ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সাংবাদিকতা জগতের আলোকবর্তিকা

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৮, ২ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাংবাদিকতা জগতের আলোকবর্তিকা

বজলুর রহমান

শাহ মতিন টিপু : বজলুর রহমান ছিলেন দেশপ্রেমিক সাংবাদিক, ছিলেন সাংবাদিকতা জগতের আলোকবর্তিকা। তার রাজনৈতিক জ্ঞান ও বিশ্লেষণ ছিল খুবই প্রখর। তার কণ্ঠ নমনীয় হলেও তিনি ছিলেন দৃঢ়চিত্তের মানুষ। যখন যেখানে যে কথা যতটুকু বলা দরকার, তা-ই তিনি বলতেন। সত্য ভাষণে তিনি ছিলেন আপোসহীন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন সোচ্চার। আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। বজলুর রহমানের ৭৫তম জন্মদিন আজ।

 

১৯৪১ সালের ৩ আগস্ট ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানার চরনিয়ামতপুর গ্রামে বজলুর রহমানের জন্ম। বজলুর রহমানের জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, শিশুসংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা- একাধারে অনেকগুলো পরিচয় তার। বজলুর রহমান ছিলেন সংস্কৃতি ও রাজনীতি মনস্ক সাংবাদিক। ষাটের দশকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং স্বক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এ সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র সাপ্তাহিক একতার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকে তিনি কিছুকাল দৈনিক ইত্তেফাক-এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।

 

১৯৬১ বজলুর রহমান দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। কিছুদিন পর তিনি সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। আমৃত্যু তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তার জীবনের একটি অনন্য গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এ সময় তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। তার অংশগ্রহণ ছিলো বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন, আটষট্টি-ঊনসত্তর-সত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে।

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অনিয়ম, গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধেও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে। এ ছাড়া ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববাংলার মুক্তিসনদ ৬ দফা দাবি ঘোষণা করার পর বজলুর রহমান তা সক্রিয়ভাবে সমর্থন এবং এর পক্ষে সামগ্রিক জনমত গঠনে প্রচারাভিযান চালান।

 

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ‘বাংলাদেশ আফ্রো-এশিয়া গণসংহতি পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অপরদিকে তিনি দৈনিক সংবাদ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের (১৯৭৩-১৯৭৫) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এ পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাব-এর সিনিয়র সহসভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। বজলুর রহমান ‘বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। সাংগঠনিক কর্মকা-ে নিষ্ঠতা থাকায় জীবনে অনেক সংগঠনেরই দায়িত্ব তাকে নিতে হয়েছিল।

 

তিনি সংবাদ-জগতের নানা সংগঠন ও সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংস্থা বাংলাদেশ শাখার সভাপতি (১৯৮৪), বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালনা পরিষদ এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত (১৯৯৭) হন। ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেস কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

 

সব ছাপিয়ে যে পরিচয়টি তাকে কোমলমতি শিশুদের মনে প্রোথিত করেছিল, তা হচ্ছে- তিনি ছিলেন শিশু সংগঠন ‘খেলাঘর’-এর সভাপতি। তিনি দৈনিক সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’ পাতার সম্পাদনা করেন, যাতে লক্ষ করা যায় তার শিশুমনের প্রতি গভীর আগ্রহ।

 

রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় এসে তিনি অর্থনীতি বিষয়ে বিস্তর লেখালেখি করেন। তবে তিনি এসব লেখার গ্রন্থরূপ দিয়েছেন কমই। তার প্রণীত বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল: ১৯৭৪-১৯৮৭ (২০১০) একটি মূল্যবান গ্রন্থ। এ গ্রন্থে ৩৯টি নিবন্ধ স্থান পেয়েছে, যাতে আলোচিত হয়েছে সমকালীন অর্থনীতির নানা সমস্যা। গ্রন্থটিতে যে-সমস্যাগুলি আলোচিত হয়েছে তারমধ্যে প্রধান বিষয় হচ্ছে দারিদ্র্য। তার মতে বাংলাদেশের উন্নয়নে দারিদ্র্যই প্রধান বাধা। তার মতে বিশ্বব্যাংকের করুণা-ঋণ এবং বিদেশের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের দারিদ্র্য নির্মূল করা সম্ভব নয়।

 

শিক্ষাজীবনে তিনি শেরপুর জেলার গণবর্দী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৫৬), ময়মনসিংহ জেলার আনন্দমোহন কলেজ থেকে আইএ (১৯৫৮), বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ (১৯৬১) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ২০১২ সালে সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। বর্তমান কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ছিলেন তারই সহধর্মিনী। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্র“য়ারি এই বরেণ্য কলম সৈনিক মৃত্যুবরণ করেন।

 

বজলুর রহমান স্মৃতিপদক ২০০৯ প্রদান অনুষ্ঠানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান তার ভাষণে বলেন, ‘বরেণ্য সাংবাদিক বজলুর রহমানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন অসাধারণ বিনয়ী, মৃদুভাষী কিন্তু আদর্শগত অবস্থানে অসম্ভব দৃঢ় একজন মানুষ। অনাড়ম্বর ও সহজ-সরল জীবনই ছিল তার পছন্দনীয়। তিনি কখনো অসত্য-অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না, করতেন না আপোস। ষাটের দশক থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাঙালির প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে তিনি ছিলেন সামনের কাতারের সাহসী সৈনিক।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ আগস্ট ২০১৫/টিপু/রণজিৎ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়