ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ক্যানেল ক্রুজ: জলের বুকে জলতরঙ্গ

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২০, ৪ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ক্যানেল ক্রুজ: জলের বুকে জলতরঙ্গ

(লক্ষ্মণরেখার বাইরে: ৫ম পর্ব)

শান্তা মারিয়া: নেদারল্যান্ডস বেড়াতে গিয়ে আমস্টারডামের ক্যানেল ক্রুজ বা নৌবিহারে যাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমি যদিও বেড়াতে যাইনি, গেছি বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাজে। তবুও ক্যানেল ট্রিপে অংশ নেব না তা তো হয় না। এমনকি আমি চাইলেও ডাচরা ছাড়বে কেন! ক্যানেল ট্রিপ বা ক্যানেল ক্রুজ হলো আমস্টারডামের ঐতিহ্য। সাধে কি আর এই নগরীকে বলা হয় ‘উত্তরের ভেনিস’।

আমস্টেল নদীর মোহনায় অবস্থিত আমস্টারডাম শহর জালের মতো ঘিরে রেখেছে ছোট ছোট খাল বা ক্যানেল। এই ক্যানেলগুলো সবই আমস্টেল নদী থেকে বেরিয়েছে। এগুলো ঘুরে ফিরে আমস্টেল নদীতে অথবা আইজে উপসাগরে গিয়ে পড়েছে। প্রায় একশ কিলোমিটারের বেশি ক্যানেল, দেড় হাজার ব্রিজ এবং ৯০টি দ্বীপ রয়েছে আমস্টারডামে। এই ক্যানেলগুলো সবই মানুষের হাতে গড়া। শহরের পরিকল্পনার অংশ এগুলো। কিছু অবশ্য প্রাকৃতিকও আছে। মধ্যযুগের শেষে ডাচ স্বর্ণযুগে এই ক্যানেলগুলো খনন করা হয়। জলপথে আমস্টারডাম শহরের অর্ধেকের বেশি যানবাহন চলাচল করে। ছুটির দিন সকালে ক্যারেন, তার ছোট্ট মেয়ে মিয়া, ক্যারেনের সুন্দরী বস, আমি ও অক্সফ্যাম জিবির কর্মী পার্থ বের হলাম ক্যানেল ট্রিপে। এটা আমাদের আমন্ত্রণকারী সংস্থা অক্সফ্যাম নভিবের ব্যবস্থাপনাতেই হলো।

শহরের হৃদয় দিয়ে রক্তনালীর মতো প্রবাহিত হচ্ছে ক্যানেল। ক্যানেলে ভেসে যাচ্ছে নৌকা, স্টিমার, স্পিডবোট, ওয়াটারবাস। ভাসমান রেস্টুরেন্ট ও দোকান রয়েছে। রয়েছে চমৎকার সব ফুলের দোকান। এগুলো সবই বোটের মধ্যে। আমরা যে জলযানে উঠলাম সেটি বিশেষভাবে পর্যটকদের জন্য। তাই চারদিকটা কাচের তৈরি। দেখা যাচ্ছে দারুণ সব দৃশ্য। পর্যটকদের সুবিধার জন্য ডাচ ও ইংরেজি ভাষায় ধারা বিবরণী চলছে। সিনগেল, হেরেনগ্রাচট, কাইজারসগ্রাচট, প্রিনসেনগ্রাচট ইত্যাদি সব বিখ্যাত ক্যানেল। আমরা উঠেছিলাম যে জলযানটিতে সেটা সিনগেল ক্যানেল দিয়ে ঘোরে। এই ক্যানেলটি অনেক প্রাচীন, ১৪৮০-১৫৮৫ সাল পর্যন্ত এটি মূল শহরকে বেষ্টন করে ছিল। প্রাচীন আমস্টারডাম শহর ছিল এর গণ্ডির ভিতরেই। এটি উত্তর সাগর, উপসাগর ও আমস্টেল নদীর সাথে বৃত্তাকারে সংযুক্ত। এর কাছেই রয়েছে সেন্ট্রাল স্টেশন। এই রেল স্টেশন থেকে বেরিয়েই আমরা ঘাটে এসেছিলাম।

জলযান চলছে। চমৎকার রোদঢালা দিন। জলের উপর রোদ পড়ে ঝকমক করছে। আকাশটাও দারুণ নীল। ক্যানেলের দুই পাশে মধ্যযুগের দর্শনীয় সব স্থাপনা। প্রাসাদ, রাজকীয় সব ভবন। চতুর্দশ শতকে নির্মিত একটি গির্জা তার অসাধারণ মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে ক্যানেলের তীরে। শরতের ঝকঝকে নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে এই প্রাচীন গীর্জাকে মনে হচ্ছে যেন ভ্যান গঘের ছবি থেকে উঠে আসা কোনো অমর শিল্পকর্ম।
 



তারপর দুপাশে দেখা দিল মধ্যযুগীয় প্রাসাদের সারি। রাজ পরিবারের সদস্য, রাজ দরবারের হোমড়াচোমড়া, বীর নাইট, বিখ্যাত ডাচ বণিক, সওদাগর, বিশিষ্ট অভিজাতদের বাসস্থান। মধ্যযুগীয় প্রাসাদগুলো দেখে মনে হয় এক্ষুণি খুলে যাবে প্রাসাদের কারুকার্যময় বিশাল ফটক আর বেরিয়ে আসবে অশ্বারোহী বীর নাইট।  বাড়িগুলোও যথেষ্ট দেখার মতো। জলের তীরে দাঁড়িয়ে আছে চমৎকার রং করা সারি সারি বাড়ি। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। সত্যিই শিল্পের শহর আমস্টারডাম। এমন শিল্পিত এদের সাধারণ বাড়িঘরগুলো যে, চোখে ভাসে ডাচ স্বর্ণযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা ল্যান্ডস্কেপগুলো। মিল খুঁজে পাই বাস্তবে আর ছবিতে। শুধু ক্যানেলের তীরে নয়, ক্যানেলের উপরেও আছে বাড়ি, ভাসমান বাড়ি।

বাংলাদেশে বেদে সম্প্রদায়কে দেখেছি নৌকায় থাকতে। গুরুদেবও শিলাইদহে বোটে থাকতেন দিনের পর দিন। ক্যানেলে ভাসমান সুসজ্জিত এই বাড়িগুলো দেখে আমারও ভীষণ ইচ্ছা করছিল বোট হাউজে বাস করতে। কিন্তু হায়। সে সাধ্য কি আর আমার আছে।

ঢাকায় তখনও হাতির ঝিল গড়ে ওঠেনি। আমার শুধু মনে হচ্ছিল যদি ঢাকা শহরে এমন ক্যানেলের ব্যবস্থা করা যায়। একসময় তো ধোলাই খালও প্রবাহিত হতো ঢাকার হৃদয় দিয়ে। ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে ধোলাই খাল ছিল রক্তবাহী শিরার মতো উপকারী। এখন কি তেমন করা যায় না?

আমস্টারডাম শহরের এই ক্যানেল এবং তার আশেপাশের স্থাপনাগুলো ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। শুধু পর্যটকদের ক্যানেল ক্রুজ থেকেই নেদারল্যান্ডস পর্যটন খাতে প্রচুর আয় করে। এই ক্রুজের অংশ হিসেবে দেখা যায় উপসাগরের একটি অংশও। মোহনাতে রাখা হয়েছে বিশাল একটি সমুদ্রবাহী জাহাজ। এই জাহাজটি কিন্তু আধুনিক নয়। এটি মধ্যযুগের। এই ধরনের জাহাজে করেই ডাচ বণিকরা ঘুরে বেড়াতেন প্রাচ্য-প্রতীচ্য। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিরও ছিল এমন অনেক জাহাজ। জাহাজটির কারুকার্য দেখছিলাম। কল্পনার চোখে ভেসে উঠছিল সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিওতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য। সেই মসলার দেশ হিন্দুস্থানের জন্য ইউরোপীয় বণিকদের আগ্রহ। ভাবছিলাম পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামার কথা।
 



উত্তাল সাগর মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এই বণিক, সওদাগর, নাবিকরা চলে যেতেন দূরদূরান্তে। ভাবনা প্রসারিত হয়ে যাচ্ছিল আরও দূর অতীতে। ভারতবর্ষ থেকে যখন সাহসী নাবিকরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যেতেন সুমাত্রাসহ বিভিন্ন দ্বীপে। সিংহপুর(সিংগাপুর), বন্দর সেরি বেগাওয়ান (বন্দর শ্রী ভগবান), আংকর ভাট(অংক ভট্ট), বোরাবুদর এ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতীয় সভ্যতার নগর উপনগর। বাংলার ছেলে বিজয় সিংহ লংকা করিয়া জয়, সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।

ধ্যাত, ধান ভানতে শুধু শিবের গীত! এদিকে কারেনের ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে খাবার-দাবার। স্যান্ডুইচ আর চকলেট মিল্ক। প্র্যামে চড়ে দিব্যি ফুর্তিতে আমাদের সঙ্গে ঘোরা মিয়ার জন্যও বের হলো বিশেষ খাবার। ছোট এক বয়াম বেবি ফুড। মিয়া খাচ্ছে সাগ্রহে। ক্যারেন ওকে খাওয়াতে খাওয়াতে মন্তব্য করল, ‘মিয়া অনেক খায় (শি ইজ আ বিগ ইটার। লাইলা ইজ অলসো আ বিগ ইটার) মা নিজের মুখে বলছে তার বাচ্চা অনেক বেশি খায়! শুনেই আমার মনে কেমন যেন ধাক্কা লাগলো। আমরা বাঙালি মায়েরা কখনও একথা মুখেও আনি না। বালাই ষাট। ছেলে-মেয়ে হাতির মতো খেলেও বলি ‘আহারে বাছা শুকিয়ে যাচ্ছে। কিছুই খায় না’। সেকথা ক্যারেনকে বলাতে ও একটু অবাক হলো-কেন? একমাত্র রোগ হলেই বাচ্চারা কম খেতে পারে। নইলে কম খাবে কেন? বরং ওবেসিটিই তো খারাপ। কেন বাঙালি মায়েরা একথা বলি, কেন নজর লাগার ভয় করি, কপালে কাজলের টিপ পরাই এতসব কথা ব্যাখ্যা করে বুঝানো বিশেষ করে ‘নজর লাগা’ কাকে বলে সেটা বুঝানোর মতো ইংরেজি জ্ঞান আমার নাই। মাফও চাই, দোয়াও চাই।

আমাদের মেয়েলি বাক্যালাপ শুনে মিটিমিটি হাসছিল পার্থ। আমার সাহায্যে এগিয়ে এসে সে পুরো বিষয়টা সুপারস্টিশান আর কাস্টম বলে এক কথায় সমাপ্তি টানলো।

জলের বুকে রোদের খেলা, বাতাসের গান। দুই আড়াই ঘণ্টা কীভাবে কেটে গেল টের পেলাম না। জলযান ঘাটে ভিড়ল। যেন মধ্যযুগের ই্উরোপ থেকে আবার পা রাখলাম একুশ শতকের ব্যস্ত নগরীতে। বীর নাইট, সামন্ত রাজ দরবারের ঠাঁটঠমক, গীর্জার সুরেলা ঘণ্টা, বোট হাউজ, দুর্গ- সব যেন মোসার্টের সিম্ফনি হয়ে মিলেমিশে একক আনন্দের সুর হয়ে রইল। আমস্টারডামের ক্যানেল ক্রুজের সেই আড়াই ঘণ্টা আজও আমার স্মৃতিতে জলতরঙ্গের মতো বেজে ওঠে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়