ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শ্বেতশুভ্র হিমালয় দুহিতা : শেষ পর্ব

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ৬ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্বেতশুভ্র হিমালয় দুহিতা : শেষ পর্ব

আপেল বাগানের মাঝ দিয়ে পথ

ফেরদৌস জামান

পৌঁছে গেলাম মুক্তিনাথ। বেশ বড় জায়গা। মূলত এটি তীর্থস্থান। হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয় ধর্মের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে মুক্তিনাথ টেম্পল, বিষ্ণু, জাওয়ালামাই টেম্পল এবং সারওয়া গুম্বা। এখানে বাৎসরিক মেলা হয়। পুলিশ ক্যাম্পে এন্ট্রির পর দ্রুত গেস্টহাউসে উঠে এলাম। গরম পানির ব্যবস্থা দেখে লোভ সামলানো কঠিন হলো। টানা দশ দিন পর এগারো দিনে এসে গোসল করে শরীরের ওজন যেন দশ মণ কমে গেল। মাঝের দিনগুলো গোসল করার মতো পর্যাপ্ত পানি পাইনি। পেলেও অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে আর সম্ভব হয়নি। হাত পায়ের কয়েকটা আঙুলের ডগা তো অনেক দিন বোধহীন ছিল। অতিরিক্ত ঠান্ডায় এমন হয়।

সাদা অভিযাত্রী দলের মধ্যে কালো হওয়ায় কয়েক দিনেই আমরা সকলের নিকট পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলাম।বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে সকলেই অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোকের মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করে- ওহ ব্যাংলাডেশ! চোখ উল্টিয়ে কপালে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে অনেকে তাকিয়ে থাকে। কারণ তারা নামই শোনেনি। এ দেশে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আছে ইত্যাদি বলে তাদের আগ্রহ জাগানোর চেষ্টাও করেছি, লাভ হয়নি তেমন। কারণ তারা এ তথ্যগুলো জানেই না। এতখানি পথ চললাম কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা চোখে পড়েনি। অথচ প্রত্যেক অভিযাত্রীর কাছেই হাজার হাজার ডলার ও মূল্যবান জিনিসপত্র রয়েছে।

মুক্তিনাথে পথের ধারে বসেছে চাদর, মাফলার, টুপিসহ নানান হস্তশিল্পের দোকান। সকল দোকানিই নারী। চকি বা কাঠের মাচায় সাজানো দোকানগুলোয় প্রধান পণ্য ইয়াকের হাড়, শিং ও লোমের বিভিন্ন জিনিসপত্র। গেস্টহাউসে আমরা এবং চাইনিজ এক দল ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত তাদের তিব্বত ভ্রমণের বিশদ অভিজ্ঞতা শুনলাম। রাতে ভালো একটা ঘুমের পর খুব সকালে হাজির হলাম জিপস্ট্যান্ডে। তীর্থস্থান মুক্তিনাথ ঘুরে দেখার ভীষণ ইচ্ছা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হলো না। তবে জিপস্ট্যান্ডে তীর্থযাত্রীদের ভিড় দেখে মনে হলো, কিছু একটা দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলাম। জিপ ছাড়ল দেড় ঘণ্টা পর, পথে যার পর নাই ধুলা। নাক-মুখ কাপড়ে পেঁচিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হলো। জিপ চললো মুস্তাং জেলার সদর দপ্তর জমসমের দিকে।কালিগান্দাকী  নদীর বুকের মাঝ দিয়ে দীর্ঘ পথ। পানি বয়ে যাচ্ছে একাধিক চ্যানেল হয়ে আর শুকনো পাথুরে সমতল দিয়ে যাচ্ছে জিপ। মাঝে মাঝে কাঠের ছোট সাঁকো। জমসম এসে জানতে পারলাম, সেখান থেকে পরবর্তী গন্তব্য ঘাসার উদ্দেশে বাস ছাড়তে এক ঘণ্টা দেরি আছে। ইতিমধ্যেই নেমে এসেছি ২,৭২০ মিটার। তাড়াহুড়ায় সকালের খাওয়া হয়নি। সময় যেহেতু মিললো দুই বেলার খাবার একসাথে খেয়ে নিলাম।

বাস সময় অনুযায়ী ছড়লো। কালিগান্দাকীর পথ যেন ধুলার স্বর্গ। বসার জায়গা হলো চালকের পেছনে লম্বা সিটের এক কোণায়। একটু পরেই বাচ্চা-কাচ্চাসহ স্থানীয় এক পরিবার বাসে উঠল। যাত্রী ভরা বাসে সব থেকে খারাপ সিটে বসে কষ্ট যা হবার তা তো হচ্ছিলই, তার উপর মাঝ বয়েসী মহিলা পাশে বসে ৬-৭ বছরের বাচ্চাকে ঠেসে বসাল আমাদের মাঝের ফাঁকা জায়গায়। বিশ মিনিটের মধ্যে সেই বাচ্চা আমার কোলের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল! বেখেয়ালি মাকে একটু সাবধান হতে বললেই বলে, হা -জুর (কিছু বলছেন)? যেন রাগ করে বলছেন। তার কথা বুঝতে না পেরে ভয়ে শক্ত কাঠ হয়ে বসে থাকতে হলো।

এভাবেই পৌঁছে গেলাম মারফা গ্রামে। রাস্তার পাশে আপেল বাগান। পুরনো গ্রাম। দেখার অনেক কিছুই আছে- মন্দীর, বড় বাড়ি, আপেল বাগান ইত্যাদি। বাস এখানেই যাত্রা্ বিরতি করে থামল এক মদের দোকানের সামনে। একজন যাত্রী এক বোতল কিনে আনলেন এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে ভাঙা হিন্দিতে বললেন, অরিজিনাল শ্যাও (আপেলের নেপালী অর্থ) মইেড ব্র্যান্ডি। টেস্ট কারনেকি লিয়ে এক বোতল লিজিয়ে না।

গাছে ধরে রয়েছে লাল সবুজ রংয়ের অজস্র আপেল। বাগানের সামনে বিক্রেতা ডালি ভরে বসে রয়েছে। অতি সাধারণ ফল। আমাদের দেশে হয় না তাই কৌতূহল জাগে। আমাদের পুলকিত চেহারা দেখে তারা ভাবে- এ আবার পুলকিত হওয়ার মতো কি এমন জিনিস!  যতই নিচে নামছি রুক্ষ পাহাড়, পর্বত ছেড়ে প্রবেশ করছি সবুজের মাঝে। বেশ কয়েক দিন পর সবুজের ঝলমলে রূপ দখতে পেলাম। অগুনিত ঝরনার ছরছর শব্দে চলতি পথের অনেকটাই মুখোরিত হয়ে রইল। বাস এসে থামল চেকপোস্টে। সেখানে এন্ট্রি করে ঘাসায় প্রবেশ করলাম। এবার বাস বদল করতে হবে। আমরা বাস বদল করে বেনীর বাসে উঠব। টিকিট সংগ্রহ করে দাঁড়িয়ে আছি, সামনে এসে হাজির হলো ইসরাইলি যুবক। জিপে সে আমার সামনের আসনে বসে ছিল। তার সাথে একটি কথাও বিনিময় হয়নি। মাঝে জমসম থেকে বেনী দীর্ঘ পথে দেখাও হয়নি। জিপে ওঠার পর ধুলা থেকে রেহাই পেতে তার সাবধানতা অবলম্বনের প্রচেষ্টা দেখে কেবল বলেছিলাম, প্রথমে নাক ঢেকে রাখো। কথাটি সে মেনেছিল।

তার কাছে জানতে চাইলাম, এই পর্যায়ে তোমার গন্তব্য কোথায়?
কাঠমান্ডু, জনপ্রতি ১৫০০ রুপি। বলেই ব্যাগ থেকে সবুজ একটা আপেল বের করে বলল,  এটা তোমার জন্য। এরপর হঠাৎ ‘বাই’ বলেই দৌড়ে গিয়ে জিপে নিজের আসনে গিয়ে বসল এবং অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, যেন কত দিনের চেনা। ততক্ষণে জিপ  স্টার্ট্ দিয়েছে।  জানি ওর সঙ্গে জীবনে আর কখনও দেখা হবে না। কিন্তু মন থেকে এ দৃশ্য মুছে ফেলাও সম্ভব হবে না।

আমাদের বাসও ছেড়ে দিল পরবর্তী এবং দিনের শেষ গন্তব্য বেনীর উদ্দেশে। পাথরের মাথা ছেটে তৈরি পথ। মাঝ পথে সামনের বাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আটকে পরে দেরি হলো আধা ঘণ্টা। এমন পথে গাড়ি যে কীভাবে চলাচল করে তা বাস্তবে দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলে কাউকে বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়। এরপর বাস এসে থামল তাতোপানিতে। তাতোপানি অর্থ গরম পানি। সেখানে একটা প্রাকৃতিক উষ্ণ বা গরম পানির ঝরনা রয়েছে। এটির উল্লেখ রয়েছে রাহুল সাংকৃত্যায়ন রচিত ‘তিব্বতে সওয়া বছর’ বইটিতে। অনেক অভিযাত্রী উষ্ণ পানির পরশ নেওয়ার জন্য সেখানে এক দিন অবস্থান করে। আমরা কিন্তু থাকলাম না। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ বাস আমাদের নিয়ে  বেনী পৌঁছে গেল। রাতে থাকার ব্যবস্থা হলো পরিপাটি এক হোটেলে। কিন্তু সমস্যা হলো ভাষা নিয়ে। হিন্দি তো ভালোভাবে বোঝেই না, ইশারাও বোঝে না। রাতের খাবারে থাকলো ভাত, সবজি, ডাল ও মুরগির মাংস। রান্না খুব ভালো, পেট পুরে খেলাম। কত দিন পর যে মুরগির মাংসের তরকারি খেলাম!

পরদিন সকালে প্রথম বাস মিস করে দ্বিতীয় বাস ধরে দুপুরে পৌঁছে গেলাম পোখারা। ফ্রেশ হওয়ার জন্য উঠলাম সেই গেস্টহাউসে। যেখানে প্রথম অর্থাৎ ২৪ তারিখ রাতে উঠেছিলাম। হোটেলের লোকজন তো আমাদের চেহারা দেখে অবাক!  সেখান থেকে বিকেলের বাসে সারা রাত জার্নি করে কাকর ভিটা। সেখানে সীমান্তের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সেরে হেটে আবার সেই  মেসী সেতু পার হলাম। রাস্তার পাশে টং দোকানের তাওয়ায় ওলটপালটরত আলু পরোটা ভীষণভাবে দৃষ্টি কাড়ল। ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে বসে পরলাম টং দোকানে।   কয়েক মিনিটের মধ্যে বড় সাইজের দুটো পরোটা সাবাড় করে ফেললাম। তারপর গরুর দুধের এক কাপ চা। আহ! কি খেলুম দাদা!

বিকেলের মধ্যে এসে উপস্থিত হলাম চেংরাবান্ধা সীমান্তে। ইন্ডিয়ান ট্রানজিট ভিসা ছাড়া তাদের দেশ ছেড়ে নেপালে প্রবেশ করেছি, এ কারণে ইমিগ্রেশন পুলিশ গোস্যা প্রদর্শনপূর্বক পাসপোর্ট দূরে সরিয়ে রাখলো। দালালের কু-পরামর্শে শেষমেশ ৫০০ বিডিটি এবং ১০০ রুপি একত্রে মিলিয়ে দেবতার বুক পকেটে ভোগ দিয়ে নিস্তার পেলাম। এরপর তাদের আশীর্বাদের ফোয়ারা ছুটল যেন। নিরাপদে মাতৃভূমিতে ফিরে এলাম।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ এপ্রিল ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়