ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

গরু না কেনার গল্প || আহসান হাবীব

আহসান হাবীব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গরু না কেনার গল্প || আহসান হাবীব

কোরবানী ঈদে গরু কেনার গল্প তো অনেক আছে এবার বরং শোনা যাক গরু না কেনার গল্প।

গল্প এক-

পাশাপাশি ফ্ল্যাট, জোড়ে কথা বললে ঐ ফ্ল্যাটের কথা এই ফ্ল্যাট থেকে শোনা যায়। দুই ফ্ল্যাটে আবার খুবই রেশারেশি। এক ফ্ল্যাটের কর্তা ঘরে ঢোকা মাত্র স্ত্রী চেঁচিয়ে বললেন, কি গো গরুর দাম কত পড়ল? পঞ্চাশ হাজার?

কর্তা হতভম্ব হয়ে বললেন, কি বলছ! গরু কিনব মানে? এ মাসে আমার বেতনই হয়নি কোম্পানির অবস্থা খারাপ আর তুমি বলছ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনেছি!

স্ত্রী মুখে আঙুল দিয়ে ফিস ফিস করে বলল, শশশ ... আস্তে কথা বলো, পাশের ফ্ল্যাটের ওদেরকে শোনাচ্ছি। আর ঠিক তখনই ওপাশের ফ্ল্যাট থেকে শোনা গেল- কি বললে ষাট হাজার দিয়ে গরু কিনেছ! কোনো মানে আছে এত দাম দিয়ে গরু কেনার? যাক কিনে যখন ফেলেছ কি আর করা।

 

আসলে দুই  ফ্ল্যাটের কেউই গরু কেনেনি। একজনের কোম্পানির অবস্থা খারাপ বলে বেতনই হয়নি বোনাস তো দূরে। আরেকজনের ব্যবসা মন্দা, প্রচুর ঋণ হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের স্ত্রীরা একজন পঞ্চাশ হাজার, একজন ষাট হাজারী গরু কিনে বসে আছেন। কল্পনায় গরু কিনতে দোষ কি? স্বয়ং আইনস্টাইন বলে গেছেন, ‘জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা জরুরী।’

 

গল্প দুই-

এই বাড়ির কর্তার অবস্থা আরও খারাপ। আগের ঈদে বেতন-বোনাস হয়নি। এই ঈদেও হয়নি। অফিসের বস অবশ্য বলেছেন ঈদের পর ইনশালাহ দুই ঈদের বেতন বোনাস এক সাথে হয়ে যাবে। এদিকে এই বাড়ির কর্তার বৃদ্ধ বাবা তার সঙ্গে থাকেন। বৃদ্ধ বাবা বয়সকালে বেশ ধনীই ছিলেন, প্রতি বছর নিজে গরু কিনে কোরবানী দিতেন। কিন্তু এখন এসে পড়েছেন দরিদ্র ছোট ছেলের ঘাড়ে, সেটা অবশ্য তিনি বুঝতে পারেন না। ছেলে বাবাকে বুঝতে দেয় না। বড় ছেলে বিদেশে, ভাইতো দূরে বাবার খোঁজও নেয় না।

 

ছেলে ঘরে ঢুকতেই বাবা বললেন, কিরে ঈদ তো চলে এল গরু কিনেছিস?

এ্যাঁ ইয়ে...  কিনেছি। ছেলে মিথ্যেই বলল। কারণ ছেলে গরু কেনেনি  বাবা এটা নিতে পারবেন না। হার্ট অ্যাটাকও  হয়ে যেতে পারে।

কত পড়ল?

ইয়ে তি তিরিশ হাজার।

বেশ বেশ আমাকে একটু গরুটা দেখা।

ছেলে পড়ল বিপদে। তবু বলল, আচ্ছা দেখাবো।

কখন দেখাবি?

ইয়ে গরুকে মাঠে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গেছে ফিরে আসুক দেখাব।

আচ্ছা ঠিক আছে। কোরবানীর আগে গরুটাকে ভালো করে গোসল দিস।

আচ্ছা দিব।

কার কার নামে দিবি ঠিক করেছিস?

ঠিক করিনি। করবো।

তোর মায়ের নামটা আগে দিবি।

আচ্ছা দেব।

 

প্রাথমিক ধাক্কা সামলানো গেল। কিন্তু বিকেল হওয়া মাত্র বৃদ্ধ বাবা অস্থির হয়ে গেলেন গরু দেখার জন্য। কি আর করা। বৃদ্ধ বাবাকে ধরে ধরে (তিন হাঁটতে পারেন না) কোনমতে বাইরে এনে একটা চেয়ারে বসিয়ে পাশের বাড়ির আলিশান ষাড়টাকে দেখিয়ে দিলেন।

বাহ! বাহ! সুন্দর ষাঁড় কিনছিস, মাত্র ত্রিশ হাজারে এত বড় ষাঁড়!  তুই জিতেছিস।

হ্যাঁ গরু এবার বেশ সস্তা।

কাছে নিয়ে যা গরুটার গায়ে মাথায় একটু  হাত বুলিয়ে দেই।

না না বাবা, দরকার নেই তেজি ষাঁড়। লাথি টাথি দিয়ে বসলে সর্বনাশ হবে। এখানে বসেই দেখ।

আচ্ছা ঠিক আছে। বাবা মায়া মায়া চোখে গরুটাকে দেখতে লাগলেন। তার মনে পড়ে গেল বয়সকালে এ রকম কত ষাঁড় তিনি নিজে হাট থেকে কিনে কোরবানী দিয়েছেন।

 

তবে শেষ রক্ষা হলো না। বাবা যেন কীভাবে বুঝে গেলেন, এ গরু তার ছেলের কেনা না। পাশের বাসার গরু। দামও ত্রিশ হাজার না। সত্তর হাজার। তিনি কিছু বললেন না। নাতীর হাত ধরে একসময় ঘরে এসে বসলেন কোনমতে। অনেক রাতে ছেলেকে ডেকে পাঠালেন নিজের ঘরে। তারপর বললেন, বাবা একটা মিথ্যা বললে দশটা মিথ্যা দিয়ে তা ঢাকতে হয়। তার মানে তখন এগারটা মিথ্যা বলা হয়। মিথ্যা বলা ভালো না। তবে এগারটা মিথ্যা এক অর্থে এগারটা নতুন গল্পও। কী বলিস? গল্প শুনতেও কিন্তু ভালো লাগে। আয় কাছে আয়।

 

লজ্জিত ছেলে বাবার কাছে যায়। বাবা ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। হঠাৎ বাবা ছেলে দুজনেই কাকতালীয়ভাবে এক সঙ্গে ‘চোখে আবার কি পড়ল বলে?’ চোখ মুছতে লাগলেন। 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়