ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘১৪ ডিসেম্বর প্রায় মারাই যাচ্ছিলাম’

আতাউর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৫, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘১৪ ডিসেম্বর প্রায় মারাই যাচ্ছিলাম’

আতাউর রহমান

আতাউর রহমান : আমার ভাই মুজিবুর রহমান দিলু এবং মেহরাব রহমান, ওনারা দুজনই চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। আমি তখন একটি বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করি। আর আমি থেকে যাই। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। আমরা গ্রুপে কাজ করি। সুফিয়া খালার (সুফিয়া কামাল) মেয়ে মানে আজকের সুলতানা কামাল আমরা এক গ্রুপেই নাটক করতাম। ওই গ্রুপ পরবর্তীতে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় হয়েছে।

 

‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ্য কণ্ঠস্বরের ধ্বনি/ প্রতিধ্বনি আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি’শিরোনামের গানটা তখন বেরিয়েছে। এটা নিয়ে আমরা নানারকম কাজ করেছি।

 

ওই সময় গ্রুপের আলী জাকের চলে যায় স্বাধীন বাংলা বেতারে। দুলু (সুলতানা কামাল) চলে যায় আগরতলা।

 

একবার বাংলা একাডেমির সামনে আমি নিগৃহীত হই। পাকিস্তানি আর্মি আমাকে ধরে মারধর করেছিল। তবে ছেড়ে দিয়েছিল শুধু আমার চাকরির আইডেন্টিটি কার্ড দেখে।

 

ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। আমি প্রায় মারাই যাচ্ছিলাম। মনির চৌধুরী স্যারের বাসার পাশেই ছিল আমার বাসা। বাসাটি ছিল সেন্ট্রাল রোডে। ওই দিন স্যারকে ধরে নিয়ে যায়।

 

পরে ওনার ভাই রুসু এসে বলল যে, ‘আমার ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে।’

 

তখন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ফেলেছে। তখন রোজার দিন ছিল। রাস্তা সুনশান। কারফিউ জারি ছিল। আমরা বেরিয়েছি, এসময় আর্মির একটা জিপ এসে সামনে পড়ল। তিনজন আর্মি ছিল গাড়িতে। তারপর আমাদের ধরে ফেলল।

 

উর্দুতে বলছিল, যার বাংলা অর্থ- ‌‌‘তোমরা কোথায় যাচ্ছো? কারফিউ জারি আছে তা জানো না? সেহরির সময় অ্যানাউন্স করে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

 

বললাম, ‘আমি একটা বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করি। বেতন নেওয়ার জন্য যাচ্ছি। কারফিউয়ের কথা জানি না।’

তারপর আমাকে মারধর করা হলো। আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই তা দেখে ফেলে। সে সবাইকে ডেকে আনে। আমার বাবা-মা ভাইবোন সবাই জিপটাকে ঘিরে ফেলেন। এদিকে আমার মা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। সেন্ট্রাল রোড, ভূতের গলির সামনে এই ঘটনা ঘটে। পরে ক্যাপ্টেনের বোধয় দয়া হলো, তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন।

বললেন, যাও তোমাকে ছেড়ে দিলাম।

আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। দুই তিন দিন পর ওই ক্যাপ্টেন আমাকে দেখতে আসেন। আমাকে মাকে বললেন যে, ‘আমি আমার মাকে ছেড়ে এসেছি যুদ্ধ করতে। আমি যদিও পাকিস্তানি নই। আমি ইন্ডিয়ান। আপনি না গেলে, আপনার ছেলেকে আমরা মেরেই ফেলতাম। কোথায় ফেলে দিতাম কেউ জানতো না। পারলে একটা মিলাদ শরীফ পড়ান।’

 

ওই ক্যাপ্টেন আমাকে বলেছিল, ‘ইয়োর জয় বাংলা ইজ ভেরি মাচ এ্যালাইভ নাও।’

এই হলো আমার একান্ত অভিজ্ঞতা। পরে যখন দেশ স্বাধীন হয়, বিজয় দিবসে জেনারেল…।

 

সত্য কথা বলতে, ১৬ ডিসেম্বরেও অনেককে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানি অনেক সেনা লুকিয়ে ছিল বিভিন্ন জায়গায়। তারা বিভিন্ন জায়গাতে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। আত্মসমর্পণের আগেও মেরে গেছে।

 

যুদ্ধচলাকালে প্রতিনিয়ত আমাদের আতঙ্কে কেটেছে। একদিকে পাকিস্তানি আর্মি, অন্যদিকে ছিল মিরপুরের বিহারীদের আক্রমণের ভয়। রাজাকার আর পাকিস্তানি দালালের ভয়তো ছিলই।

 

আমরা যারা বাঙালি তারা একটি বন্দীশালায় ছিলাম। যারা শরণার্থী হয়ে চলে গিয়েছিল ইন্ডিয়াতে তাদেরও একটা মুক্ত জীবন ছিল। খাওয়া-পরার টানাটানি হলেও আক্রমণের ভয় ছিল না তাদের। কিন্তু আমরাতো বাঙালি সংস্কৃতির লোক হিসেবে চিহ্নিত। তখন নাটক করি। নাটকের মাধ্যমে আমরা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। রবীন্দ্র শতবর্ষে যখন রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করল তখন আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম। কার্জন হলের সামনের রাস্তায় আইয়ুব খানের ছবি ভেঙেছিলাম।

 

এই যে ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়া, এর জন্য আমাদের প্রস্তুতি কিন্তু আগেই হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। তখন থেকেই খুব ভালো করে চিনি, ‘আমাদের শত্রু কে?’

 

মনে হতো না, এ দেশ আমাদের। বঞ্চিত হতে হতে যুদ্ধের মানসিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

ধাপে ধাপে পাওয়া এই স্বাধীনতা- এই বিজয়ের যে কি ব্যাখ্যা হতে পারে তা অনুভূতি বা ভাষা দিয়ে বোঝানো কঠিন। বড় কঠিন।

 

আজ যখন স্বাধীন বাংলাদেশের দিকে তাকাই, আজকের বাংলাদেশ একটি সেন্ট্রালাইজড বাংলাদেশ। এখানে সবকিছু ঢাকামুখী। ডি-সেন্ট্রালাইজড এখানে ঠিকঠাক মতো হয়নি।

 

বঙ্গবন্ধু একটা সমাজতান্ত্রিক দেশ চেয়েছিলেন। এই সমাজতন্ত্র কিন্তু ক্লাসিক্যাল বা মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্র নয়। তিনি এই দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সমাজতন্ত্রের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। দুর্ভাগ্য আমাদের আমরা জাতির জনককে হারিয়েছি। তাও আবার নির্মম হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে।

 

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রক্তস্নাত ইতিহাস। এই ইতিহাসের কাছে আমাদের দায়বদ্ধতা অনেক। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল তাও পুরোপুরি হতে পারেনি। এই জায়গাগুলোতে স্বাধীনতার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। তবু আশাবাদী, যে স্বপ্ন দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল তাই প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলাদেশ।

 

অনুলিখন : স্বরলিপি

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৬/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়