ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সূর্য মন্দির ও বেইজিংয়ের ভেতর রাশিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সূর্য মন্দির ও বেইজিংয়ের ভেতর রাশিয়া

(চকবাজার টু চায়না : পর্ব-২৪)

শান্তা মারিয়া : এলাকাটিতে পৌঁছে চমকে উঠতে হয়। সড়কের পাশে দোকানে দোকানে রুশ ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড। দোকানের শোকেসে শোভা পাচ্ছে সে দেশের পণ্য। রাস্তায় রাশিয়ান খাবারের রেস্টুরেন্ট। পথে যাদের চোখে পড়ল তাদের অনেকেই রাশিয়ান। এলাকাটি দূতাবাস অঞ্চল সানলিথুন থেকে বেশি দূরে নয়। এটি বেইজিংয়ের ছাওইয়াং ডিসট্রিক্ট-এ।

 

চীন আন্তর্জাতিক বেতার ভবন ও বিদেশী কর্মীদের বাসভবন হলো শিজিংশানে। জায়গাটি সাবওয়েতে এক নম্বর লাইনের কাছে বাবাওশান স্টেশনসংলগ্ন। এই এক নম্বর লাইনেরই একেবারে পূর্ব দিকের একটি স্টেশন হলো ইয়োংআনলি। সেই স্টেশন থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসও বেশ কাছে। এই স্টেশনের কাছে চিংগুয়ামেন এলাকাতেই রিথান পার্ক ও রুশীদের বসবাস।

 

বেইজিংয়ের এক গ্রীষ্মে মনে হলো এমন পার্ক খুঁজে বের করতে হবে যেখানে সচরাচর পর্যটকরা যায় না। ট্রাভেল চায়নাতে খুঁজে দেখলাম রিথান পার্কের নাম। চীনা ভাষায় ‘রি’ মানে সূর্য। এটা হলো সূর্য মন্দির ও সেই মন্দিরসংলগ্ন পার্ক। বেইজিংয়ে আমি পৃথিবী মন্দির, স্বর্গ মন্দির আর চন্দ্র মন্দিরে গেছি। তাহলে সূর্য মন্দির বাদ থাকে কেন। সত্যি কথা বলতে কি বেইজিংয়ে বৌদ্ধ ধর্মের এবং লোকজ ধর্মের যে মন্দিরগুলো রয়েছে তার অনেকগুলোতেই আমি ঘুরে দেখেছি। চমৎকার পরিবেশ। ভেতরে একটা শান্তির স্পর্শ যেন পাওয়া যায়। আর প্রতিটি মন্দিরের সঙ্গেই থাকে পার্ক ও জলাশয়। ফলে এত সুন্দর শান্তির আমেজে সময় কাটে যে মনে হয় এখানেই বসে থাকি একটি কবিতার বই হাতে নিয়ে।

 

রিথান পার্কে প্রবেশের জন্য কোনো টিকেটের বালাই নেই। ফলে পকেটের পক্ষেও বিষয়টি স্বাস্থ্যকর। একদিন সকালে রওনা হলাম রিথান পার্কের উদ্দেশ্যে।সাবওয়ে থেকে বের হয়ে খুঁজে পেতেও দেরি হলো না। বেশ বড় পার্ক। ১৫৩০ সালে এখানে সূর্য মন্দির স্থাপিত হয়। সেটা মিং রাজবংশের শাসনামল। এখানে তখন সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে পূজা ও অর্ঘ্য নিবেদন করা হতো। বলিও হতো। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে বেশ শীতল স্পর্শ পাওয়া গেল। সবুজ গাছপালায় ঘেরা পার্ক।

 

এখানে রয়েছে মন্দির এবং বলি দেয়ার বেশ বড় একটি স্থান। সেই বড় বাঁধানো স্থানটিকে ঘিরে আছে ছোট ছোট গেট। এগুলো সব তারাদের প্রতীক। মাঝের বাঁধানো চত্বরটিতে সূর্যদেবের ছবি আঁকা রয়েছে। এক সময় এখানে চীনের সম্রাটরা জাকজমকভাবে আসতেন এবং সূর্য পূজা করতেন ঘটা করে। সেই রাজকীয় বিলাসের চিহ্নও রয়েছে পার্কের ভেতর। তোরণটি অসাধারণ সুন্দর কারুকার্যে শোভিত। সূর্যদেবের মন্দিরে এসেছি। এখানে সূর্যের তাপ বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। প্রথম দিকে সূর্যের প্রতাপ সহনীয় ছিল। তবে এখন একটু বেশিই মনে হচ্ছে। অবশ্য এখানে বসার জন্য ছাউনি দেয়া ঘরও রয়েছে। চীনা পার্কের যা বৈশিষ্ট্য।

 

মাথার উপরে গরমকালের শক্তিশালী সূর্য। তাই একটু ছায়াতে বসার আশায় পার্কের ভেতর দিকে হাঁটছিলাম। তখনই দেখছিলাম অনেক রাশিয়ান এখানে বেড়াতে এসেছেন। সঙ্গে ছোট ছোট পুতুলের মতো সুন্দর শিশু।

 

পার্কের ভেতর সুন্দর একটি জলাশয়। পানিতে পদ্মফুল ফুটে আছে। এটাও বেশ সাধারণ ব্যাপার। চীনে পার্কের জলাশয়ে পদ্মফুল থাকবেই। এখানে আরেকটি মজার ব্যাপার চলছে দেখলাম। জলাশয়ের পাশে ছোট ছোট পাত্র নিয়ে বসে আছেন কয়েকজন চীনা। সেই পাত্রে জীবন্ত মাছ। সঙ্গে ভাড়া হচ্ছে ছিপ ও বড়শি। কী ব্যাপার? একটু পর বুঝতে পারলাম বিষয়টা। মাছ ধরার আনন্দ পেতে চান আপনি। অথচ আপনার কাছে ছিপও নেই, বড়শিও নেই, এমনকি পুকুরেও মাছ আছে কিনা তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তাহলে কী করবেন? এখান থেকে ছিপ, বড়শি, মাছ-তিনটিই ভাড়া নিন। তারপর মাছগুলোকে পুকুরে ছাড়ুন। সেখান থেকে আবার নিজেই বড়শি দিয়ে সেগুলো ধরুন। তারপর সবসহ ফেরত দিয়ে দিন ফেরিওয়ালার কাছে। এমন মজার কাণ্ড জীবনে দেখিনি। দশ ইউয়ান মাত্র ভাড়া। রাশিয়ান এবং অন্য শ্বেতাঙ্গ বিদেশীরা তিন-চারটি করে মাছ ভাড়া করছে। তারপর বড়শি দিয়ে ধরে আবার ফেরত দিচ্ছে। এই না হলে ব্যবসা! আমারও মাছ ভাড়া নেবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শিহাবুর রহমান এক ধমক দিল। এই ভাবে পয়সা নষ্ট করা নাকি বোকামো।

 

এর কাছাকাছি রয়েছে একটি ছোট্ট শিশুপার্ক। এর ভেতর বেশ কয়েকটি রাইড রয়েছে। সবই বিনে পয়সায়। চীনা ও ভিনদেশী শিশুরা খেলছে। ইচ্ছা হলে বড়রাও চড়তে পারে কোনো মানা নেই। এ ধরনের রাইডে চড়তে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে। তাই সুযোগটা না নিয়ে পারলাম না।

 

একটু এগোতেই আরেকটি বড় লেক চোখে পড়লো। এখানে অবশ্য মাছ ধরার সেসব ব্যবসা চলছে না। কারণ এত বড় লেকে মাছ ছাড়লে হারিয়ে যেতে পারে। এই লেকটার তীরে গাছের ছায়ায় বসে রইলাম দুজনে অনেকক্ষণ। ততোক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে। বাড়ি থেকে আনা রুটি আর কাবাব খতম। এদিকে বেশ খিদেও পেয়েছে। পথ খুঁজে খুঁজে বের হলাম অন্য একটি গেট দিয়ে। তারপরেই চোখে পড়লো দোকানপাটের রুশ ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড। কী ব্যাপার বেইজিং থেকে কি সোজা রাশিয়ায় পৌঁছে গেলাম সূর্যদেবের কল্যাণে?

 

 

এখানে বড় একটি ভবনের সামনে চোখে পড়লো বিশাল এক ভাস্কর্য। ছুটন্ত ঘোড়ার অবয়ব। ভাস্কর্যের ধরনটাও রাশিয়া ঘরানার। এই এলাকার চলতি নাম রাশিয়া টাউন। এখানে প্রায় সত্তর হাজার রাশিয়ান বাস করেন। এখানে ইয়াপাও নামে একটি শপিং মল রয়েছে যেখানে সে দেশের জিনিসপত্র বিক্রি হয়। আরও অনেক দোকানপাট আছে। সবই রাশিয়ান ভাষায় লেখা সাইনবোর্ডযুক্ত। এখানে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্টে ককেশাসের খাবার পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, সেখানে বিউটি পার্লারেও কাজ করেন অনেক রাশিয়ান।  এমনকি এখানকার রিকশাচালকরাও রুশ ভাষা বোঝে।

 

চীন ও রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অনেক পুরোনো। মঙ্গোলিয়ার সীমান্ত নিয়ে সোভিয়েত আমলে একবার ঝগড়াঝাটি হলেও পরে সেসব মিটে গেছে। অনেক রাশিয়ান চীনে বাস করেন বিভিন্ন কাজে। বেইজিং থেকে সরাসরি মস্কোতে ট্রেন যোগাযোগ রয়েছে। বেইজিংয়ে ব্যবসা, চাকরি, কূটনৈতিক কাজ এবং আরও অন্যান্য কারণে বাস করেন রাশিয়ানরা। কূটনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সানলিথুনের কাছেই এই এলাকা তারা বেছে নিয়েছেন বসতি গড়ার জন্য। এখানে রুশ ভাষায় রেডিও এবং টিভি চ্যানেলও শোনা যায়, দেখা যায়।

 

প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর আগে শখ করে রুশ ভাষা শিখেছিলাম আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে। সব ভুলে গেলেও একটু আধটু রুশ ভাষা পড়তে পারি এখনও। তাই দোকানের সাইনবোর্ডগুলো পড়তে পারলাম চেষ্টাচরিত্র করে। আর এই এলাকার রাশিয়ান সালাদ, রাশিয়ান স্যুপ এবং ভেড়ার মাংসের পুর দেওয়া বড় সামোচা সত্যি অপূর্ব সে কথা জানিয়ে রাখছি।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়