ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শিশু অধিকার : আইন ভূরি ভূরি, নেই বাস্তবায়ন

শাহিনুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১২ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিশু অধিকার : আইন ভূরি ভূরি, নেই বাস্তবায়ন

শাহিনুর রহমান : রিপার (ছদ্মনাম) বয়স এখন সতেরো থেকে আঠারো বছর। অভাব-অনটন ছিল তাদের সংসারে। তাই প্রতিবেশী অবস্থাসম্পন্ন দূরসম্পর্কীয় চাচার বাড়িতে থালাবাসন মাজার কাজ নিয়েছিল। তখন বয়স ৭ কিংবা ৮ বছর। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল সে। একসময় সে বুঝতে পারে তার ওপর নজর পড়েছে বাড়িওয়ালার ছেলে শাপলার। একসময় শাপলার হাতে ধর্ষণের শিকার হতে হয় রিপাকে।

এ ঘটনা জানতে পেরে রিপাকে তার মা শাসিয়ে বলেছিলেন, ‘এই কথা যেন কাকপক্ষীও না জানে।’ একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে ঘটনা জানাজানি হলে শাপলার বাবা তাকে দ্রুত ছেলে দেখে বিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। পরিস্থিতিতে পড়ে রিপাও ১৩ বছরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে। ১৬ বছরে তার ঘরে আসে দু-দুটি সন্তান; একটি হয় বিকলাঙ্গ।

শুধু রিপা নয়, গোপনে এই অমানবিকতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শহর থেকে গ্রাম, অলি-গলির হাজারো শিশু। এমনই আরেকজন যশোরের খাদিজা (১৪)। দারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্ট অসহায় বাবা-মাকে একটু স্বস্তি দিতে রাজধানীর ফার্মগেটের একটি বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতে এসেছিল বছর খানেক আগে। বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে মুখ বুজে তাকে সহ্য করতে হয়েছে গৃহকর্তার যৌননির্যাতন। আর প্লেট ভাঙার অপরাধে নীরবে মারধরের পাশাপাশি গরম খুন্তির ছ্যাঁকা সইতে হয়েছে সাতক্ষীরা থেকে ৯ বছর বয়সে রাজধানীতে আসা ফাতেমার।
 
রিপা, খাদিজা ও ফাতেমার মতো জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে না হলেও অনেকের জীবন তাদের মতো। আছে তাদের চেয়েও অনেক বেশি হতভাগা। গৃহকর্তার বাড়ি থেকে যাদের গলিত মৃতদেহ উদ্ধারের খবর আসে। সেদিন কবে আসবে- যেদিন দেখব না, শুনব না, লিখব না আর এই খবর।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মেয়েশিশু নির্যাতনের পাশাপাশি বেড়েছে ছেলেশিশু নির্যাতনও। শিশু অধিকার আইনের প্রয়োগ ও সামাজিকভাবে শিশুদের সুরক্ষা দিতে না পারায় সিলেটে রাজন, বরগুনায় রবিউল ও খুলনায় রাকিবকে নির্মম নির্যাতন শিকার হয়ে মরতে হয়েছে। সব মিলে মনে হচ্ছে, নিস্তেজ হয়ে পড়েছে আমাদের কানের পর্দা; কিছুই ঠাহর হচ্ছে না। হাওয়াতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে রাকিবদের বেঁচে থাকার আকুতি। মিডিয়ায় চলছে শুধু রাজন-রাজন, রাকিব-রাকিব চিৎকার। কাঁচামালের মতো দিন ফুরালেই শেষ হয়ে যাচ্ছে সেই চিৎকার, আর্তনাদ ও প্রতিবাদের ধ্বনি। সব অন্তরালে চলে যাচ্ছে।

আমাদের দেশের, এমনকি বলতে গেলে বিশ্ব মিডিয়ার এক আজব চরিত্র আছে। কোনো একটি মর্মান্তিক বিষয় ঘটলে একই ধরনের আরো খবর হু হু করে আসতে থাকে। ইভ টিজিংয়ের কথা নিশ্চয় মনে আছে। আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, সারা দেশে ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে বেশ কিছু তরুণী আত্মহত্যা করল। কয়েক মাস আগে দেশে ব্যাংক ডাকাতির হিড়িক পড়ে গিয়েছিল, মিডিয়া তা ফলাও করে প্রকাশ করেছে। গত মাস থেকে কয়েকটি মর্মান্তিক শিশুহত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হলো- এসব ঘটনার কি কোনো মৌসুম আছে? যেমন এখন নরপশুদের হাতে শিশুহত্যার মৌসুম! নাকি আমরা চরম সত্যটি এড়িয়ে শুধু গা বাঁচিয়ে যাচ্ছি।

একজন মানুষ চাই, যিনি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন দেশে আর ইভ টিজিং হচ্ছে না। পথেঘাটে, স্কুল-কলেজে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে। ওরাও তো শিশু। কিন্তু খবর কোথায়? নেই। শিশু নির্যাতন বন্ধে গণমাধ্যমের এই চরিত্র বদলাতে হবে। সামাজিক সমস্যাগুলোর ওপর নিয়মিত ফলো আপ থাকলে জনসচেতনতায় মিডিয়া অন্তত কিছুটা দায়মুক্ত হতে পারে। মানবিক মূল্যবোধ তৈরিতে ‘অসীম ক্ষমতার অধিকারী’ গণমাধ্যমের নৈতিক দায়িত্ব আছে।

দুঃখের বিষয় হলো- শিশুহত্যার এসব বর্বর ঘটনায় মামলা হলেও আসামিদের সাজা পাওয়ার উদাহরণ খুব কম। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের আসামিরা। দারিদ্র্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই মামলার বাদীরা নির্যাতনকারীদের সঙ্গে গোপন রফা করে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার কারণেও পার পেয়ে যাচ্ছে অনেক আসামি। তাই শিশু নির্যাতন ও শিশুশ্রম বন্ধে সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের তরফে মিডিয়ায় বারবার আওয়াজ উঠলেও তার বাস্তব প্রতিফলন কতটুকু ঘটছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আজ রাকিব যদি মোটর গ্যারেজে কাজ না নিয়ে পড়াশোনা করত; তবে তাকে হয়তো কম্প্রেসরের হাওয়াতেই প্রাণ দিতে হতো না। দরিদ্র রাজনকে যদি চোর অপবাদের সুযোগ দেওয়া না হতো, তবে এভাবে হয়তো তাকে মরতে হতো না।

হ্যাঁ, একটি কথা স্বীকার করতে হবে। শিশুরা বেড়ে ওঠার সুষ্ঠু পরিবেশ না পেলে হয়তো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ, তাই তাদের শুধরে দেওয়ার দায়িত্ব সমাজের, সরকারের। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পরিপালনে সরকারের উদ্যোগ একেবারে নগণ্য।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে শিশু-কিশোর শোধনাগার রয়েছে ৩টি। গাজীপুরের টঙ্গী, কোনাবাড়ী ও যশোরের পুলেরহাটে। এসব শোধনাগারে আসনসংখ্যা খুবই সীমিত; মাত্র ৬০০টি। সমাজসেবা অধিদফতরের প্রতিষ্ঠান শাখা এসব শিশু (কিশোর/কিশোরী) উন্নয়ন কেন্দ্রসমূহ পরিচালনা করে। মাঠপর্যায় থেকে জেলা সদর পর্যন্ত যার দায়িত্বে থাকেন বড় বড় কর্মকর্তারা। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে  বিভিন্ন থানায়/কারাগারে আটককৃত শিশুদের প্রবেশন অফিসার কর্তৃক শিশু আইন অনুযায়ী বিচারপ্রাপ্তির সহায়তা; বিভিন্ন কারাগারে আটক শিশুকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে স্থানান্তর; শিশু আদালত কর্তৃক প্রেরিত শিশুকে গ্রহণ; রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা প্রদান;  ভরণপোষণ, শিক্ষা, বৃত্তিমূলক ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান; শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক উৎকর্ষ সাধন; কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মানসিকতার উন্নয়ন; পরিচয়বিহীন শিশুর আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বের করা;  সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা; ফলো আপ করা।

এ ছাড়া শিশুর অধিকার সুরক্ষায় কাজ করে সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। এ অর্থবছরে সরকার শিশু সুরক্ষায় যথেষ্ট বরাদ্দও দিয়েছে।
 
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমাদের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ শিশু। এদের বয়স ১ দিন থেকে ১৮ বছরের নিচে পর্যন্ত। তাহলে তাদের জন্য শক্তিশালী ও টেকসই সরকারি সংস্থা থাকা উচিত নয় কি? তা কিন্তু হয়নি। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের একটি ডেস্কের দায়িত্বে সারা দেশের শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব। বড়ই দুঃখজনক বিষয়। এভাবে দেশের ৪৫ ভাগ জনগণের উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় ৫৪টি ধারার মধ্যে সরাসরি শিশুর সুরক্ষাবিষয়ক ২৪টি ধারা রয়েছে। ধারা ৩২-এর ১-এ বলা আছে, ‘সদস্যরাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকারকে রক্ষা করবে এবং শিশুর শিক্ষায় ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী কিংবা তার স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক বা সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর কাজ করানো না হয়, সে ব্যবস্থা নেবে।’

এই শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ১৯১টি দেশের মধ্যে প্রথম সারির দেশ হিসেবে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে স্বাক্ষর করলেও ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ এই সনদ গ্রহণ করে। ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গেছে ২৫টি বছর। শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের বেশ কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ রয়েছে বটে। শিশুর অধিকার রক্ষার কথা মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এ ছাড়া শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের ভূরি ভূরি আইন ও প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর মধ্যে জাতীয় শিশু নীতিমালা ২০১১, শিশু আইন ২০১৩, জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা ২০১০ এবং জাতীয় শিশুশ্রম নিরোধ নীতিমালা ২০১০ অন্যতম। সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের কর্মকৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়নে শিশু অধিকার সনদে অন্তর্ভুক্ত অনুচ্ছেদগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ফলে দেশে শিশু শিক্ষার হার বেড়েছে, শিশু মৃত্যুহার কমেছে, স্কুলে শারীরিক শাস্তি অবৈধ করা হয়েছে এবং শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এত সব উদ্যোগের পরেও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনা কি শুধু কাগজে-কলমে থেকে যাবে? আর কিছুদিন পরপর শুনতে হবে রাজন, রাকিবদের নৃশংস হত্যার গল্প।

শিশু নির্যাতনের এই অবস্থা চলতে পারে না। দেশ উন্নয়েনের পথে এগোচ্ছে। কিন্তু আজকের শিশুরা সুন্দর পরিবেশ না পেলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ থামকে দাঁড়াবে। শিশুরাই আগামী দিনের চালিকাশক্তি। বিষয়টি মাথায় নিয়ে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে শিশু অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আর কোনো রাজনকে হারাতে চাই না। ভূরি ভূরি আইন নয়, চাই শিশু অধিকারের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।

লেখক : সংবাদকর্মী।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ আগস্ট ২০১৫/রাসেল পারভেজ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়