ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সেই মার্চ, এই মার্চ

অধ্যাপক অরুণ কুমার গোস্বামী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৭, ১৯ মার্চ ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেই মার্চ, এই মার্চ

অধ্যাপক অরুণ কুমার গোস্বামী

অধ্যাপক অরুণ কুমার গোস্বামী : ‘মার্চ’ বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি ভাগ্য নির্ধারণী মাস। মূলত: দুই দশক এবং তিন দশক ব্যবধানের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বছরের তিনটি মার্চ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

 

প্রথমটি হচ্ছে ১৯২০ সালের মার্চ, দ্বিতীয়টি এর দুই দশক পরে ১৯৪০ সালের মার্চ এবং এরও প্রায় তিন দশক পরে স্বাধীনতার চূড়ান্ত বার্তা বয়ে এনেছিল ১৯৭১-এর তৃতীয় মার্চ মাস।  ১৯২০, ১৯৪০ এবং ১৯৭১-এর তিনটি মার্চ বাঙালির তথা বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রকৃতপক্ষেই ছিল ভাগ্য নির্ধারণী।

 

একাত্তরে ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে সূচিত মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে ২০১৫-র মার্চে বাংলাদেশ এখন একটি আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে ১৯২০, ১৯৪০ এবং ১৯৭১-এর তিনটি মার্চের কোনটিতে স্বাধীনতার বীজ এবং কোনটিতে আতঙ্কের বীজ নিহিত সেটি অনুসন্ধান করাই বর্তমান লেখার উদ্দেশ্য। 

 

ভবিষ্যতে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্বদানের সম্ভাবনাময় একটি ‘শিশু’ ভূমিষ্ঠ হয়েছিল ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ।  এর দুই দশক পরে ‘অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনার সূর্য’ ‘সাম্প্রদায়িকতার রাহুর করাল’ গ্রাসে আচ্ছাদিত হবার চূড়ান্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৪০ সালের মার্চে।  পিতা-মাতার আদরের ‘খোকা’ তখন ছিলেন মাত্র ২০ বছরের তরুণ।
সেই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে গৃহীত একটি ‘প্রস্তাব’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য, ধর্মীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের অধীনে যুক্ত করে দিয়েছিল।  এ প্রস্তাব পাস হবার পরে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যেভাবে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, সেটি তরুণ শেখ মুজিবকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছিল।

 

সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বৈষম্য, মানুষের ওপর জুলুম, অত্যাচার ও খুনোখুনি যে অন্ধকারময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, সেদিনের শেখ মুজিব তা থেকে মুক্তির চিন্তা করছিলেন। এই সঙ্গে শৈশব ও কৈশোরের শিক্ষা এবং সমগ্র জীবনব্যাপী সামাজিকীকরণ তাঁকে অসাম্প্রদায়িক আধুনিক মানুষে পরিণত করেছে।  তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছেন।  জনগণকেও সেভাবে জাগরণের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। 

 

লাহোর প্রস্তাবের ফলশ্রুতিতে দ্বিজাতি তত্ত্ব তথা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার  প্রবল স্রোত উপমহাদেশকে ভাসিয়ে নিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে ‘ধর্মীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র’ পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। ধর্মের নামে সৃষ্ট পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার তৎপরতা শুরু করার পরিপ্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

 

কায়দে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের শেখ মুজিব এর প্রতিবাদ করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের রক্ত পিচ্ছিল পথ ধরে ক্রমান্বয়ে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বেগবান হচ্ছিল। আর এর সব ক্ষেত্রেই মূল নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিব।  এভাবে এক পর্যায়ে ’৬৯ সালে আন্দোলনের মহানায়ক শেখ মুজিবকে জনগণ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। 

 

লাহোর প্রস্তাব পাস হবার তিন দশক পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৯৭১-এর মার্চে ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। ঘটনাগুলোকে আমরা এভাবেও বিবৃত করতে পারি, ‘১৯৪০-এর মার্চ মাসে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবের প্রভাবে সৃষ্ট পাকিস্তানের ধর্মীয় ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নাগ-পাশ ছিন্ন করে স্বাধীন-সার্বভৌম ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সূচিত মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব করে তুলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বিবিসি বাংলার জরীপের ফলে তিনি হয়েছেন ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’।

 

১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ বর্তমান পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে উত্থাপিত হয়েছিল একটি  ‘প্রস্তাব’,  যার ভিত্তিতেই ‘পাকিস্তান’ নামের একটি নতুন রাষ্ট্র জন্মলাভ করেছিল।  লাহোর প্রস্তাব ছিল প্রকৃতপক্ষে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের ফসল।  দেখা যাচ্ছে লাহোর প্রস্তাবটি ‘মুসলিম লীগের’ হলেও এটি যিনি উত্থাপন করেছিলেন তিনি ছিলেন ‘কৃষক প্রজা পার্টির’ নেতা। সে সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড লিনলিথগো।  তিনি মুসলমানদের একটি প্রতিনিধি দল ব্রিটেনে প্রেরণের জন্য বলছিলেন। তিনি মুসলমান নেতাদের কাছে এ মর্মে আর্জি জানাচ্ছিলেন যে তারা যেন একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তৈরি করে। লিনলিথগো বেশ কয়েকবার জিন্নাহর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে এই মর্মে বোঝাচ্ছিলেন যে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের  সদস্যদের শুধু আনুষ্ঠানিক মেমোরেন্ডাম দিয়ে বুঝানো সম্ভব হবে না।

 

এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় লন্ডনে মুসলিম প্রতিনিধি দল প্রেরণ সংক্রান্ত ভাইসরয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন ফজলুল হক, সিকান্দার হায়াত খান, খাজা নাজিমউদ্দিন এবং খলিকুজ্জামান। এরপরে ১৯৪০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জিন্নাহ আনুষ্ঠানিকভাবে ভাইসরয়কে জানান যে ২৩ মার্চের মুসলমি লীগের অধিবেশনে দেশভাগের বিষয়টি আলোচিত হবে এবং একটি সিদ্ধান্ত সেখানে নেয়া হবে।

 

প্রসঙ্গত, এর আগেই লিনলিথগো গোপণে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে জাফরউল্লাকে দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবী সম্বলিত প্রস্তাব তৈরি করে রেখেছিলেন। জিন্না কর্তৃক সংগঠিত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে সেটি উত্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়।

 

প্রকৃত পক্ষে ইংরেজদের ছক মাফিক প্রস্তাবটি জিন্নাহর অনুরোধে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক উত্থাপন করেছিলেন। তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসকদের নীল নকশা অনুসারে জাফরউল্লাহ চৌধুরী এই প্রস্তাবের খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু জাফরউল্লাহ ছিলেন কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী সম্প্রদায়ের মুসলমানরা তার উত্থাপিত প্রস্তাবটি গ্রহণ না করে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে! তাতে ইংরেজদের উদ্দেশ্যটাই ভেস্তে যেতে পারে! তাই ইংরেজরা জাফরউল্লাহ্কে দিয়ে প্রস্তাবটি উত্থাপনে নিরাপদ বোধ করে নাই।

 

ওয়ালী খান তার বিখ্যাত ‘ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস’ গ্রন্থে এই সত্যটি উপযুক্ত তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন। আর প্রস্তাব উত্থাপনের পর থেকে এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বা এর ভিত্তিতে আন্দোলন সংগঠিত করা কোন কিছুতেই ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ নেতা শের-ই বাংলা এ কে ফজলুল হক সম্পৃক্ত ছিলেন না।  লাহোর প্রস্তাব পাস হবার পরের দিনের সংবাদ পত্রে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ শিরোনাম দিয়ে সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিন্নাহর কাছে প্রেরিত একটি পত্রের মাধ্যমে ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা জানিয়ে দেন। উল্লেখ্য, লাহোর প্রস্তাবকে জিন্নাহ একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবেই দেখেছেন।

 

ইংরেজদের ষড়যন্ত্র অনুযায়ী প্রণীত লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই উপমহাদেশে একটি নতুন রাষ্ট্র, পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। ইংরেজি PAKISTAN শব্দটি যেসব স্থান নির্দেশ করে সেগুলোর মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশ ছিল না।  ১৯৩৩ সালের ২৮ জানুয়ারি চৌধুরি রহমত আলী, ‘নাউ অর নেভার : আর উই টু লিভ অর পেরিস ফর এভার’ শীর্ষক প্রচারপত্রে সর্বপ্রথম পাকিস্তান শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। PAKISTAN শব্দটিতে ব্যবহৃত P= Punjab, A= Afghania, K= Kashmir, S= Sindh এবং Baluchistan এর শেষ অংশের tan । এখানে উচ্চারণের সুবিধার জন্য এবং ভাষাগত দিক দিয়ে শুদ্ধ ও অর্থবহ নাম দাঁড় করানোর জন্য i  অক্ষরটি ব্যবহৃত হয়েছে।

 

বাংলার কোন কিছুই পাকিস্তানের সঙ্গে না থাকা সত্ত্বেও এটিকে এক প্রকার ষড়যন্ত্রের জোড়ে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। শব্দগত, প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক কোন মিল না থাকার কারণে উদ্যোক্তাদের নিকট ‘ধর্মীয়’ সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। প্রকৃত পক্ষে ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতির মাধ্যমে আগে থেকেই ইংরেজরা সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপণ শুরু করেছিলেন।

 

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি শুধু সেই নীতির সম্প্রসারণ মাত্র। পাকিস্তানে এর পর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দূ করার ষড়যন্ত্র করা হয়। বাঙালিরা জীবন দিয়ে তা রুখে দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের বৈষম্য নীতি বজায় থাকার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান প্রভৃতি প্রতিটি আন্দোলন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে গিয়েছে। আর এর নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে একাত্তরের ‘মার্চ’ চিরস্মরণীয়। ’৭০-এর নির্বাচনের পর একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং তারপরে ২৫ মার্চের কালো রাত। এই তারিখগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ভাষা আন্দোলন দিয়ে মূল শুরু হলেও তাৎক্ষণিক শুরুটা হয়েছিল ১৯৭০-এর নির্বাচনী ফল দিয়ে।

 

এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। তবে এই নিরঙ্কুশ বিজয়ের সব কটি আসনই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একটি আসনও লাভ করতে পারে নি। যেমন জুলফিকার আলী ভূট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও লাভ করতে পারে নি।  ফলে এক হাজার মাইলেরও বেশী দূরত্বে অবস্থিত আলাদা ‘দুটি রাষ্ট্রকে’ ‘শুধু ধর্মের’ দোহাই দিয়ে ‘একটি রাষ্ট্রে’ আবদ্ধ রাখার ফন্দি ফিকির বিফল প্রমাণিত হয়।

 

’৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসার তারিখ ঠিক করবেন এটিই স্বাভাবিক। ন্যাশনাল অ্যসেম্বলিতে বসার জন্য তিনি একাত্তরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি একটি তারিখ বেছে নিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে প্রস্তাব করেন। কিন্তু ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর কথা রাখেন নি। তিনি ভূট্টোর মতানুযায়ী মার্চ মাসের ৩ তারিখ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসার তারিখ নির্ধারণ করেন।

 

তবে মার্চ মাসের ১ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বৈঠক অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন।  আর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এ আন্দোলন চলা কালে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর পাকিস্তানী বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। 

 

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের মধ্যে বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।  দৃশ্যত: ১৯৭০-এর নির্বাচনী জয় ছিল বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের সোপান। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব তথা ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ ধূ¤্রজালের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এবং জিন্নার নেতৃত্বে উত্তর ভারতীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব কৃত্রিমভাবে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেই কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অবস্থানের বিজয় সূচিত হয়।

 

মার্চের ২৫ তারিখ রাতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও রজারবাগ পুলিশ লাইনসে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে গণহত্যায় মেতে উঠেছিল। ২৫ তারিখের ওই রাতটি ছিল বিভীষিকাময়। মার্কিন সাংবাদিক ডেভিড লোসাকের ভাষায়, দ্যাট নাইট দ্য হলোকাস্ট বিগ্যান। 

 

সেই মার্চ,  নিয়ে বাঙালির দু:খ ও গৌরব, শোক ও আনন্দ অন্তহীন। সেই মার্চ না এলে বাঙালি স্বাধীনতা পেত না। সেই মার্চ বাঙালি জাতির  স্বাধীনতার অমোঘ বাণী সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ধারণ করে আছে। সেই মার্চ, যে মার্চে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার আগল খুলে গিয়েছিল। সেই মার্চ, যে মার্চে বাঙালি ধর্ম বিভেদ ভুলে গিয়েছিল। সেই মার্চ, যেই মার্চে বাংলার সন্তান রুখে দাঁড়িয়েছিল। সেই মার্চে বাঙালি গেয়ছিল ‘রুখে দাঁড়াও, রুখে দাঁড়াও রাখো দেশের মান, চলো সমানে সমান বাংলার সন্তান, চলো সমানে সমান।’

 

সব নৃশংসতাকে যুদ্ধের মাধ্যমে মোকাবেলার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সেই মার্চ বাঙালির স্বাধীনতার মার্চ।  এভাবে ধারাবাহিক আন্দোলনই টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়ে বঙ্গবন্ধু জাতির জনকে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু ১৯৭১-এর পরাজিত হায়েনারা ইতিহাসের সব কীর্তি ধ্বংস করতে চায়। আত্মত্যাগ ছাড়াই চোরাগোপ্তা পথে মানুষ হত্যা করে সেটাকে আন্দোলন বলতে চায়। এরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

 

পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী গুটিকয়েক বাঙালি যে কত শক্তিশালী, তা চুয়াল্লিশ বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারছে। একাত্তরে হত্যা ও নির্যাতন যত তীব্র ছিল, এই মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের দোসররা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর পেট্রল বোমার আক্রমনের ধরণ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় নায়ে তাদের মনে ‘পেয়েও হারানোর কত বেদনা’।

 

ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতার ফলে স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর পরে ২০১৫’র মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশ এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। আর বর্তমান পরিস্থিতির বীজ নিহিত ছিল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রণীত ১৯৪০-এর ২৩ মার্চের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে, যেখানে উপমহাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে কৃত্রিম রাষ্ট্র সৃষ্টির দাবী উত্থাপন করা হয়েছিল। তাদের ধর্মীয় উপনিবেশ ধরে রাখার জন্য ‘মুক্তির চেতনায়’ উদ্বুদ্ধ বাঙালিদের ‘নিশ্চিহ্ন’ করা বা ‘পোড়া মাটি নীতি’ অনুসরণ করার লক্ষ্য নিয়ে একাত্তরের মার্চে জেনারেল নিয়াজী ও টিক্কা খানের কমান্ডে পাকিস্তানের সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। 

 

সে সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয়েছিল বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ, যেটি ছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, সেটি সংঘটিত হয়েছিল মূলত: ‘বাঙালি’ বনাম ‘অবাঙালি পাকিস্তানীদের’ মধ্যে। তবে অবাঙালি, পাঞ্জাবী, বালুচ, পাঠান কিংবা বিহারীদের সঙ্গে তল্পিবাহক হিসেবে ‘গুটিকয়েক’ বাঙালিও ছিল।

 

অবাঙালি পাকিস্তানীদের পক্ষে বাঙালি রাজাকার, আল বদর, আল শামস, পিস কমিটির সদস্যরা আন্তরিকভাবে পাকিস্তান চেয়েছে।  এই গুটি কয়েক বাঙালি নৃশংসতার দিক দিয়ে কত বর্বর হতে পারে তা চুয়াল্লিশ বছর পরে ২০১৫’র মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের অনুসারীদের পেট্রল বোমা হামলা ও নৃশংস তৎপরতায় বোঝা যাচ্ছে।

 

লেখক : অধ্যাপক অরুণ কুমার গোস্বামী, চেয়ারম্যান- রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মার্চ ২০১৫/নওশের

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়