ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সাধুসঙ্গে কবি নজরুল || মোসতাফা সতেজ

মোসতাফা সতেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৪ মে ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাধুসঙ্গে কবি নজরুল || মোসতাফা সতেজ

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

কবি কাজী নজরুল ইসলামের শৈশব থেকেই টান ছিল সাধু-সন্যাসীর ওপর। শৈশবেই তিনি পিতার পরিত্যক্ত মাজার শরীফ ও মসজিদের দেখভাল করেছেন। হয়তো এই সময় থেকেই তাঁর মনে ধর্মীয় অনুভূতি অঙ্কুরিত হতে থাকে। কিশোরকালে তিনি মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন। দু’চার দিন পর ফিরে এলে শোনা যেত তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে সাধু-সন্যাসী বা কোনো ফকিরের সঙ্গ লাভ করে এসেছেন। সাধুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কথা তিনি বর্ণনাও করেছেন। এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন :

‘যে সত্য সৃষ্টির আদিতে ছিল, এখনও রয়েছে এবং অনন্তেও থাকবে- এই সত্যটাকে যখন মানি তখন আমাকে যে ধর্মে ইচ্ছে ফেলতে পারে না। ... আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিস্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম। আমি তো ধর্মের বাইরের (সাময়িক, সত্যরূপ) খোলাসটাকে ধরে নেই। গোঁড়া ধার্মীকদের ভুল তো ঐখানেই; ধর্মের আদত সত্যটা না খুঁজে ধরে আছেন যতসব নৈমিত্তিক বিধি বিধান। এরা নিজের ধর্মের উপর এত অন্ধ অনুরক্ত যে কেউ এতটুকু নাড়াচাড়া করতে গেলেও ফোঁস করে ছোবল মারতে ছোটেন।’

তৎকালীন চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখে একদিকে তিনি লিখেছেন শ্যামাসংগীত, বৃন্দাবন গীত, আগমনীসংগীত, শিবসংগীত, কীর্তন, ভক্তিগীতি ও ভজন। অপরদিকে লিখেছেন ইসলামী গজল। ব্যাখ্যা দিয়েছেন তৌহিদের একশ্বরবাদের।

প্রথম মহাযুদ্ধের সময় করাচী সেনানিবাস থেকে কলকাতায় ফিরে এসে তিনি পুরোদমে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। অল্প দিনের মধ্যেই কবি সাহিত্য প্রতিভায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠেন। এই আলো পৌঁছে যায় রাজনৈতিক মজলিসে, সাহিত্যিক আড্ডায় এমনকি সাধু সন্যাসীদের আখড়াতেও। ফলে নজরুল এই শ্রেণীর মানুষেরও স্নেহলাভ করেন। অনেক সময় সাধুরাই শিষ্যদের পাঠিয়ে নজরুলকে ডেকে পাঠাতেন। অনেক থেকে একের পথে যে পর্যটন তা পরিপূর্ণ হয় সাধুসঙ্গের প্রবর্তনায়। তাই ধোঁয়া দেখলেই আগুন অনুসন্ধানী নজরুল ছাই সরিয়ে দীপগর্ভ কিছু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছেন। তিনি ছিলেন  পথিক এবং আগ্রহী। সাহিত্য পথে তার জিজ্ঞাসা চিরজাগরুক। কিন্তু সাধুদের কাছে তিনি কী জানতে চেয়েছেন? কী পেয়েছেন? তা আমাদের অজানা। তারপরও অনুভব করা যায় তিনি মনের জোর পেয়েছিলেন। স্বতন্ত্র বেগ পেয়েছিলেন বলেই কুসংস্কারের বিধি নিষিধের বেড়া অকুতোভয়ে ডিঙিয়ে গেছেন।

একবার চট্টগ্রামের স্বনামধন্য সাধু তারাচরণ গিয়েছেন কলকাতায়। তার  শিষ্য মতিলাল রায় একদিন নজরুলের কাছে গিয়ে গুরুর আহ্বান নিবেদন করেন। সময় সুযোগ বুঝে কবি তাকে একটি দিন দেন। সে অনুযায়ী মাতিলাল এসে কবিকে নিয়ে গেলেন বালিগঞ্জের একটি বাড়িতে। নজরুলকে দেখা মাত্র তারাচরণ দাঁড়িয়ে নজরুলকে অভ্যর্থনা জানান। দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন সাধু নজরুলের ভেতরে কিসের আলো দেখেছিলেন তা তিনিই জানেন। ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে কাজী নজরুল ইসলাম আধ্যাত্মিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। মুজাফ্‌ফর আহমদ লিখেছেন : ‘নজরুল ইসলামের আধ্যাত্মিকতার পুরো যুগটাই আমি তার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। বিচ্ছিন্ন না থাকলেও তাকে হয়তো এই পথ হতে ফেরাতে পারতাম না। কিন্তু চেষ্টা তো করতে পারতাম।’  

১৯৩৮-৩৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানিতে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে কবির স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়তে শুরু করে। এরই মধ্যে তখন তিনি শুরু করেন আধ্যাত্মিক যোগ সাধনা,  তন্ত্র-মন্ত্রের অলৌকিক জগতে বিচরণ। একদিন কলকাতার বরাহ নগরের যোগেন্দ্র বসাক রোড থেকে একজন ভদ্রলোক গিয়ে নজরুলকে  অনুরোধ করলেন তার গুরুর কাছে যাবার জন্যে। গুরুর নাম নিরালম্ব স্বামী। নজরুল তার সাথে দেখা করতে যান। প্রণাম করেন। স্বামীজী পরম স্নেহভবে নজরুলকে গ্রহণ করলেন। তার অনুরোধে কবি অনেকগুলো গান পরিবেশন করেন। স্বামীজীর আশীর্বাদ ও গৃহস্থের আপ্যায়নে পরিতৃপ্ত হয়ে কবি সেদিন ঘরে ফেরেন।

অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ কাজী নজরুল ইসলাম জানতেন, নদী, গাছ আর প্রকৃত সাধুর স্বভাব একই রকম। সাধুর বচনে আর দেখানো সত্যে অনেকেই উপকৃত হন। কলকাতার ঝামা পুকুরে এক শিষ্যবাড়িতে অবস্থান করছিলেন সাধু নৃপেন্দ্রনাথ। তিনি স্মরণ করলেন নজরুলকে। একজন ভক্ত এসে কবিকে নিয়ে গেলেন তার কাছে। নজরুল গিয়ে দেখলেন প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন ঘর। মেঝের উপর বসে আছে ভক্তের দল। ঘরের এক কোণায় একটি কার্পেটের আসনে বসে আছেন নৃপেন্দ্রনাথ। পরম সমাদরে তিনি নজরুলকে স্বাগত জানান। ভক্তকে আদেশ করলেন নজরুলের জন্যে একখানি স্বতন্ত্র আসন দেয়ার। নৃপেন্দ্রনাথের স্নেহে, সমাদরে ও সদালাপে তৃপ্ত হয়ে নজরুল বিদায় নেন।

আরও কয়েকজন সাধুসন্তের সঙ্গলাভ করেছেন নজরুল। সাধুমনস্ক নজরুল নিজেই বলেছেন : ‘যিনি আমায় চালাইতেছিলেন সেই অদৃশ্য সারথি আমায় চলিতে দিলেন না। লেখার মাঝে, বলার মাঝে সহসা প্রকাশিত হইয়া পড়িত সেই অদৃশ্য সারথির কথা। নিজেই বিস্মিত হইয়া ভাবিতাম। মনে হইত তাঁহাকে আমিও দেখি নাই ; কিন্তু দেখিলে চিনিতে পারিব। এই কথা বহুবার লিখিয়াছি ও বহু সভায় বলিয়াছি।’

জীবনের মধ্যাহ্নকালে প্রথম জীবনের জীবনাদর্শ থেকে তিনি সরে এসে আধ্যাত্মিকতায় বাধ্য হয়েছিলেন। দারিদ্র্য, অপমান, শোক, অপবাদের মানসিক পীড়ন থেকে মুক্তির জন্যে তিনি হয়তো এমুখো হন একটু শান্তির জন্যে। মুর্শিদাবাদ জেলার একটি গ্রামের নাম নিমতিতা। গ্রামের জমিদার বাড়ির এক মেয়ের বিয়ে। পাত্র কলকাতা হাইকোর্টের উকিলের ছেলে। বরযাত্রী হয়ে কবি নিমতিতায় যান। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে সারথির কথা। কবি এই গ্রামে গিয়ে সারথির দেখা পেয়ে লেখেন : ‘সহসা একদিন তাহাকে দেখিলাম। নিমতিতা গ্রামের এক বিবাহ সভায় সকলে বর দেখিতেছে, আমার ক্ষুধাতুর আঁখি দেখিতেছে আমার প্রলয় সুন্দর সারথীকে। সেই বিবাহ সভায় আমার বধূরূপিনী আত্মা তাহার চিরজীবনের সাথীকে বরণ করিল। অন্তঃপুরে মুহুর্মুহু শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, হইতেছে; চন্দনের শুচি সুরভি ভাসিয়া আসিতেছে; নহবতে সানাই বাজিতেছে এমনি শুভক্ষণ আনন্দবাসরে আমার সে ধ্যানের দেবতাকে পাইলাম। তিনি শ্র্রী শ্রী বরদাচরণ মজুমদার মহাশয়। আজ তিনি বহু সাধকের পথ প্রদর্শক।’

বরদাচরণ মজুমদার ছিলেন নিমতিতা গ্রামেরই ছয় মাইল দূরবর্তী কাঞ্চনতলা গ্রামের অধিবাসী। সে সময় তিনি লালগোলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। গৃহীযোগী। তার যোগ শক্তির কথা তখন জনা কয়েক অন্তরঙ্গ ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বরদাচরণ গুরুবাদী ছিলেন না। তার কাছে যে সব অধ্যাত্মসাধন পিপাসু ব্যক্তিরা যেতেন সবার সামনেই তিনি তাদের নির্দেশ দিতেন। বরদাচরণ মাঝে মাঝে কলকাতায় গিয়ে ভবানীপুরের মোহিনী মোহন রোডে থাকতেন। সে সময় নজরুল ও আরও অনেকে বরদাচরণের কাছে যেতেন। তেমনি বরদাচরণও গিয়েছেন কবি নজরুলের ভাড়া বাড়িতে। দুজনের মধ্যে আত্মিক সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল। এ প্রসঙ্গে নজরুল লেখেন :

‘সারাজীবন ধরিয়া বহু সাধু সন্যাসী, যোগী, ফকির, দরবেশ খুঁজিয়া বেড়াইয়া যাহাকে দেখিয়া আমার অন্তর জুড়াইয়া গেল, আলোক পাইলো, তিনি আমাদেরই মত গৃহী। এই গৃহে বসিয়াই তিনি মহাযোগী শিবস্বরূপ হইয়াছেন। এই গৃহের বাতায়ন দিয়াই আসিয়াছে তাহার মাঝে বৃক্ষ জ্যোতি।... আমার যোগসাধনার গুরু যিনি তাঁহার সম্বন্ধে বলিবার ধৃষ্টতা আমার নাই। সে সময়ও আজ আসে নাই। আমার যাহা কিছু শক্তির প্রকাশের আধার মাত্র তাহাকে জানাইবার আজ আদেশ হইয়াছে বলিয়াই জানাইলাম।’

পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশিত ১৯৭২ সালের অক্টোবরে ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় নলিনী কান্ত সরকার (১৮৮৯-১৯৮৪) তার এক লেখায় জানান, বরদাচরণের ১৯৪০ সালের ১৮ নভেম্বর জীবনাবসান ঘটে। এর দেড় বছরেই মধ্যেই ১৯৪২ সালে কাজী নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর ছেলে বুলবুলের মৃত্যুর পর থেকে নজরুলের মধ্যে অধ্যাত্ম সাধনার যে প্রবণতা দেখা যায় প্রমীলার অসুস্থতার পর থেকে তা আরও বেড়ে যায়। পরলোক নিয়েও তিনি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মে ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়