ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

আসুন, সাঁওতালদের সব কেড়ে নেই

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ১৫ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আসুন, সাঁওতালদের সব কেড়ে নেই

শাহেদ হোসেন : বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, উপকারীর ঘাড়ে লাথি। বাংলা সাহিত্যে প্রবাদ-প্রবচনগুলো মানুষের পরিবেশ, প্রতিবেশ, সামাজিক বন্ধন সবকিছুর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। কথ্য ভাষায় অবশ্য প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহার এখন অনেক কমে এসেছে। তবে প্রবাদ-প্রবচন যেসব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাড়তে শুরু করেছে। সবই হয়তো যুগের হাওয়া।

 

একটা সময় ছিল, কেউ কারো উপকার করলে, সারা জীবন তার গুণকীর্তণ করা হতো। এমনও দেখা গেছে, উপকারীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তো গ্রামব্যাপী। আবার অনেক সময় উপকারী ব্যক্তিকে নিজের সম্পত্তিও লিখে দিয়েছেন মহৎ হৃদয়ের মানুষ। তবে সেই মাহত্ব ঘুচেছে বেশ কিছুকাল আগেই। এখন বাঙালির জীবনে  ‘উপকারীর ঘাড়ে লাথি’ বেশি বাস্তব হয়ে উঠেছে।

 

লিখতে চাচ্ছিলাম সাঁওতালদের নিয়ে। শান্ত, নির্বিবাদী, সরলমনা সাঁওতালদের নিয়ে আমরা যা করছি তাতে উপকারীর ঘাড়ে লাথি নয় বরং উপকারীকে হত্যাই করা হচ্ছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় জয়পুর ও মাদারপুর গ্রামের সাঁওতালদের প্রথমে রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। আর এখন সাঁওতালরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন প্রশাসনের। সত্যি, বিচিত্র এ দেশ, আর বিচিত্র আমাদের মানসিকতা! নিজ ভূমে আমরা সাঁওতালদের পরবাসী করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। যে রাজনৈতিক নেতারা সাঁওতালদের মাথায় হাত বুলিয়ে স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন, তাদের কাছে এই মানুষগুলো ধর্ণা দিতে যাননি। বরঞ্চ গায়ে পড়ে তারাই গিয়েছিলেন সাঁওতাল পল্লীতে।

 

যে জমি নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু, সেই জমি সাঁওতালদের কাছে ১৯৬২ সালে রংপুর চিনিকলের জন্য আখ চাষের শর্তে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। চাষ না করা হলে জমি ফেরতের ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছিল সে সময়। শুরুতে চাষ হলেও দীর্ঘদিন ধরে এ জমিতে আর আখ চাষ হয়নি। এমনকি ওই জমিতে ১২টি পুকুর খনন করে মাছ চাষও করা হতো। মিল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রভাবশালীরা এ জমি লিজ নিয়ে অন্য ফসলের আবাদ করছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এ জমির মালিকানা দাবি করতে শুরু করেন সাঁওতালরা। দুই বছর আগে পূর্বপুরুষের জমি ফেরত পেতে আন্দোলন নামেন তারা। এতে গায়ে পড়েই শামিল হয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা প্রথমেই জমি দখলে নিতে উসকানি দিতে থাকেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ইক্ষু খামারের প্রায় ১০০ একর জমি দখলে নিয়ে সাঁওতালরা ঘর নির্মাণ করেন। তাদের এ কাজে সহযোগিতা করেন সাপমারা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শাকিল আখন্দ বুলবুল। নির্বাচনের আগে তিনি সাঁওতালদের বাপ-দাদার জমি উদ্ধারে সহযোগিতার কথা বলে ভূমি উদ্ধার কমিটির সভাপতি হয়ে তাদের সমর্থন নেন। শুধু তাই নয়, এই ইস্যুকে ব্যবহার করে নির্বাচনের খরচের টাকাও নেন তাদের কাছ থেকে।

 

এরপর যেন বাংলা সিনেমার রাজনীতিবিদদের গল্প। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর বুলবুল চিনিকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাত মেলান। শুধু তাই নয়, সাঁওতালদের অভিযোগ, গত সপ্তাহে সংঘর্ষের সময় বুলবুল র‌্যাব-বিজিবি ও পুলিশের সঙ্গেই ছিলেন। সংঘর্ষের ঘটনায় চার সাঁওতাল পুরুষ নিহত হলেও তাদের পাশে দাঁড়াননি কেউ। উপরন্তু মামলা দিয়ে হয়রাণি করা হচ্ছে তাদের। পুলিশের ভয়ে অনেক সাঁওতাল পুরুষ এখন গ্রামছাড়া। সংঘর্ষে গুলিতে আহত তিন সাঁওতালকে কোমরে দড়ি বেঁধে ও হাতকড়া পরিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আদালতকে সেই দড়ি খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিতে হলো।

 

উপকারের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাই সাঁওতালদের উপকারের বর্ণনা না দিলে আমরা কাদের ঘাড়ে লাথি মারছি সেটা বোঝা যাবে না। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ বেনিয়া ও তাদের এদেশীয় দোসর জমিদার, মহাজনদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত হয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন সাঁওতালরা। ১৮৫৫ সালে সিধু-কানুর ডাকে সাড়া দিয়ে ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’ শ্লোগান তুলেছিলেন ১০ হাজার সাঁওতাল। তাদের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ব্রিটিশরা কঠোর হস্তে দমনের সিদ্ধান্ত নিলে শেষ পর্যন্ত বন্দুক-কামানের বিরুদ্ধে স্রেফ তীর-বল্লম নিয়ে লড়াই করেছেন সাঁওতালরা। ইংরেজদের হামলায় নিহত হয় বহু সাঁওতাল। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংরেজ সেনারা সিধুকে তার গোপন আস্তানা থেকে গ্রেফতার করে সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলে । পরের সপ্তাহে বীরভূমের জামতারা থেকে পুলিশ কানুকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। 

 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সাঁওতালদের ভূমিকার কথা আমরা ভুলে গেছি। ওই সময় জীবনের নিরাপত্তার খাতিরে বাংলাদেশে থেকে পালাতে হয়েছিল ৩০ হাজার সাঁওতালকে। ভারতের শরণার্থী শিবিরে মুক্তিযুদ্ধে অংগ্রহণের জন্য আদিবাসীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন সাঁওতাল নেতা সাগরাম মাঝি। তিনশর বেশি সাঁওতাল তরুণ প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। রাজশাহীর সাঁওতাল নেতা বিশ্বনাথ টুডু ছিলেন একজন প্লাটুন কমান্ডার। বাংলাদেশের মানচিত্রটির জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন সম সরেন, চাম্পাই সরেনরা । পাকিস্তানি হানাদারদের লালসার শিকার হয়েছেন নারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা-বাগানের বাসিন্দা হীরামনি সাঁওতাল। বীরাঙ্গনা খেতাব পেয়েছেন অনেক পরে। যুদ্ধের পর হীরামনির ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানটির কারণে সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখতো। সেই সন্তানটি যখন বড় হয়ে উঠলো তার সমবয়সীরা তাকে পাঞ্জাবির ছেলে বলে টিটকারি করতো। একসময় তার নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মে । বুকের ভেতরে সেই জমানো আগুন নেভাতে মদে বুদ হয়ে থাকতেন সহদেব। শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত মদপানে মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। হীরামনির স্বামী লক্ষণ সাঁওতাল এর কিছুদিন পরেই মারা যায়। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর আগে ভিক্ষাও করতে হয়েছে হীরা মনিকে।

 

আমরা সাঁওতালদের অবদানের কথা ভুলে গেছি। নিজের স্বার্থের জন্য তাদেরকে যাচ্ছেতাই ভাবে ব্যবহার করছি। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সেই সাঁওতালদের মাঝে সোমবার ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। অভিমানী সাঁওতালরা সেই ত্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, প্রশাসন একমুখে দুই কথা বলছে। তারা একদিকে ত্রাণ দিতে চাইছে, অন্যদিকে তারকাঁটার বেড়া দিয়ে জমি নষ্ট করছে।

 

আমার মনে হয়, এমন দ্বিমুখী আচরণের কোনো প্রয়োজন নেই। আসুন আমরা সাঁওতালদের দেশ থেকে বের করে দেই। তাদের চোখের জল আর রক্তে ভেজা জমিটুকু আমরা দখল করে নেই। আমরাও পাকবাহিনীর মতো নির্লজ্জ হানাদার বনে যাই।

 

লেখক: সাংবাদিক।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ নভেম্বর ২০১৬/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়