্যুর খবর পড়ে আমার কেন যেন সেই ঘটনাটি মনে পড়ে যায়। আর আমিও মাঠে নেমে পড়ি। যেখানে দেখিবে ছাই...!’

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ অক্টোবর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়