ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই : ভাষাসংগ্রামী খলিলুর রহমান

কাঞ্চন কুমার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই : ভাষাসংগ্রামী খলিলুর রহমান

ভাষাসংগ্রামী খলিলুর রহমান

কাঞ্চন কুমার, কুষ্টিয়া : ভাষাসংগ্রামীদের খোঁজ কেউ রাখে না। শুধু ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই খোঁজ পড়ে ভাষাসংগ্রামীদের। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এক নিভৃতচারী ভাষাসংগ্রামীর নাম খলিলুর রহমান (৮৪)।

 

‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’র আন্দোলনের ছাত্রনেতা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার পৌর সদরের বাসিন্দা খলিলুর রহমান। বয়সের ভারে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। জীবনযুদ্ধের প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও ভাষাসংগ্রামীর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি তিনি। 

 

১৯৫১ সালে ঢাকা জগন্নাথ কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় তিনি জগন্নাথ কলেজের একটি ইউনিটের ছাত্রনেতা হিসেবে মিছিল-মিটিংয়ে নেতৃত্ব দিতেন।

 

ভাষাসংগ্রামী খলিলুর রহমানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকালে রাইজিংবিডিকে তিনি তার জীবনের ঘটে যাওয়া দুর্লভ অভিজ্ঞতার কথা জানান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির কুষ্টিয়া প্রতিনিধি কাঞ্চন কুমার। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো :

 

রাইজিংবিডি : কেমন আছেন আপনি?
খলিলুর রহমান : আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তবে বার্ধক্য ধরেছে...।

 

 

রাইজিংবিডি : ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আপনি কেন অংশগ্রহণ করেছিলেন?
খলিলুর রহমান : বাঙালির দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম আমি। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের মায়ের মুখের ভাষা বাংলা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। তারা জোর করে আমাদের ওপর তাদের উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাই স্বদেশ প্রেম ও মাতৃভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। 

 

রাইজিংবিডি : তখন আপনার বয়স কত ছিল? এবং কীভাবে আপনি এই আন্দোলনে আসেন?
খলিলুর রহমান : ২৭ জানুয়ারি ১৯৩২ সালে জন্মগ্রহণ করেছি আমি। ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। তৎকালীন ঢাকা জগন্নাথ কলেজে ব্যবসায় শাখার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। জগন্নাথ কলেজের একটি ইউনিটের ছাত্রনেতা হিসেবে মিছিল-মিটিংয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই বন্ধু ও সহযোগীদের নিয়ে এই ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম।

 

রাইজিংবিডি : আন্দোলন চলাকালে আপনি কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন?
খলিলুর রহমান : ভাষা আন্দোলন চলাকালে আমরা সবাই ঢাকাতেই ছিলাম। ঢাকা থেকেই আমরা কয়েকজন নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। তখন আমি ১০/ই আজিমপুর কলোনিতে থাকতাম। সেখান থেকেই মূলত আমি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম। মিছিলে গুলিবর্ষণের পরে কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তারপর আমি বাড়ি চলে আসি।

 

রাইজিংবিডি : ভাষা আন্দোলনের সময় আপনার উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা আমাদের জানান।
খলিলুর রহমান : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কার্জন হল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশ যখন বৃষ্টির মতো গুলি চালাচ্ছিল, সে সময় আমি ছিলাম মিছিলের অগ্রভাগে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে মিছিল নিয়ে আমরা সামনের দিকে এগোতে থাকি। একপর্যায়ে কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশ আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। আমার সঙ্গে থাকা সামনের কয়েকজন পুলিশের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লে আমি অন্য ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের তাড়া খেয়ে নিরাপদ স্থানে আত্মগোপন করি। ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যাই আমি। তারপর ২২ ফেব্রুয়ারি মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় গায়েবানা জানাজায় অংশগ্রহণ করি। তারপর ঢাকা ছেড়ে বাড়ি চলে আসি।

 

রাইজিংবিডি : ভাষা আন্দোলনে আপনার পরিবার কি কোনো বাধা দিয়েছিল?
খলিলুর রহমান : না, পরিবার কোনো বাধা দেয়নি। কারই তারা জানত না যে আমি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। জানলে হয়তো বাধা দিত।

 

রাইজিংবিডি : আপনারা কত দিন আন্দোলন করেছিলেন?
খলিলুর রহমান : যেদিন থেকে উর্দুকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তারপর থেকেই আমরা এর প্রতিবাদ করার চিন্তা করি। একপর্যায়ে এর প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়। আমরা প্রায় এক মাস ধরে এই আন্দোলন করার পরিকল্পনা করি। এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা মিছিল বের করি। সেদিন আমরা আমাদের কয়েকজন সহযোগীকে হারাই। এতে আন্দোলন আরো জোরদার হয়।

 

রাইজিংবিডি : আপনি কি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
খলিলুর রহমান : আমি প্রত্যক্ষভাবে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি। তবে পরোক্ষভাবে এর সমর্থন করেছি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করার কারণে আমি এলাকাতে চিহ্নিত ছিলাম। এ জন্য আমি স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারিনি।

 

রাইজিংবিডি : সে সময়ের কোন স্মৃতি আপনার বেশি মনে পড়ে?
খলিলুর রহমান : ভয়াবহ সেই দিনের কথা আজও আমার মনে পড়ে। ভুলে যাওয়ার চেষ্টার করেও আমি ভুলতে পারি না। চোখের সামনে বন্ধুদের মরতে দেখেছি। যাদের সঙ্গে চলেছি তাদের হারানোর সেই দিনের ঘটনা আমি কোনোভাবেই ভুলতে পারি না। সেই স্মৃতিগুলো আমাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়।

 

 

রাইজিংবিডি : যে উদ্দেশ্যে আপনি ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, বর্তমানে কি সেটা পরিপূর্ণ হয়েছে বলে মনে করেন?
খলিলুর রহমান : মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য আমরা যে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম, যার জন্য আমরা বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিলাম- আমার মতে আমাদের সেই উদ্দেশ্য কিছুটা সম্পূর্ণ হয়েছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ায়। তবে বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও এর সুষ্ঠু চর্চা হয় না বর্তমানে। এজন্য আমি মনে করি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এ ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলাম, তা পরিপূর্ণ হয়নি। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং বাংলা ভাষার চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।

 

রাইজিংবিডি : যেদিন বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় সেদিন আপনার অনুভূতি কি ছিল?
খলিলুর রহমান : সেদিন আমরা আন্দোলনের সার্থকতা পেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেই বাংলা ভাষাকে নিয়ে লেখা কবিতার সার্থকতা পেয়েছিলাম আমি। কবির মতো আমারও মনে হয়েছিল এ ভাষায় কথা বলতে পেরে আর আমাদের এই মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে আমার জীবন সার্থক হয়েছে।

 

রাইজিংবিডি : আপনি কি ভাষাসংগ্রামী হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছেন?
খলিলুর রহমান : না, আমি এখন পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়নি।

 

রাইজিংবিডি : কেন পাননি বলে আপনি মনে করেন?
খলিলুর রহমান : আমি ভাষা আন্দোলনের পর থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত অবহেলিত ছিলাম। আর আমি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার জন্য কোনো যোগাযোগ করিনি। তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে পেরেই নিজেকে সার্থক বলে মনে করেছিলাম। এ জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার আশা করিনি। তবে মরার আগে একজন ভাষাসংগ্রামী হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেতে মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় আমার।

 

রাইজিংবিডি : আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে কিছু বলেন।
খলিলুর রহমান : আমি প্রথমে চণ্ডীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করি। পরে সেখান থেকে ভেড়ামারা বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ১৯৯১ সালের ২৬ জানুয়ারি অবসর গ্রহণ করি।

 

রাইজিংবিডি : আপনার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলেন।
খলিলুর রহমান : আমার বাবা মরহুম বাবর আলী ছিলেন একজন হোমিও ডাক্তার। আমরা তখন ছিলাম আট বোন এবং পাঁচ ভাই। আমি ছিলাম সবার বড়। বর্তমানে আমরা চার ভাই এবং ছয় বোন রয়েছি। ১৯৭২ সালে আমার স্ত্রী হামিদা খানম বেলা তিন মেয়ে ও এক ছেলে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। এখন আমার পরিবার বলতে আমার একমাত্র ছেলে তার নাতি-নাতনিরা। 

 

রাইজিংবিডি : কীভাবে কাটছে আপনার বর্তমান সময়?
খলিলুর রহমান : বর্তমানে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে পুরোনো দিনের কথা বলে বলেই সময় কেটে যায়। সময়ের সেই সহগামী, সতীর্থদের নাম স্মরণে আনতে না পারলেও আমার স্মৃতিপটে ভাসে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির সেই দিনটির কথা।

 

বর্তমানে ১৯৫২-এর ভাষাসংগ্রামী খলিলুর রহমানের ছেলেমেয়েদের দাবি, তাদের বাবাকে যেন ভাষাসংগ্রামীর সম্মান দেওয়া হয়।

 

 

 

রাইজিংবিডি/কুষ্টিয়া/১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/কাঞ্চন/মুশফিক/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়