ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সমুদ্রের আতঙ্ক ভাইকিং

শাহিদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৭, ২৫ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সমুদ্রের আতঙ্ক ভাইকিং

সমুদ্রে জলদস্যুদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। মিশরের ফারাওদের আমলে রচিত প্যাপিরাসের পুথিতে জলদস্যুদের উল্লেখ আছে। বর্ণিত আছে, পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে যাত্রীবাহী নৌযানে জলদস্যুদের আক্রমণের কথা। প্রিয় পাঠক, আজ আপনাদের এমনি এক জলদস্যু বাহিনীর কথা শোনাব, যাদেরকে সমুদ্রের মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করা হতো, যারা শ্রেফ একটি ক্ষুদ্র আদিবাসী গোষ্ঠী থেকে সমুদ্রের ত্রাসে পরিণত হয়।

 

ভাইকিং। জলদস্যু, ডাকাত, সমুদ্রের ত্রাস নানা বিশেষণে তারা বিশেষায়িত। ইউরোপের ইতিহাসে যুদ্ধবাজ এবং লুটেরা জাতি হিসেবে এরা কুখ্যাত। সমুদ্র জলদস্যু হিসেবে এরা অত্যন্ত বর্বর। লুঠতরাজ, খুন, এসব তাদের কাছে ছিল বীরত্ব। যে বেশি ডাকাতি করতে পারত, হিংস্রতার পরিচয় দিতে পারত সে নিজেকে তত বড় বীর মনে করত।

 

ভাইকিং শব্দটি এসেছে নরওয়ের নর্স ভাষা থেকে। নর্স ভাষায় ভাইকিং শব্দের অর্থ হচ্ছে ফিয়র্ডের সন্তান। ফিয়র্ড হচ্ছে- সমুদ্র উপকূলের বিশেষ ভূপ্রাকৃতিক গঠন, যার প্রকৃতি খুব ভঙ্গুর। বরফ যুগের হিমবাহের ফলে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান ভূমির অনেক অংশ বিলীন হয়ে এই ফিয়র্ডের সৃষ্টি হয়। ভূমির গঠন ভঙ্গুর হওয়ায় এই অঞ্চলের বাসিন্দারা ভূমিতে বসবাসের চেয়ে ছোট-বড় নৌকাতে বসবাস করতে পছন্দ করত।

 

ভাইকিংদের মূল পেশা ছিল মৎস্য শিকার। উপকূল থেকে শুরু করে গভীর সমুদ্রে তারা মাছ শিকার করত। সমুদ্রে মাছ শিকারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে দস্যুবৃত্তির প্রবণতা দেখা দেয়। প্রথম দিকে তারা ছোট ছোট নৌযান থেকে ডাকাতি করত। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা এটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়।

 

ভাইকিংদের জাহাজ ছিল একবারেই সাধারণ কাঠামোর, লম্বা এবং দুদিকের মুখ ছিল সুচালো। আর এই সাধারণ জাহাজে চড়েই গভীর সমুদ্রে তারা তাণ্ডব চালাত। অন্য যেকোন জলদস্যুদের চেয়ে ভাইকিংদের ডাকাতি করার পন্থা ছিল একেবারেই আলাদা। তারা অতর্কিত হামলা চালিয়ে সব কিছু কেড়ে নিত। শুধু মালামাল কেড়ে নিয়েই তারা ক্ষান্ত ছিল না। নৌযানে থাকা যাত্রীদেরকেও রেহাই দিত না। হয় গলা কেটে, না হয় সমুদ্রে নিক্ষেপ করে মেরে ফেলত। তাদের নিষ্ঠুরতা কল্পনাকে হার মানাত।

 

 

কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো- ভাইকিংরা কখনো তাদের কৃতকর্মের জন্য নিজেদের অপরাধী মনে করত না। দস্যুবৃত্তিকে তারা পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এ জন্য তাদের কোনো দুঃখবোধ ছিল না।

 

ভাইকিংদের উত্থান মূলত অষ্টম শতকে। এবং এর পর ১০৫০ সাল পর্যন্ত ইউরোপের উপকূলবর্তী এক বিশাল এলাকাজুড়ে বসতি স্থাপন করে ও লুঠতরাজ চালায়। ভাইকিংরা পূর্বদিকে রাশিয়া ও কন্সটান্টিনোপল পর্যন্ত পৌঁছে ছিল। অন্যদিকে ৯৮৫ সালে ভাইকিংরা প্রথম গ্রিনল্যান্ডে বসতি স্থাপন করে।

 

ভাইকিংরা একনাগাড়ে সমুদ্রে দীর্ঘ সময় অবস্থান করত তারা। এতে তাদের কথ্যভাষাও অনেক পালটে গিয়েছিল। এক প্রকার নতুন বুলি প্রচলন করেছিল তারা। যা শুধু তারাই বুঝতে পারত। অন্যদের কাছে সেই ভাষা ছিল দুর্বোধ্য।

 

দৈহিকভাবে ভাইকিংরা লম্বা ও চিকন। মুখ সুঁচালো। এ দৈহিক গড়নের ভাইকিংরা ৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের ডরসেট উপকূলে আক্রমণ চালায়। এরপর প্রতি বছর তারা আক্রমণ করত। লুটপাট করত। আশপাশের ক্ষুদ্র দ্বীপগুলোকে দখল করে নিয়ে ঘাঁটি বানায়। ক্রমে ৯১২ খ্রিষ্টাব্দে তারা রাইন নদী থেকে সিন নদী পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করে। পশ্চিম ইউরোপের নদীপথ দিয়ে প্রবেশ করে শ্যাটল্যান্ড, অর্কনি, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড পৌঁছায় তারা।

 

১১ শতকের পর থেকে ধীরে ধীরে ভাইকিংদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমতে থাকে। অভিযানের সময় অনেক ভাইকিং সদস্য মারা যায়। এ ছাড়া স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলের বসবাসকারী লোকেরা ধীরে ধীরে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করা শুরু করলে অনেক ভাইকিং খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়ে জলদস্যুতা ছেড়ে দেয়। এভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে জলদস্যু বনে যাওয়া আদিবাসীগোষ্ঠীটি ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে সভ্যতায় জায়গা করে নেয়। শেষ হয় বর্বর ভাইকিংদের ইতিহাস। ভাইকিংদের উত্তরসূরিরা এখন আধুনিক ইউরোপে ছড়িয়ে আছে।

 

ভাইকিংদের জীবন ব্যবস্থা নিয়ে অনেক নাটক-সিনেমা হয়েছে। সেসবে তাদের দুর্ধর্ষ জীবনের চিত্রায়ন পাওয়া যায়। এরমধ্যে হ্যামার অব দি গডস, দি ভাইকিংস, পাথফাইন্ডার, ভালহালা রাইজিং উল্লেখযোগ্য সিনেমা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা ২৫ মে ২০১৬/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়