ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

লিবিয়ায় ২৬ দিন অন্ধকার কক্ষে ছিল সুমন

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লিবিয়ায় ২৬ দিন অন্ধকার কক্ষে ছিল সুমন

মানবপাচাকারী চক্রের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া সুমন (বাঁ থেকে প্রথম)।

আহমদ নূর : অন্ধকার একটা কক্ষে আমরা ২৫ জনের মত ছিলাম। সবাই বাংলাদেশি। সেখানে ২৬ দিন বন্দি ছিলাম আমি। জায়গাটা যেন একটা নরক। ঠিক মতো খাবার দেওয়া হতো না। কথায় কথায় শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। বলা হতো- বাড়ি থেকে টাকা না দিতে পারলে বিক্রি করে দেওয়া হবে।

কথাগুলো বলছিলেন লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের হাতে বন্দিদশা থেকে মুক্ত বাংলাদেশি মো. সুমন। র‌্যাবের সহায়তায় বুধবার দিবাগত রাতে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে একটি ফ্লাইটে তিনি ঢাকায় আসেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন দালাল চক্রের ১৫ সদস্য।

বিদেশ যাত্রার শুরুর দিনগুলো স্মরণ করে সুমন বলেন, ‘গত বছরের শেষ দিকে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সেলিমুজ্জামান নামের এক দালালের কাছে পাসপোর্ট দেই। বিদেশ যাওয়া বাবদ তাকে আমি এক লাখ টাকাও দেই। গত ১৪ ডিসেম্বর আমার ফ্লাইট দেওয়া হয়। আমার মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা থাকলেও আমাকে পাঠানো হয় ইন্দোনেশিয়ায়। সেখান থেকে আমাকে লিবিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’

লিবিয়া পাঠানোর পরের অভিজ্ঞতা সর্ম্পকে জানতে চাইলে সুমন বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার পর আমি সেখানে এক এজেন্টের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমার মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা কিন্তু এখানে কেন। জবাবে তারা আমাকে জানায়, ইন্দোনেশিয়া থেকে মালয়েশিয়া পাঠানো হবে। কিন্তু ওই দিনগত রাতেই নৌকা দিয়ে আমাকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে শহীদ, জহির, নোমান, রাসেল ও জাহাঙ্গীর নামের কয়েকজনকে দেখতে পাই। নৌকা থেকে নামার পর তারা আমাকে সরাসরি একটি বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে একটি ছোট অন্ধকার রুমেই আমি বন্দি ছিলাম। সেই অন্ধকার রুমে আগে থেকেই ২৪ জনের মতো ছিল।

সেই অন্ধকার রুমে অন্য বন্দিদের কাছে জানতে পারি, এখানে সবাই এই দালালের দ্বারা প্রতারিত। সবার কাছে মুক্তিপণ হিসেবে টাকা চাওয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে আমার কাছেও দালালরা মুক্তিপণ দাবি করে। এই দালাল চক্র মূলত আমাদের জিম্মি করে ব্যবসা করার পায়তারা করেছিল।’

এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করার সময় সুমনের গলার স্বর কান্নায় ভিজে ওঠে। চাপা কন্ঠে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি প্রথমদিকে বাড়িতে যোগাযোগ করতে চাইনি। কিন্তু বাড়িতে টাকা না চাইলে আমাকে মারধর করা হতো। পেটে, বুকে লাথি মারত। কয়েকদিনের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অবশেষে আমি বাড়িতে ফোনে যোগাযোগ করি। আমার অবস্থা জানার পর বাড়ি থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু তারা আমার কাছে আরো চার লাখ টাকা চাইতে থাকে। টাকা না দিলে আমাকে বিক্রি করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।’ সুমন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘সেখানে মানুষের কোন মূল্যই নেই।’ 

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুমন আরো বলেন, ‘এরপর র‌্যাবের সহায়তায় যা হয়েছে, তার সবই স্বপ্নের মতো।’

র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, ২ জানুয়ারি টিকাটুলি র‌্যাব-৩ এর অফিসে অভিযোগ করেন সুমনের স্ত্রীর বড়ভাই নূরুল ইসলাম। অভিযোগের ভিত্তিতে গত ৭ জানুয়ারি মানব পাচারকারী ও জিম্মি চক্রের মূল হোতা সেলিমুজ্জামান (৪১), শহিদুল ইসলাম (৪৭), মাসুম আহমেদকে (৩৬) বারিধারার মোস্তফা হোটেল অ্যান্ড রেষ্টুরেন্ট থেকে আটক করে র‌্যাব-৩। পরে র‌্যাব, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, প্রবাসী বাঙালি ও লিবিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সুমনকে বুধবার দিবাগত রাতে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

সূত্র জানায়, সেলিমুজ্জামানের তথ্যের ভিত্তিতে পরে র‌্যাব রাজধানীর এয়ারপোর্ট এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মানবপাচারকারী চক্রের  আরো ১১ জন সদস্যকে আটক করে। তারা হলেন- আনোয়ারুল আজিম (৩৮), আল আমিন (৪০), আমির হোসেন (৫৭), কাওছার উদ্দীন (৩৯), রাশেদ খান (৩৯), রায়হান খান (৩০), সাইফুল ইসলাম (৩৩), জাহিদ হোসেন (৩৪), এ এস এম মাহমুদুল হাসান (৩৮), মো. জসিম উদ্দীন (৩২) এবং রাসেল খান (৩২)। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট, বিভিন্ন দেশের জাল ভিসা, অবৈধ ভিসা তৈরির সামগ্রী এবং বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রাসহ ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৩ টাকা জব্দ করা হয়।

র‌্যাব ৩-এর পরিচালক লে. কর্ণেল খন্দকার গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘জনশক্তি রপ্তানির জন্য চক্রটির বৈধ কোন লাইসেন্স নেই। দীর্ঘদিন ধরে চক্রটি অবৈধভাবে বিমান, স্থল ও নৌপথের মাধ্যমে ভারত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন, আমেরিকা, ইতালি, কানাডা, বলিভিয়া, মোজাম্বিক, নিউজিল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশে মানবপাচার করছে। তারা লোকাল এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা থেকে বিদেশ গমনেচ্ছুদের ঢাকায় নিয়ে আসতো। পরে সুযোগ বুঝে তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।’

গোলাম সারোয়ার আরো বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়া সেলিমুজ্জামানের তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব জানতে পারে মালয়েশিয়ায় অপহরণকারী চক্রের মূল হোতা আবদুল হালিম নামের একজন বাঙালি। তিনি রাজধানীর উত্তর বাড্ডার ময়নাবাগের ৩০৯ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। সেই বাড়িতে আমরা অভিযান চালিয়ে তার স্ত্রী শাহিদা বেগমকে (৩২) আটক করেছি। এ সময় তার কাছ থেকে নগদ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা, সিমসহ দুটো মোবাইল ফোন, ২ হাজার ৪৯৮ মার্কিন ডলার, ১৪ লাখ ৩১ হাজার ইন্দোনেশিয়ান রুপি, ১৩ হাজার ৭০০ শ্রীলঙ্কান মুদ্রাসহ মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের মুদ্রা পাওয়া গেছে। এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ ১১টি পাসপোর্ট, বিভিন্ন দেশের প্রায় দু’হাজার ভিসা কার্ড এবং ১৪০টি বিদেশি সিম পাওয়া গেছে।’

যেভাবে বিদেশ গমনেচ্ছুকদের সংগ্রহ করা হতো
গোলাম সারোয়ার জানান, প্রথমে লোকাল এজেন্টরা ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা কমিশনের বিনিময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের টার্গেট করে। পরে তাদের বোঝায় যে বিদেশে গেলে বেশি টাকা আয় করতে পারবে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকে এই ডাকে সাড়া দেয়। বিশেষ করে ভাগ্য বদলের আশায় মধ্যপ্রাচ্যে নারীদের যাওয়ার আগ্রহ বেশি থাকে।

যদি কেউ বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে তাকে বিদেশে যাওয়া বাবদ পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ এবং টিকিট কেনার কথা বলে তার কাছে কিস্তিতে টাকা নেওয়া হতো। অনেক সময় লোকাল এজেন্টরা এসব টাকা নিজের প্রয়োজনে খরচ করে ফেলতো। ফলে বিদেশ গমনেচ্ছুকদের দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে পড়তে হত।

শিক্ষক থেকে মানবপাচারকারী
র‌্যাব সূত্র জানায়, চক্রের মূল হোতা মো. সেলিমুজ্জামানের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি সপরিবারে গাজীপুরে থাকতেন। তার বাবার নাম আব্দুল ওয়াদুদ। সেলিম প্রাথমিক জীবনে গাজীপুরে একটি স্কুলের ইংরেজী বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। এ জন্য তাকে এলাকায় সেলিম মাস্টার বলে ডাকা হত। পরবর্তী সময়ে বেশি টাকা রোজগারের আশায় তিনি বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ প্রতিষ্ঠান ‘স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি’ গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে তিনি শিক্ষার্থীদের মালয়েশিয়া পাঠানোর নাম করে কৌশলে লিবিয়ায় পাঠিয়ে দিতেন। সেখানে তাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করা হত। তার এই কাজে সহযোগিতা করতেন মো. রাশেদ খান, এস এম মাহমুদুল হাসান এবং বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতা কর্মী রাসেল খান।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জানুয়ারি ২০১৭/নূর/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়