ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

লেখক যখন আর লিখতে পারেন না

অহ নওরোজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২০, ৩ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লেখক যখন আর লিখতে পারেন না

হুমায়ূন আহমেদ

অহ নওরোজ: ১৯৫৪ সালে ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’  উপন্যাসের জন্য আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৫৮ সালে এই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন মার্কিন পরিচালক জন স্টারগেজ। বলা হয়ে থাকে আমেরিকান লিটারেচার একাই কয়েক যুগ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন হেমিংওয়ে। তার দীর্ঘ লেখক জীবনে সব চেয়ে পীড়াদায়ক সময় কেটেছে যখন তিনি রাইটার্স ব্লকে ভুগতেন। এটি এড়াতে হেমিংওয়ে বিভিন্ন মজার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। একটি পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি একবার লিখেছিলেন: ‘মাঝে মাঝে এমন হতো, নতুন গল্প শুরু করে আর এগুতে পারতাম না। আগুনের সামনে বসে কমলা ছিলতাম আর কমলার খোসাতে চাপ দিতাম। মৃদু আওয়াজ হতো আর আগুনের আলোতে নীল হয়ে উঠত ছোট ফোটাগুলি। আমি দাঁড়াতাম আর আকাশে তাকিয়ে ভাবতাম- চিন্তা করো না, তুমি এর আগেও অনেক লিখেছ এবং এখনো লিখবে। তোমার যা করতে হবে তা হচ্ছে শুধু একটা সত্য বাক্য লেখা। তোমার জানা সব চেয়ে সত্য বাক্যটি লেখ। এভাবে আমি একটা সত্য বাক্য লিখতাম এবং সেখান থেকে গল্প এগিয়ে চলত। এটা ছিল খুবই সহজ কারণ সব সময়ই আমার কাছে একটা সত্য বাক্য থাকত।’

শুধু আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নন,  রাইটার্স ব্লকে ভুগেছিলেন জন স্টেইন বেক, মার্ক টোয়েন, মায়া অ্যাঞ্জেলোর মতো পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত লেখক। জানা যায় পৃথিবীর অধিকাংশ লেখকের জীবনেই কমবেশি এমন ঘটনা ঘটে যখন তারা অনেক চেষ্টা করেও আর লিখতে পারেন না। খাতা-কলম হাতে নিয়ে তারা শুধু ভাবতে থাকেন, কিন্তু যা লিখতে চান, তা লিখতে পারেন না। এর পরিণতি অনেক সময় মারাত্মক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। অনেক লেখক আত্মবিশ্বাস হারিয়েছেন। অনেকে বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যের পাঠকপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বহুবার নাকাল হয়েছেন রাইটার্স ব্লকে। এ থেকে তিনি বেরিয়েও এসেছেন। কাজটি কিন্তু সহজ নয় মোটেও। চলুন জানা যাক এ থেকে পরিত্রাণের উপায়। তার আগে এ সম্পর্কে আরেকটু জানিয়ে রাখি। রাইটার্স ব্লক হলো এমন এক অবস্থা যেটি সাধারণত লেখালেখির সঙ্গে প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট। এই অবস্থা ধীরে ধীরে লেখকের সৃজনশীলতা নষ্ট করে দেয়। এই অবস্থা এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে এক বছর পর্যন্ত চলতে পারে। ওই সময়ে লেখক নতুন কিছু ভাবতে পারলেও লিখতে পারেন না। এ জন্য এই সমস্যাটির নাম দেওয়া হয়েছে রাইটার্স ব্লক।

কিছু কারণে রাইটার্স ব্লক হতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটি মূলত অনুপ্রেরণার অভাব এবং সৃজনশীল কাজ ছাড়া অন্য কাজে মনঃসংযোগ করার ফলে বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থায় হতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল তার ‘কিপ দি এস্পিডিস্ট্রা ফ্লাইং’ উপন্যাসে একটি চরিত্র দাঁড় করিয়েছিলেন। যেখানে দেখানো হয় এক কবি সত্য ঘটনা নিয়ে একটি মহাকাব্য লেখা শুরু করেছেন। কাব্যের এক জায়গায় লন্ডন শহরের একটি দিনের বর্ণনা আছে। কিন্তু সে কিছুতেই বহুদিন ঘুরেও তার কবিতায় শহরের বর্ণনা আনতে পারেননি। উপন্যাসের এই কবি রাইটার্স ব্লকে ভুগছিলেন। যে কারণে তিনি মহাকাব্যটি শেষ করতে পারেননি। জর্জ এখানে একটু ঘটা করে কাল্পনিক উদাহরণ দেখিয়ে লেখকদের এই সমস্যা পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন।

অনুপ্রেরণা ছাড়াও শারীরিক অসুস্থতা, বিষন্নতা,  ব্যক্তিজীবনে অর্থনৈতিক চাপ,  লেখক জীবনে ব্যর্থতার চিন্তা প্রবল হওয়া এবং কর্মজীবনের বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি রাইটার্স ব্লকের কারণ হতে পারে। এ সময় লেখকদের অনিদ্রা দেখা দিতে পারে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে। এমনকি তারা অসংলগ্ন কাজও করে ফেলতে পারেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাইটার্স ব্লক নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে এবং চিকিৎসকরা রাইটার্স ব্লক এড়ানোর কিছু উপায় বলেছেন। যেমন-
ফ্রি রাইটিং: আপনি যদি ব্লকে পড়েন তা হলে খাতা-কলম নিয়ে মুক্তভাবে লিখতে শুরু করুন। যা মনে আসে লিখতে থাকুন। যতি চিহ্ন উপেক্ষা করুন, অবাধে লিখুন। লিখতে বসে অন্তত পনেরো মিনিট একটানা লিখবেন। এভাবে লিখলে আশা করা যায় এক সময় ধীরে ধীরে আপনি পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবেন।

ব্যায়াম: নৃত্য,  যোগাভ্যাস, মেডিটেশন এবং দীর্ঘ ও গভীর নিঃশ্বাস নিরুদ্বেগ মনকে আরো খোলা এবং আরো কল্পনাপ্রবণ হতে সাহায্য করে। সুতরাং এগুলো চর্চা করে দেখতে পারেন।
 
বিক্ষিপ্ততা নির্মূল: মন যাতে বিক্ষিপ্ত না হয় সে চেষ্টা করুন। ফোন বন্ধ করুন এবং ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকুন। আড্ডা দিতে পারেন, তবে সব সময় নয়। নিজের জন্য কিছু সময় রাখুন।

খুব সকালে লিখুন: ঘুম থেকে ওঠার পর লিখতে বসুন অর্থাৎ যখন আপনি ‘থিডা মুডে’ থাকবেন। থিডা মুড হলো কাল্পনিক ও বাস্তব জগতের মিশ্রণ। ঘুম থেকে উঠবার পর কিছুক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মন স্বপ্নাবিষ্ট থাকে। এ সময়ের লেখা কার্যকরী হতে পারে।

তন্দ্রার মধ্যে লেখা: অবচেতন মন ব্লকের সমস্যা সমাধান করতে পারে। ঘুমঘুম ভাবের মধ্যে যখন থাকবেন তখন যা মনে আসবে তাই লিখবেন। এটি রাইটার্স ব্লক থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম।

এ ছাড়া ভ্রমণ বেশ কাজে দেবে। তবে শুধু লেখক, সাহিত্যিকগণ এই সমস্যায় পড়েছেন তা নয়, ব্লক হতে পারে চিত্রশিল্পীরও। আমেরিকার বিখ্যাত কার্টুনিস্ট চার্লস এম জুল্ক যার ডাকনাম ছিল ‘স্পার্কি’  তিনিও ভুগেছেন এই সমস্যায়। সুতরাং বলা যায়, সৃজনশীল মানুষের এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। পরিকল্পনা করে রাইটার্স ব্লক এড়ানো যায়। ফিরে যাওয়া যায় আগের অবস্থায়।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ অক্টোবর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়