ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘না খেয়ে টাকা জমিয়ে পড়ার জন্য বই কিনি’

মাকসুদুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘না খেয়ে টাকা জমিয়ে পড়ার জন্য বই কিনি’

মাজেদুল হক মুন্না

মাকসুদুর রহমান : ‘নিজের কোনো উপার্জনের ব্যবস্থা না থাকায় সব সময় কষ্টের মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে। অনেক সময় না খেয়েও থাকতে হয়। না খেয়ে টাকা জমিয়ে পড়ার জন্য বই কিনি। উপোষ থাকলেও কাউকে লজ্জায় কিছু বলতে পারি না।’ - কথাগুলো বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মুন্না।

 

পুরো নাম মাজেদুল হক মুন্না। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে। বাবা মো. মশিউর রহমান পেশায় মাদ্রাসার ইবতেদায়ি শাখার শিক্ষক। মা আফরোজা বেগম গৃহিনী। পরিবারে তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে সবার বড় মুন্না। একমাত্র বোন পড়ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছোট দুই জমজ ভাই এইবার এস.এস.সি পরিক্ষার্থী।

 

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত আসতে মুন্নাকে করতে হয়েছে কঠিন লড়াই। অন্য সব ছেলেদের মতো মুন্নারও ছিল সুন্দর স্বাভাবিক শৈশবকাল। হাসি, খুশি আর আনন্দেই কাটতো ভাই বোনদের দিন। এভাবেই এগোতে পারতো মুন্নার জীবন। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দেয় ৮/৯ বছর বয়স থেকেই। তার চোখের দৃষ্টি কমে আসতে শুরু করে। ডাক্তারের মতে, মুন্নার চোখের শিরা উপশিরাগুলো খুবই ছোট যার ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের পাতাগুলো বাড়তে পারেনি। সেই কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণও হতো।

 

বাবার সামর্থ্য না থাকার কারণে ভালো করে চিকিৎসাও করাতে পারেননি। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপনের মুন্না হয়ে যায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। সেই থেকেই শুরু হয় মুন্নার সংগ্রামী জীবন। বড় ছেলের এই অবস্থায় পরিবারে নেমে আসে শোকের মাতম। মশিউর রহমান দম্পতি হয়তো আশা করেছিলেন বড় হয়ে ছেলে একদিন পরিবারের ভরন পোষণের দায়িত্ব নেবে কিন্তু সেটা আর মুন্নার হয়ে উঠেনি।

 

এক সময় বন্ধ হতে বসেছিল মুন্নার শিক্ষা জীবন। আশেপাশে কোনো ব্রেইল পদ্ধতির বিদ্যালয় না থাকায় পড়ালেখা করার জন্য তাকে যেতে হয় নড়াইলে। সেখানকার তুলারামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৪.৮০ নিয়ে ২০১০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এইখানেই সে প্রথম ব্রেইল পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়। ২০১২ সালে নড়াইল আশার আলো মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পাশাপাশি সাইট সেভার এর সহায়তায় কম্পিউটার শিখেন।

 

নড়াইলের জীবন সম্পর্কে মুন্না বলেন, ‘নড়াইলে বাবা-মা ছাড়া কিশোর বয়স, তার ওপর সম্পূর্ন নতুন জায়গা এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, মনে হয়েছিল আমার আর পড়ালেখা করা হবে না। সব কিছু কেমন যেন অন্ধকার মনে হচ্ছিল। একা একা বসে বসে কাঁদতাম আর নিজেকে নিজেই বলতাম আমাকে পড়তেই হবে। বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এমনকি বহু শিক্ষক আমার ওপর বিরক্ত হয়ে বকা দিতেন। কিছু না বুঝলে বলতেন তোমাকে কি আমরা আলাদা করে বোঝাতে পারবো নাকি। অন্যদের সঙ্গে যা বুঝতে পার তাই বুঝ।’

‘অনেক সময় বলতো যে, তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না, তুমি বেশি দূর পড়াশুনা করতে পারবে না। কিন্তু আমি হতাশ হইনি। বার বার ব্যর্থ হয়েছি আবার সেখান থেকে ভালো করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি এবং আমি এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি।’

 

বর্তমানে পড়ালেখা করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে মুন্না বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বইগুলো ব্রেইল পদ্ধতিতে পাওয়া না যাওয়ার কারণে পড়তে অনেক কষ্ট হচ্ছে এবং বইগুলোর অডিও রেকর্ড ও তেমন পাওয়া যায় না, যা আমাদের উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের খরচ চালাতে তাকে প্রচুর বেগ পেতে হচ্ছে। সীমিত আয়ের পিতার পক্ষে বেশি টাকা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাই ইচ্ছা থাকলেও মুন্নার পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের জন্য খাবারটা ফ্রি করে দেয় তাহলে আমাদের জন্য ভালো হয়। বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা থাকলেও কাজের বেলায় তাদের দেখা যায় না।’

 

এ প্রসংগে মুন্না খুব আক্ষেপ করে বলেন, ‘এনজিওগুলো আমাদের নিয়ে রীতিমতো ব্যবসা করছে। তারা শুধু তাদের বিভিন্ন দিবস উপলক্ষকে কেন্দ্র করে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে কিছু মানুষকে দেখানো ছাড়া তাদের আর কিছুই দেখি না।’

 

পড়াশোনার পাশাপাশি মুন্না ভালো আবৃতি এবং গান গাইতে পারে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে মুন্না জানান, ‘আমাদের ভবিষ্যত অত্যন্ত অন্ধকারে আচ্ছন্ন। তবুও আমি আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে ভালো একটা চাকরি করে বাবা-মার দুঃখ ঘোচাব এবং সব সময় দেশের উন্নয়নের সেবায় ব্রত থাকব।’

 

সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এই মুন্নাদের এগিয়ে যেতে হলে তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আশেপাশের মানুষগুলোর সহায়তা। জীবন সংগ্রামকে জয় করে এগিয়ে চলুক তাদের সাফল্যের যাত্রা।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ডিসেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়