ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিশ্বসেরা

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:৩২, ২৮ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিশ্বসেরা

শাহ মতিন টিপু : ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। এবার বাঘ দিবসের প্রতিপাদ্য- Save Big Cats from Extinction. বাংলাদেশে দিবসটির গুরুত্ব সুন্দরবনকে ঘিরে। কারণ, সুন্দরবনেই রয়েছে বাংলাদেশের অহংকার- জাতীয় প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিখ্যাত এবং বাঘের প্রজাতি হিসেবে বিশ্বসেরা।

 

ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় যে সুদর্শন বাঘ দেখা যায় তা পৃথিবীব্যাপী রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামে পরিচিত। বেঙ্গল টাইগারের মতো সুন্দর ও ক্ষীপ্রগতির বাঘ পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। হলদে ডোরাকাটা রং এই বাঘকে অন্যসব প্রজাতির বাঘ থেকে করেছে আলাদা ও অনন্য। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নানা অঘটনে পড়ে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে।

 

২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গ শহরে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব বাঘ সম্মেলন। এই সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এখনো বাঘ টিকে আছে এমন ১৩টি দেশে ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাঘ টিকে থাকা ১৩টি দেশ হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও রাশিয়া।

 

এই দিবসটির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বাঘ সংরক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করা এবং বাঘ সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস।

 

বলা হয়, পৃথিবীতে যত বাঘ আছে, তার প্রায় অর্ধেক হচ্ছে বেঙ্গল টাইগার। আর আকারের দিক থেকে সবচেয়ে বড় হচ্ছে সাইবেরিয়ান বাঘ। সাইবেরিয়ান বাঘ আকারে প্রায় ১০.৭৫ ফুট (৩.৩ মিটার) লম্বা হয়ে থাকে। এদের ওজন প্রায় ৩০০ কেজির মতো। অপরদিকে বেঙ্গল টাইগার আকারে প্রায় ৭-৯ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। এদের ওজন হয় প্রায় ১৫০-২২৭ কেজি। বন্য অবস্থায় একটি বাঘ সাধারণত ৮ থেকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। ১৮ মাস বয়সের আগে সাধারণত বাঘ শিকার করতে পারে না। বাঘ সম্পর্কে আরেকটি মজার তথ্য  হলো- এদের গর্জন প্রায় ৩ কিলোমিটার দূর থেকেও শুনতে পাওয়া যায়।

 

শিকারি হিসেবে বাঘ একটি অসাধারণ প্রাণী। এরা নিশাচর এবং খুবই শক্তিশালী শিকারি। বাঘ সাধারণত ছদ্মবেশে শিকার করে। এদের চামড়ার রং এবং গঠন ছদ্মবেশ ধারনে যথেষ্ট সহায়ক। শিকারের সময় এরা যে প্রাণীটিকে তাদের শিকার বানাতে চায়, খুব সাবধানে এবং প্রায় নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে যায়। পরে স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিয়ে শিকারের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। মোট কথা, এরা শিকারকে কোনো সুযোগই দেয় না। শিকারের জন্য বাঘ মাইলের পর মাইল বিচরণ করতে পারে। শিকার হিসেবে এরা প্রধানত হরিণ এবং বন্য শুয়োরকে প্রাধান্য দেয়। একটি ক্ষুধার্ত বাঘ এক রাতে প্রায় ৬০ পাউন্ড (২৭ কেজি) মাংস সাবাড় করে দিতে পারে। যদিও বাঘ সাধারণত একবারে খুব বেশি আহার করে না।

 

বাঘ সম্পর্কে আরেকটি মজার তথ্য হচ্ছে- খুব কম সংখ্যক বাঘই মানুষখেকো। একটি বাঘ মানুষখেকো হয় তখনই, যখন সেটি অসুস্থ হয়ে যায় এবং শিকার করার মতো শক্তি আর অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি যখন কোনো এলাকায় শিকারের সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল হয়ে যায়, তখনই বাঘ খাবারের প্রয়োজনে মানুষকে আক্রমণ করে। তবে সাধারণত বাঘ মানুষকে এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে।

 

একসময় পৃথিবীতে আট প্রজাতির বাঘের দেখা মিলত। কিন্তু, বিংশ শতাব্দিতে এসে মাত্র পাঁচ প্রজাতির বাঘ দেখা যায়। বাকি তিনটি প্রজাতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে। গত একশ বছরে চোরাশিকারি এবং আবাস ধ্বংসের কারণে বাঘের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ থেকে মাত্র ৩-৪ হাজারে নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতি বাঘের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। বাকি পাঁচটি প্রজাতিও আজ খুব বেশি সুখে নেই।

 

বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে বাঘ বাঁচাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও সুন্দরবনে বাঘ নিধন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ৩৫ বছরে (১৯৮০ থেকে ২০১৫) সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় শিকারিদের হানা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৮৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। প্রজনন বৃদ্ধি ও সঠিকভাবে বাঘ সংরক্ষণের জন্য সরকারিভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

 

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে সুন্দরবনে ৫২টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে স্থানীয় লোকজন পিটিয়ে ২৪টি এবং চোরাশিকারিরা কৌশলে ১৭টি বাঘ হত্যা করে। ১১টি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়।

 

২০০৪ সালে পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ৪৪০টি বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় ৮৯টি পুরুষ ও ১৭০টি স্ত্রী বাঘ এবং ১২টি বাচ্চা বাঘ রয়েছে। এ ছাড়া বাগেরহাটের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় ৩২টি পুরুষ ও ১২৮টি স্ত্রী বাঘ এবং ৯টি বাচ্চা বাঘের অবস্থান জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে এবার ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে গণনায় বাঘের সংখ্যা ১০৬ টিতে দাঁড়িয়েছে।

 

সুন্দরবন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ৩৩টি এবং ২০০১ থেকে ২০১১ সালের জুলাই পর্যন্ত ১১ বছরে ৩২টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। অপর বড় একটি কারণ হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, কোরিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি ও গৃহসজ্জায় বাঘের চামড়া ও অস্থির অতিরিক্ত চাহিদার ফলে বাঘের পাচারও দিন দিন বেড়ে চলেছে।

 

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ২০০৪ সাল থেকে বাঘশুমারি পরিচালিত হয়। ২০০৪ সালে পায়ের ছাপ নিয়ে তৈরি করা শুমারি অনুযায়ী, ৬০০০ বর্গ কিলোমিটারের সুন্দরবনের ৪৪০ টি বাঘ রয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়। ৪৪০টি বাঘের মধ্যে পুরুষ ১২১টি, স্ত্রী ২৯৮টি এবং ২১টি শাবক রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগে ২৭১টি এবং পূর্ব বন বিভাগে ১৬৯টি বাঘ রয়েছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪০০০ বাঘ আছে বলে ধারণা করা হয়।

 

ম্যানগ্রোভ এই বনাঞ্চলে বাঘের সঠিক সংখ্যা জানতে ২০১৩ সালে ক্যামেরা পদ্ধতিতে বাঘ গণনা জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। মাঝে বিরতি দিয়ে ২০১৪ সালের নভেম্বরে আবার শুরু হয়ে চলতি বছরের মার্চ মাসে জরিপ শেষ হয়।

 

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন বাংলাদেশের অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল এই সুন্দরবনকে জালের মতো ঘিরে রেখেছে। এখানে এক সময়ে  ৪৫০-৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিচরণ করত।

 

 

প্রাণী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা সুন্দরবনে বাঘের পরিমাণ কমার জন্য নয়টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। কারণগুলো হচ্ছে- প্রাকৃতিক দুর্যোগ (ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস), লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া, মিঠাপানির অভাব, খাদ্য সংকট, বন ধ্বংস, বাঘের আবাসস্থল ধ্বংস ও শিকার করা।

 

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অতীতে সনাতন পদ্ধতিতে যে জরিপ করা হয়েছিল তা যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ও আন্তর্জাতিক মানের ছিল না। বাঘের সংখ্যা কমে যায়নি। বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও বাঘ গণনা জরিপের প্রধান জাহিদুল কবীর বলেন, ‘সনাতন পদ্ধতিতে বাঘের পায়ের ছাপ এবং গতিবিধির ওপর ভিত্তি করে অতীতের জরিপের মাধ্যমে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব ছিল না। ফলে ক্যামেরায় ছবি তুলে, খালে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে ও তার গতিবিধির অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ ব্যাখ্যা করে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা গেছে।’

 

বন বিভাগের জরিপ দল সুন্দরবনে ৩৮টি পূর্ণবয়স্ক ও চারটি বাঘের বাচ্চার ছবি তুলতে পেরেছে। এর মধ্যে ৩৮টি বাঘের শতকরা ৩০ ভাগ পুরুষ। জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ মিলে সুন্দরবনে মোট বাঘের সংখ্যা ১৭০টি। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র বাগেরহাটের কটকা, কচিখালী ও সুপতি, সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জ, দোবেকি ও কৈখালী এবং খুলনার নীলকমল, পাটকোষ্টা ও গেওয়াখালী। এর মধ্যে বাগেরহাটে ১৭টি, সাতক্ষীরায় ১৩টি ও খুলনায় আটটি বাঘের ছবি ধারন করা হয়েছে।

 

বাঘ আমাদের দেশের একটি অমূল্য সম্পদ। কিন্তু, আজ এই সম্পদ ধীরে ধীরে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন থেকে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেলে সুন্দরবন তার একটি মূল্যবান অলংকার হারাবে। সেই সঙ্গে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ব্যাহত হবে। বাঘ রক্ষার জন্য, তথা সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকেও সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে চোরাচালান রোধে এবং বাঘের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

বাঘ (Panthera tigris) বিশাল বিড়াল পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। প্যানথেরা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত চারটি বৃহৎ বিড়ালের মধ্যে এটি একটি। বাঘ বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় প্রাণী। পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক এলাকায় একে দেখা যায়। ‘অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট’ চ্যানেলের সমীক্ষা অনুযায়ী বাঘ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাণী।

 

বাংলাদেশে বাঘ বলতে আমরা প্রধানত সুন্দরবনের ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’কেই বুঝি। আর এই বাঘ দিন দিন দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে।

 

জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৮৭ সালে অতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে বাঘ কিংবা বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাঘ বাঁচাতে নানা উদ্যোগ নিলেও সুন্দরবনে বাঘের মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গিয়েছে।

 

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারত ভূখণ্ডে অবস্থিত। সুন্দরবন শুধু নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বন অভ্যন্তরে রয়েছে গাছপালা, পশুপাখি, জীবজন্তু, সরীসৃপসহ অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার। নির্বিচারে বন উজাড়ের ফলে বাঘের আবাসস্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারণে বাঘের বংশবৃদ্ধি ঘটছে না। অপরদিকে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও চোরাশিকারিদের হাতে পাচার ও নিধনের ফলে ক্রমান্নয়ে হ্রাস পাচ্ছে এ প্রাণী।

 

বাঘ রক্ষায় সরকার ইতিমধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যায় সর্বোচ শাস্তি ১২ বছরের কারাদণ্ড ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মানুষ নিহত হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১ লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান করলেও ঠেকানো যাচ্ছে না চোরাশিকারিদের বন্যপ্রাণী হত্যা। মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সিমান্তের আন্তর্জাতিক চোর বাজার ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে’ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়ার চড়া মূল্য থাকায় চোরাশিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ।

 

স্থানীয় সূত্র কথিত আছে, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলোয় একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি দল রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল, মংলা, মোরেলগঞ্জ, পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়।

 

বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে, গুলি করে বাঘ হত্যা করে। বাঘ শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে বাঘের চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে তা পাচারকারী চক্রের সাহায্যে বিদেশে পাচার করে। স্থানীয়ভাবে একটি চামড়ার জন্য শিকারিরা ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশের চোরা বাজারে একটি বাঘের চামড়া ১০ লাখ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা গেছে।

 

সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করা ‘সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’ চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘এতদিন আমরা সুন্দরবনে আশঙ্কাজনক হারে বাঘ শিকার বাড়ছে বলে জানালেও বন বিভাগ তাতে গুরুত্ব দেয়নি। সর্বশেষ সুন্দরবনে জরিপে বাঘের সংখ্যা কমে আসার প্রমাণ মিলেছে।’

 

এই বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে বাঘের প্রকৃত আবাস বলতে বোঝায় বাংলাদেশের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনকে। সুন্দরবনে বর্তমানে উজানে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবনের পরিমান বেড়েই চলেছে। মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেল ছাড়াও সুন্দরবনের মধ্যদিয়ে বর্তমানে ভারতে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা ও সাতক্ষীরার পশ্চিম সুন্দরবনের আন্টিহারা দিয়ে দুটি নৌপ্রটোকল রুট চালু থাকায় এই ম্যানগ্রোভ বনটি কার্যত চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। চোরাশিকারিদের তৎপরতা বৃদ্ধি, জাহাজ ও কার্গোর হর্নসহ ভেসেলগুলোর বিকট শব্দ, একের পর এক কার্গোডুবিতে সুন্দরবন দূষণ, উষ্ণতা বৃদ্ধি, আশঙ্কাজনক হারে মানুষের উপস্থিতি, লবন পানির আধিক্য, বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় কারণে এখন করুণ অবস্থা সুন্দরবনের প্রকৃত পাহারাদার রয়েল বেঙ্গল টাইগারের।

 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনে মানুষের অবাধ বিচরণ, বন-উজাড়, বাঘের আবাসস্থল সংকটসহ নানা কারণে বাঘের প্রজনন প্রাকৃতিক পরিবেশ হারাচ্ছে। বাঘের স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এসব কারণে বাঘের সংখ্যা কমে আসছে।’

 

তার মতে, বাঘ বনের যেখানে থাকতে পছন্দ করে সেখানে বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করতে হবে। কয়েকটি এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করতে হবে। সঠিকভাবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট থাকতে হবে। এ ছাড়া মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। তাহলেই বাঘের বংশবৃদ্ধি সম্ভব।’

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুলাই ২০১৫/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়