ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সবজি চাষে কাদের মিয়া অনুসরণীয়

বিলাস দাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সবজি চাষে কাদের মিয়া অনুসরণীয়

নিজের নার্সারিতে পরিচর্যায় ব্যস্ত কাদের মিয়া

বিলাস দাস, পটুয়াখালী : আট সন্তানের জনক প্রান্তিক কৃষক আব্দুল কাদের মিয়া (৬০) (ওরফে কাদের ডাক্তার)। ডাক্তার বাড়িতে তার জন্ম হওয়ায় গ্রামবাসী তাকে কাদের ডাক্তার বলেই ডাকে।

 

বছর কয়েক আগে নুন আনতে তার পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা ছিল। সংসারে ঘানি টানতে গিয়ে প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু নানা জাতের সবজি চারা বিক্রি করে তার ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন তিনি। বয়স তাকে আটকে রাখতে পারেনি। বর্তমানে মোমিনপুর গ্রামের স্বচ্ছল এবং স্বাবলম্বী মানুষ তিনি।অনেকের কাছে অনুসরণীয়ও।

 

লাউ, টমেটো, তাল বেগুন, বোম্বাই মরিচ, পেঁপে, ফুলকপি, পাতাকপি, শালগম, শিমসহ নানা ধরনের শাক-সবজির চারাই কাদের মিয়ার ভাগ্য বদলের একমাত্র উপকরণ।

 

পটুয়াখালী জেলার বাউফলের মমিনপুর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক এই বৃদ্ধ কাদের মিয়া ওরফে কাদের ডাক্তার।  সবজি চারা উৎপাদন আর শাক-সবজির চাষ করে অভাবকে জয় করেছেন। মাত্র পাঁচ বছরে তিনি এখন লাখপতি।

 

অভাবের কারণে পড়ালেখা হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পর্যন্ত  পার হতে পারেননি। পৈত্রিক  বসতভিটা ছাড়া এক টুকরো কৃষিজমি জোটেনি তার ভাগ্যে। ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে, স্ত্রীসহ ১০ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি।

 

২০১২ সালে ওই গ্রামেরই উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল গনি সিকদার কাছ থেকে সবজি চাষের পরামর্শ নেন।সামান্য অর্থ নিয়ে বাড়ির পাশে খালের পাড়ে পরিত্যক্ত জমিতে সবজির চারা উৎপাদন ও  শাক-সবজির চাষ শুরু করেন তিনি।

 

কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রথম বছর লাউ, টমেটো,  বোম্বাই মরিচ, তাল বেগুন, পেঁপে, শিমসহ নানা ধরনের সবজির চারা বিক্রি করে  সাফল্য আসে তার। ক্রমেই বদলে যেতে শুরু করে তার ভাগ্য। নানা ধরনের সবজির চারা উৎপাদন ও বিক্রির আয় দিয়ে বছর শেষ হতেই ঋণ শোধ করেন কাদের।

 

পরে প্রতিবেশীর কাছ থেকে অস্থায়ী কৃষিজমি বন্দোবস্ত নিয়ে  গড়ে তোলেন একটি  চারা উৎপাদন নার্সারি আর শাক-সবজির খামার। এখন তার চারা উৎপাদনের পলিথিনের বিশাল সেটে চোখে পড়ে নানা ধরনের সবজির চারা । একই সঙ্গে পাশের খামারে দুই শতাধিক মাচায় বেয়ে ওঠা লাউ, শতাধিক মিষ্টি কুমড়াসহ লাফা, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, লালশাক, পুইশাক, পেঁপেসহ বিভিন্ন শাক-সবজিতে নজর কাড়েন স্থানীয়দের।

 

কাদের মিয়া জানান, এখন তার খামারে নিয়মিত তিন-চার জন কৃষিশ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সবজি চারা ও তার খামারের শাক-সবজি বিক্রি হচ্ছে উপজেলা সদরসহ স্থানীয় বিভিন্ন হাট-বাজারে। খামারে এ বছর বিনিয়োগ করেছেন পাঁচ লাখ টাকা।

 

চলতি মৌসুমে আগাম জাতের টমেটো চারা (লালতীরের উন্নয়ন, সওসান), মেটালের (হাইব্রিড) করলা, লালতীরের (টিয়া) করলা, যমুনা জাতের বেগুন (মেটাল সীডসের), স্থানীয় ঘৃত-কুমারী জাতের বোম্বাই মরিচ, পেঁপে, শিম, লাউ চারা, মাইবার্ড ও হোয়াইট জাতের ফুল কপিসহ স্থানীয় জাতের সবজির চারা বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা আয় হয়েছে তার।

 

এ ছাড়া সবজির চারা বিক্রি বাবদ আরো অর্ধ লক্ষাধিক টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। পাশের খামারে থাকা টমেটো, বেগুন, কুমড়া, চালকুমড়া (জালি), লাউ, শিম, বরবটি, থেকে আয় হবে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। সবজির চারা ও শাক-সবজি বিক্রি বাবদ চলতি মৌসুমে খরচ বাদে পাঁচ লক্ষাধিক টাকা আয়ের আশা করছেন তিনি।

 

কেঁচো কম্পোস্ট, ভার্মি কম্পোস্টের সঙ্গে সহনীয় মাত্রায় সার-ওষুধে উৎপন্ন সবজির চারা ও শাক-সবজির মান ভাল থাকায় স্থানীয় বাজারে চাহিদাও বেশি। তার এ সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সবজির আবাদ করেছেন পাশের হোসেন মাস্টার, প্রভাষক ফরিদ উদ্দিনসহ আরো অনেকে। কাদের ডাক্তারের কাছ থেকে অভিজ্ঞতার পরামর্শ নিচ্ছেন ওই গ্রামের অনেকেই।

 

কাদের মিয়া আরো জানান, নিজের সংগ্রহ করা স্থানীয় জাতের বীজ ও বাজার থেকে বীজ কিনে তা থেকে চারা উৎপাদন করেন তিনি। সবজির আবাদে কেঁচো-কম্পোস্ট, ভার্মি-কম্পোস্ট সার ও লতাপাতায় নিজের তৈরি কীটনাশক ব্যবহার করেন। তবে বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিতে সহনীয় মাত্রায় সার-ওষুধ ব্যবহার ও হাইব্রিড জাতের শাক-সবজিও উৎপাদন করতে হয়।

 

তিনি বলেন, ‘নিজে লেহাপড়া করি নাই। ছেলে-মেয়েগো লেখাপড়া তেমন অয় নাই। তবে ছোট ছেলেটারে লেহাপড়া শিখাইয়া মানুষ করমু। আজীবনই এই কাজ কইর‌্যা যামু। এই কাজেই এহন চোহে টাহা পয়সা দেহি। অভাবও দূর অইছে।’   

 

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সারোয়ার জামান বলেন, ক্রমাগত আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে রোগ-বালাই ও বিপর্যয় কাটিয়ে স্বল্পমেয়াদি শাক-সবজি চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। সবজি চাষে অল্প পুঁজিতে অধিক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

সারোয়ার জামান আরো জানান, সবজি চারা উৎপাদন ও শাক-সবজি চাষে কাদের ডাক্তার সফলতার মুখ দেখছেন। এ অঞ্চলে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে সবজি চাষ।

 

 

রাইজিংবিডি/পটুয়াখালী/১২ ডিসেম্বর ২০১৬/বিলাস দাস/রিশিত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়