ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সেই সন্ধ্যার স্মৃতি ও জিন্দাবাহার || বিশ্বজিৎ চৌধুরী

বিশ্বজিৎ চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৮ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেই সন্ধ্যার স্মৃতি ও জিন্দাবাহার || বিশ্বজিৎ চৌধুরী

ইমদাদুল হক মিলন

ইমদাদুল হক মিলন বললেন, ‘এবার আত্মজীবনী লিখতে হবে। বুড়ো হয়েছি। বুড়োরা আত্মজীবনী লেখেন।’

শুনে চমকে উঠেছিলাম। মিলন বুড়ো হয়েছেন, আত্মজীবনী লিখবেন!

তাহলে তাঁর উপন্যাসে যে তরুণদের চিনেছি আমরা, কিছুটা লেখকের নিজের জীবনের ছায়া, কিছুটা বা কল্পনা- এরকম ভেবে নিয়েছিলাম, তাঁরাও কি বুড়ো হয়ে গেল!

নাহ্, জুয়েল, বিনু, নীলু, মিমি, অলি, চুমকি, মিলুরা বুড়ো হয়নি, হতে পারে না। সে রকম হলে তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য কল্পনা করে যে তরুণ-তরুণীরা আলোড়িত হয়েছে, রোমাঞ্চিত হয়েছে, তাদেরও যে বার্ধক্য মেনে নিতে হয়। গতযৌবনের দিকে তাকিয়ে কেন আমরা দীর্ঘশ্বাসের দিনযাপন করব?

 

চট্টগ্রামে এসেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। ‘বাতিঘর’ তাঁকে নিয়ে আয়োজন করেছিল ‘আমার জীবন আমার রচনা’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানের। বইয়ের বিশাল সংগ্রহের জন্য, বই কেনা বা পড়ার ততোধিক সুন্দর পরিবেশের জন্য চট্টগ্রামের ‘বাতিঘর’ নামের বই বিপণিকেন্দ্রটি ইতিমধ্যেই দেশের বইপ্রেমী মানুষের প্রিয় পর্যটন হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি লেখকেরা এসেছেন এখানে। কথা বলেছেন পাঠকদের উদ্দেশে। পাঠকের কথা শুনেছেন, তাঁদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদুজ্জামান নূর, বিক্রম শেঠ, জিয়া হায়দার রহমান, রণজিৎ দাশ, সলিমুল্লাহ  খান, শাহাদুজ্জামান, সুবোধ সরকারের মতো কবি-লেখক-শিল্পীরা এখানে অনুরাগী পাঠক-শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের জীবন ও কর্ম নিয়ে কথা বলেছেন, পাঠকের প্রতিক্রিয়া জেনেছেন। বিদেশে অভিজাত বই বিপণিতে এরকম আয়োজন হয় বলে শুনেছি। বাংলাদেশে ‘বাতিঘর’ ছাড়া আর কোথাও কি হয়? আমি জানি না।

 

যাই হোক, এক সন্ধ্যায় ইমদাদুল হক মিলনের কথা শুনতে জড়ো হয়েছিলেন নানা বয়েসী শ দেড়েক মানুষ। নবীন-প্রবীণ লেখক-কবিরা ছিলেন। সিরিয়াস সাহিত্যের পাঠক ছিলেন। আবার সাহিত্য বিষয়ে উচ্চবাচ্য করার সাহস বা সামর্থ্য নেই এমন অনেকেও এসেছিলেন শুধু প্রিয় লেখককে একবার স্বচক্ষে দেখার কৌতূহল নিয়ে। সে এক মনোরম সন্ধ্যা।

 

নিজের জীবন ও সাহিত্য চর্চা নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন ইমদাদুল হক মিলন। সত্যি কথা বলতে কী, এত গুছিয়ে নিজের উত্থান-পতনময় জীবন, আশা-আনন্দ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ব্যর্থতা-অতৃপ্তির কথা বললেন তিনি, সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত দর্শকদের জন্য তা এক বিরল অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা, লেখালেখির সূচনাপর্ব, জীবিকার টানাপোড়েন, অর্থ উপার্জনের জন্য বিদেশ যাওয়া, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, ফিরে আসা এবং শেষ পর্যন্ত শুধু লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহের অদম্য আকাঙ্ক্ষা- অকপটে সবই জানালেন তিনি। সেই জীবনের দিকে তাকালে দুঃখ-সংগ্রাম, ভালোবাসা, অপমান-অপ্রীতির অনেক স্মৃতি ফিরে আসে। কিন্তু কোথাও গ্লানি নেই। সেই জীবন অস্বীকার করার, ভুলে যাওয়ার কোনো চেষ্টা নেই। বরং নানা রঙে পুরো জীবনটাই উপভোগ্য। নানা অভিজ্ঞতা তাকে ঋদ্ধ করেছে, বিষয়-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর সাহিত্য। অর্থের বিনিময়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কীভাবে প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়েছেন পাণ্ডুলিপি এ কথা স্বীকার করে বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোথাও লেখক-প্রকাশক এমন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন কি না জানি না, কিন্তু আমার লিখতে হয়েছে।’

 

এ ধরনের চুক্তির চাপে হয়তো অনেক সময় নিজের সেরাটা দিতে পারেননি। আখ্যান, ভাষা বা চরিত্রের প্রতি অবিচারও হয়েছে। কিন্তু সেইসব উপন্যাস জনপ্রিয় হয়েছে। ‘ভালোবাসার সুখ-দুঃখ’ ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ ‘যত দূরে যাই’  ‘সবুজ পাতা’  ‘তুমি আমার’পড়ে যে তরুণ-তরুণীরা ভালোবাসতে শিখেছে, তাদের কাছে সাহিত্য-সমালোচকের ভ্রুকটির মূল্য কতটুকু?

 

মিলন বলেছেন, ‘টাকার জন্য লিখতে হয়েছে। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’র মতো উপন্যাস পাঠক পড়ে। পরে হয়তো ভুলেও যায়, ফেলে দেয়। কিন্তু পড়ে তো। এই পাঠের কিন্তু একটা মূল্য আছে।’

 

নিশ্চয় আছে। মূল্য আছে। নিজের যৎসামান্য পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- নীহারঞ্জন গুপ্ত, নিমাই ভট্টাচার্য, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় বা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় পড়ে বড় হয়েছি আমরা। ধীরে ধীরে সেই পাঠ-পরিধির বিস্তার ঘটেছে। দেশ-বিদেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে বোধ ও অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু শৈশব-কৈশোরের সেই ‘মেমসাহেব’ ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ‘বালিকা বধূ’ বা ‘খড়কুটো’পাঠের আনন্দময় স্মৃতি তো উপেক্ষা করতে পারি না। আবার এখন নতুন করে সেই সব সাহিত্যের মূল্যায়ন করতেও বসি না।

 

সেই সন্ধ্যায় যে অল্পবয়েসী পাঠকেরা উপস্থিত ছিলেন ইমদাদুল হক মিলনকে শোনার জন্য, জানার জন্য, তাঁরা নানা ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসের ঘটনা উদ্ধৃত করে, বিভিন্ন চরিত্রের নাম উল্লেখ করে এমন সব প্রশ্ন তুলেছেন, তাতে বোঝা যায় কী নিবিড় মনোযোগে তাঁরা পাঠ করেছেন এসব উপন্যাস। মিলন তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন আন্তরিকভাবে, স্বভাবসুলভ সরস ভঙ্গিতে।

 

নিজের বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘হয়তো আমার প্রতিভা কম। মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর, সতীনাথ ভাদুড়ি, এমনকি সুনীল-সমরেশের ধারেকাছেও হয়তো যেতে পারিনি। কিন্তু এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করিনি কখনো।’

 

 ইমদাদুল হক মিলন, পাশে বিশ্বজিৎ চৌধুরী

 

তাঁর এ বিনয় যথার্থ। কিন্তু আমরা ভুলে যাব না ইমদাদুল হক মিলন ‘নূরজাহান’ ‘যাবজ্জীবন’ ‘কালোঘোড়া’  ‘নদী উপখ্যান’ বা ‘পরাধীনতা’র মতো উপন্যাস লিখেছেন।

 

বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র হয়ে বিমল মিত্র, শংকর পড়া এদেশের মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠকের কাছে কেন রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, মাহমুদুল হক বা শওকত আলী বিপুলভাবে সমাদৃত হয়ে উঠলেন না তা গবেষণার বিষয় হতে পারে। কারণ গভীর জীবনবোধ ও তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার পাশাপাশি পাঠস্বাদুতা বা বিষয় বৈচিত্র্য যদি পাঠকপ্রিয়তার নিয়ামক হিসেবে ধরে নিই, তাঁদের রচনায় এর কোনোটির অভাব নেই। কিন্তু এ কথা আজ অস্বীকার করা যাবে না বাংলাদেশে বাজার-চলতি উপন্যাসের যে ধারা, তার সূচনা হয়েছে ইমদাদুল হক মিলন ও হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। মিলনের উপন্যাস জনপ্রিয়তা পায় এমনকি হুমায়ূনেরও আগে। এ কথা হুমায়ূনেরই কোনো এক লেখায় পড়েছিলাম বলে মনে পড়ে। ‘বাজারি লেখক’ শব্দবন্ধটি আমাদের দেশে উন্নাসিকেরা উচ্চারণ করেন ভ্রু কুঁচকে। কিন্তু সারা বিশ্বে ‘বেস্টসেলার’ লেখকদের বিশেষ সমাদর আছে। প্রকাশককে বাঁচিয়ে রাখেন এই লেখকেরাই।

 

ইমদাদুল হক মিলন কেন আত্মজীবনী লিখছেন এ প্রশ্ন তুলে লেখাটা শুরু করেছিলাম। কিন্তু এ মুহূর্তে ডারিস স্ট্রাউসের ‘হাফ এ লাইফ’ (একই নামে ভি.এস নাইপলেরও একটি উপন্যাস আছে), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধেক জীবন’ বা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কথা মনে করে ভাবছি এই সব কটি রচনাই তো অর্ধেক বা অসমাপ্ত। ‘জীবন যখন ফুরায়ে যায়’ তখন আত্মজীবনী লেখা যায় না। যে কোনো জীবনীই তাই অর্ধেক বা অসমাপ্ত। এদিক থেকে বিবেচনা করলে হয়তো যথার্থ সময়ই বেছে নিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন। এবং সম্ভবত সে কাজটি তিনি ইতিমধ্যে শুরু করেছেন। ‘প্রথম আলো’র ঈদ সংখ্যায় (২০১৫) লেখা ‘মনে আছে, জিন্দাবাহার’ উপন্যাসটি পড়ে মনে হলো এটি তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব।

 

পুরোনো ঢাকার জিন্দাবাহার থার্ডলেনের সাত নম্বর বাড়িতে একটি শিশুর বেড়ে ওঠার গল্প তরতর করে এগোয়। সেখানে অজস্র চরিত্র এসে ভিড় করে। নিজের পরিবারের মানুষগুলো, প্রতিবেশীদের জীবন যেভাবে তুলে এনেছেন মিলন তাতে আখ্যান পাঠের আনন্দ আছে। কিন্তু আভাসে ইঙ্গিতে ইতিপূর্বে তাঁর জীবন সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি আমরা, তাতে মনে হয় একদিন এই বালক মিলুই লেখক ইমদাদুল হক মিলন হয়ে উঠবেন।

 

পুরোনো ঢাকার ঘিঞ্জি গলিটি, তার পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ, দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া এখানকার নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন বাসিন্দাদের জীবনের বিশ্বস্ত রূপায়ন দেখতে পাই। এই অভাবী মানুষদের জীবন সর্বাংশে স্বপ্নহীন বা নিরানন্দ বর্ণহীন জীবন কিন্তু নয়। বরং তাতে নানা রঙের বিচ্ছুরণ আছে, বেঁচে থাকার অর্থ ও আকাক্সক্ষার প্রকাশও আছে।

 

মা-বাবা, আট ভাই বোনের সংসারের একটা ছবি আঁকা হয়, যার মধ্যে প্রতিটি চরিত্র আলাদা করে চিনে নিতে পারেন পাঠক। পাশাপাশি বাংলা-উর্দু মিশিয়ে কথা বলা ঢাকাইয়া-কুট্টি, বিহারি পরিবারগুলো বা ঘটি লালুদের জীবনাচরণের বর্ণনায় বহুকাল আগের পুরোনো ঢাকার বাস্তবতা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

 

যে শিশুটি শুধু খাই খাই করে, দু’পয়সা দামের আইসক্রিম কখনো খেতে পায়, এক আনা দামের দুধ মেশানো আইসক্রিমটি পায় না, শুধু লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকে, তার জীবন ও জগৎ বর্ণনার গুণে ক্ষুদ্র হয়ে থাকে না। বরং তার মতোই বিস্ময়ের চোখে চারপাশের জীবন দেখার জানার কৌতূহল তৈরি হয় পাঠকের মনে।

 

একটি ডালিম চারা লাগিয়েছিল ছোট্ট মিলু। সেই চারা ফুলে ফলে ভরে উঠবে এমন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিল। কিন্তু সেই চারাটি অজ্ঞাত কেউ একজন একদিন উপড়ে ফেলে দিলে স্বপ্নভঙ্গের নির্মমতার সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হয়েছিল বালক। ‘ক্লান্ত কাক আর কার্নিশে বসা শালিক দেখে, সাত বছরের মিলুকর্তা তার ডালিম চারার শোকে কাঁদছে।’

 

আমরা বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করি ‘মনে আছে, জিন্দাবাহার’ উপন্যাসটি যখন শেষ হয়, তখন এর মূল চরিত্র মিলুর বয়স মাত্র সাত। অর্থাৎ জিন্দাবাহার পর্বের পর আরও দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া জীবন রচিত হচ্ছে। আমরা সেই নানা স্তরের জীবন পাঠের অপেক্ষায় থাকলাম।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়