ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সাকরাইনের আগুন খেলা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাকরাইনের আগুন খেলা

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : আকাশ জুড়ে উড়ছে নানান রঙের শত শত ঘুড়ি, যেন রঙ বেরঙের প্রজাপতির সমাবেশ। ছাদে ছাদে সব বয়সী মানুষের ভিড়। শিশু-কিশোরেরা ব্যস্ত ঘুড়ি উড়াতে, বয়সীরাও বসে নেই, একদিনের জন্য তারাও ফিরে গেছেন কৈশোরে। ঘুড়ির নাটাই হাতে তৎপর তারা, দৃষ্টি আকাশের দিকে। ১৪ জানুয়ারি শনিবার, সাকরাইন উৎসবে সারাদিন পুরান ঢাকার পথে পথে, উঁচু ভবনের ছাদে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে সবার।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রঙের ডিজিটাল ও হেলোজেন লাইটে সজ্জিত করা হয় প্রতিটি বাসার ছাদ, পুরান ঢাকার আশপাশ এলাকার রাতের আকাশে উড়তে থাকে হাজার হাজার ফানুস ও আতশবাজির আলোকবিচ্ছুরণ ও বিকট শব্দে সরগরম হয়ে উঠে পুরো শহর। যেন ইন্দ্রপুরিতে বিয়ের আয়োজন চলছে, তাই আকাশ জুড়ে আলোকসজ্জা।

সাকরাইনে অন্য রকম আনন্দঘন সময় কাটায় শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত। পুরান ঢাকার মোটর পার্টস ব্যবসায়ী সেলিম (২৮)। তিনি বাসার ছাদে এসেছেন তার এক বছর বয়সী ভাগিনা রিহানকে নিয়ে। সেলিম বলেন, যখন ছোট ছিলাম, তখন বাবার সঙ্গে ছাদে এসে ঘুড়ি উড়াতাম। সাকরাইনের দিন আগের মতোই ঘুড়ি উড়াই, মজা করি। একজনের ঘুড়ির সঙ্গে অন্য জনের ঘুড়ির কাটাকাটি খেলা চলে। সুতা কেটে যার ঘুড়ি পড়ে যায়, সে হেরে যায়।

ফায়ার বক্সখেলা সাকরাইন উৎসবের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুখে কেরাসিন নিয়ে আগুন ফুঁ যেন এক ভূতুড়ে দৃশ্য। মুখে কেরাসিন নিয়ে আগুনের কাটিতে ফু দিলে হঠাৎ আগুনের কুন্ডলী ছড়িয়ে পড়ে। যদিও ফায়ারবক্স খেলা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একটু অসতর্কতায় পুরো শরীর আগুনে ঝলসে যেতে পারে।

প্রতি সাকরাইনে মুখে কেরাসিন নিয়ে আগুন ফুঁ দেন শুভ্র (২৩)। তিনি জানান, ফায়ারবক্সে সবচেয়ে মজা বেশি। কারণ এটা সবাই পারে না। ফায়ারবক্স খেলা দেখালে পুরো একদিন কেরাসিনের গন্ধে কিছুই খাওয়া যায় না।


সাকরাইন উৎসব পুরান ঢাকাবাসীর জীবনের অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। তাই প্রতি বছরই এ উৎসবকে ঘিরে থাকে তাদের নানা পরিকল্পনা আর থাকে অর্থনৈতিক আলাদা বাজেট।

পুরান ঢাকার ধোলাই খাল এলাকার একটি পাঁচ তলা বাসার ছাদে সাকরাইন উৎসবের আয়োজন করেছে ফাহিম, সানমুন ও তার বন্ধুরা। সানমুন জানান, সাউন্ড বক্স, হেলোজেন লাইট, আতশবাজি, ফানুস, খাবার দাবার সহ পুরো আযোজনে তাদের সাত বন্ধুর খরচ পড়ছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা।

প্রাচীনকাল থেকেই পৌষকে বিদায় জানাতে মাঘ মাসের প্রথমদিন পুরান ঢাকাইয়ারা আয়োজন করে সাকরাইন উৎসব। সাকরাইন উৎসব আজ পুরান ঢাকার বর্ণিল ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। পুরান ঢাকার লক্ষীবাজার, জুরাইন, সূত্রাপুর, ওয়ারী, বংশাল, বাবু বাজার, মিলব্যারাক, হাজারীবাগ, সদরঘাট, নবাবপুর, লালবাগ, চকবাজার এলাকায় এ উৎসব বেশি হয়ে থাকে। এ দিনটিতে আগুন নিয়ে খেলা ও আতশবাজির এবং ফানুস উড়ানোর মধ্য দিয়ে প্রথম প্রহর শুরু হয়। আর রাতভর চলে সাউন্ড বক্সের তালে তালে নাচ-গান পার্টি। আয়োজন করা হয় ভালো খাবার-দাবারের।

সাকরাইন দেখার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কৌতুহলী মানুষেরা ভিড় করে পুরান ঢাকায়। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ধানমন্ডি ক্যাম্পাসের চার শিক্ষার্থী অরবিন, অপু, রাসেল, সিমিন দল বেঁধে গিয়েছেন সাকরাইন দেখতে। তারা বলেন, সাকরাইন এক আতঙ্কের নাম। আতশ বাজির বিকট শব্দে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তৈরি হয়। মনে ভয় ধরে যায়।

সাকরাইন উৎসবের ইতিহাস
১৭৪০ সালের এই দিনে মোঘল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উড়ানো হয়। সেই থেকে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বর্তমানে এটি একটি অন্যতম উৎসব ও আমেজের পরিণত হয়েছে।

ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ না রেখে সকলে এই উৎসব পালন করে থাকেন। দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই উৎসব পালন করে পুরান ঢাকাইয়ারা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পৌষসংক্রান্তির এই উৎসব পালনের রীতি চালু আছে। পুরান ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তির উৎসব সাকরাইন নামে পালিত হলে নেপালে একে বলে মাঘি, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান, কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান এবং ভারতে মকরসংক্রান্তি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জানুয়ারি ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়