ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

উ প কূ লে র প থে

সাদা সোনার খোঁজে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ২৪ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাদা সোনার খোঁজে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ

পাইকগাছার চিংড়ির ঘের

রফিকুল ইসলাম মন্টু, খুলনার পাইকগাছা ঘুরে : পরিবেশ ধ্বংস করে সাদা সোনার সন্ধানে ছুটছে হাজারো মানুষ। জনবসতির প্রয়োজনে সবুজ প্রকৃতি থাকুক বা না থাকুক হাতে চাই প্রচুর টাকা।

চেনাজানা ছায়াঘেরা গ্রাম, গাছপালা, তরুলতা, গবাদিপশু, কৃষি আবাদ কিছুই থাকছে না। মাঠের পর মাঠ শুধু পানি আর পানি। যে জমিতে এক সময় নানা জাতের ধান হতো, সেখানে এখন চিংড়ি চাষ হচ্ছে ।

এই চিত্র খুলনার পাইকগাছার বিভিন্ন গ্রামের। সেখানকার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে পাওয়া যায় চিংড়ি চাষের প্রভাবে বহুমূখী ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র। এলাকাবাসী জানান, চিংড়ি চাষ তাদের অবস্থা কিছুটা বদলাতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু সেই ছায়াঘেরা সবুজ পরিবেশ এখন আর এ এলাকায় নেই।

পাইকগাছার লস্কর, সোলাদানা, লতা ও দেলুটিয়া ইউনিয়নে চিংড়ি চাষের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এছাড়া চাঁদখালী, বড়ইখালী, কপিলমুনি ও হরিঢালী ইউনিয়নেও কিছু কিছু এলাকায় চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে এই ইউনিয়নগুলো বাদে বাকি এলাকার চেহারা একেবারেই ভিন্ন। গদাইপুরসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবুজ ধানক্ষেত যেন সেখানে নবান্নেরই আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।


পাইকগাছা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানিয়েছে, দশ বছর আগে উপজেলায় ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হতো। চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হওয়ায় আবাদি জমির পরিমাণ কমে ১৬ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। অন্তত ১৩ হাজার কৃষক এই পেশা থেকে অন্য পেশায় ফিরেছে। চিংড়ি চাষের জমিতে অধিকাংশ সময় লবণ থাকায় মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে ফিরতে চিংড়ি ও ধানের সমন্বিত চাষের উদ্যোগ নিতে হবে।

পাইকগাছার লস্কর ও সোলাদানা ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লবণাক্ততার কারণে খাবার পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। কয়েক কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে কিংবা ভ্যানে পানি সংগ্রহ করতে হয়। গবাদিপশু, হাঁসমুরগি, ভেড়া, ছাগল নেই। বাড়ির আঙিনায় আগে সবজি হতো, সবজি বাজার থেকে কিনতে হতো না। এখন বাজার থেকে উচ্চমূল্যে সবজি কিনতে হচ্ছে।

সোলাদানা ইউনিয়নের খালিয়ার চর গ্রামের বাসিন্দা রমেন্দ্র নাথ মন্ডল জানান, তার ছিল বিশাল বাগানের বাড়ি। বাড়িতে সব ধরণের ফলদ গাছপালা ছিল। জন্মাতো প্রচুর পরিমাণে সবজি। বাজার থেকে কিছুই কিনতে হতো না। এখন পানি থেকে শুরু করে সবই কিনতে হচ্ছে।

এলাকায় চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হওয়ায় রমেন্দ্র নাথ মন্ডল নিজেও কৃষি পেশা থেকে সরে এসেছেন। চার একর জমির মধ্যে তিন একর চিংড়ি চাষের জন্য লিজ দিয়েছেন। বাকি এক একর জমিতে নিজেই চিংড়ি চাষ করেন।


তিনি বলেন, ‘এক সময় জমিতে ধান আবাদ করেই আমাদের জীবিকা চলতো। কিন্তু এখন তো সে পরিবেশ নেই। চিংড়ি চাষ কাউকে সম্পদশালী করেছে, আবার কাউকে করেছে ভিখারী।’

সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চিংড়ি চাষ এলাকার ভেতরে ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন বাড়িঘর। বাড়ির আঙিনা, স্কুলের বারান্দা পর্যন্ত পানি থাকছে সব সময়। বাড়ির উঠান নেই, স্কুলে নেই খেলার মাঠ। গাছপালার সংখ্যা খুবই কম। এ যেন ভিন্ন পরিবেশ। এইসব এলাকার মানুষ জানালেন, শুধু লবণ পানির কারণে নয়, সারা বছর জমি পানিতে ডুবে থাকায় মাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শালিক, কাক, বক, ঘুঘু, সাপ, ব্যাঙ, শামুক এগুলো এখন আর এলাকায় দেখা যায় না। এলাকার ছেলেমেয়েরা এগুলো চেনে না।

পাইকগাছা ধান-মাছ-পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি আজমল হোসেন জানান, ছোট ছোট জমির মালিকেরা ঘের মালিকদের কাছ থেকে জিম্মি। লিজ দেওয়া জমি তারা ছাড়িয়ে আনতে পারছে না। ফলে এক সময় নিজের জমিতে চাষাবাদ করে কোনমতে বেঁচে থাকা পরিবারটি ভূমিহীনে পরিণত হচ্ছে। ফরিদপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ অঞ্চল থেকে এক সময় এই এলাকায় কৃষি মজুরেরা ধান কাটতে আসতো, আর এখন এই এলাকা থেকে মানুষ ধান কাটতে অন্যত্র যায়।

সোলাদানা চৌরাস্তায় কথা হচ্ছিল চিত্তরঞ্জন মন্ডল, উজ্জল পালা, কল্যাণ কুমার সানাসহ অনেকের সঙ্গে। তারা বলেন, ‘জানি পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। তারপরও চিংড়ি চাষ না করে পারছি না। ধান আবাদে এখন অনেক খরচ। অনেক সময় উৎপাদন খরচও ওঠে না। চিংড়ি চাষ কখনো কখনো মার খেলেও তাতে ততটা লোকসান হয় না। ধানের চেয়ে বরং আমরা চিংড়ি চাষ করেই ভালো আছি।’                  

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জানুয়ারি ২০১৭/টিপু/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়