ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

সেলিনা এখন বৃদ্ধাশ্রমে

ইভা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেলিনা এখন বৃদ্ধাশ্রমে

তানজিনা ইভা : দুই সন্তানের জননী সেলিনা খাতুন এখন বৃদ্ধাশ্রমে। অথচ জীবনটা তার এমন হওয়ার ছিল না। একাকী জীবনে তার মনে পড়ে অনেক কিছুই আজ। জীবনটা ছিল তার গল্পেরই মতো। অতীত জীবনে ফিরে গেলে দুচোখ তার জলে ভরে ওঠে..।

 

মনে পড়ে তার ছেলে শাহারিয়ার হক রিয়াদ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মেয়ে শান্তা হক  গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সেলিনা খাতুনের স্বামী এনামুল হক। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। এনামুল হকের মা-বাবা গত হয়েছেন বছর তিনেক হলো। প্রথমে বাবা মারা যায়। হার্টের সমস্যা ছিল। বাবা মারা যাওয়ার ছয় মাস পার হতে না হতেই মা মারা যান।

 

এনামুল হকরা দুই ভাই বোন। বোনের বিয়ে হয় পাশের গ্রামে। স্ত্রী, দুই সন্তান আর মা-বাবাকে নিয়ে ছিল এনামুলের পরিবার। স্কুলে মাস্টারির পাশাপাশি চাষাবাদে ভালই চলছিল তাদের সংসার। এখনও সেই একই রকম চলে। শুধু মা-বাবা নেই। এনামুল-সেলিনার এখন একটাই ইচ্ছা, ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করে যেন মানুষের মতো মানুষ হয়।

 

রিয়াদের পড়াশুনা শেষ হয়েছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। ঢাকায় থাকে। মাস শেষে বেতনের একটা অংশ পরিবারের জন্য পাঠায়। এখন এনামুলদের অবস্থা বেশ ভালো। রিয়াদ চাকরি পাওয়ার দুই বছরের মাথায় বাড়িতে একটি পাকা ঘর তুলেছে। বাবা-মার ইচ্ছা রিয়াদ এখন বিয়ে করুক।

 

রিয়াদ অবশ্য আগে থেকেই পাত্রী পছন্দ করে রেখেছেন। তার তুলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সঙ্গেই পড়াশুনা থেকে ঘনিষ্ঠতা। তুলি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তুলির গায়ের রং শ্যামলা, তবে দেখতে সুন্দর। রিয়াদ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তখন থেকে সম্পর্ক।  বাবা-মা বিয়ের কথা বলার পর রিয়াদ তুলির কথা জানিয়েছে। বাবা-মায়ের কোনো আপত্তি নেই। ছেলের যখন পছন্দ তখন তাদের আর আপত্তি কিসে? তবে তুলির বাবা-মা রিয়াদের পারিবারিক অবস্থার করাণে আপত্তি জানায়।

 

অবশেষে তুলির জেদের কাছে হার মানতে হয়। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়। তবে তুলি আগেই থেকেই জানিয়ে দিয়েছে, বিয়ে হবে ঢাকাতে। রিয়াদ বিয়ের আগে মেস ছেড়ে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। বিয়ের আগে ঢাকা থেকে বাবা-মা, ছোট বোনকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। কাছের কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকেও নিমন্ত্রণ জানিয়েছে।

 

ধানমন্ডির একটা পার্টি সেন্টারে ধুমধাম করে বিয়ে হলো তুলি-রিয়াদের। নতুন সংসার, ভালোই চলছে। এরমধ্যে শান্তার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ওকে কলেজে ভর্তি করাতে হবে। তাই রিয়াদ শান্তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। কলেজে ভর্তি করে দেয়। তবে তুলি খুব একটা খুশি না। তার মতে একটা উটকো ঝামেলা। ওদিকে রিয়াদের বাবাও অবসরে গেছেন। এরপর থেকে তার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। রিয়াদ একরকম জোর করেই তার বাবা-মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।

 

এখন রিয়াদের সংসার বেশ বড়। আবার ঘরে নতুন অতিথি আসছে। সব সংসারের দ্বায়িত্ব এখন অবশ্য তার নিজের কাঁধেই। মেয়ের বিয়ের চিন্তা করে রিয়াদের বাবা পেনশনের টাকা পেয়ে ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন।

 

এদিকে যত দিন যাচ্ছে ততই তুলির ব্যবহারে পরিবর্তন আসছে। সামান্য বিষয় নিয়ে শুরু করে ঝগড়া। মাঝে মাঝে এনামুল চিন্তা করে সেলিনাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ওই বাসাতেই থাকে।

 

বছর দুই এইভাবে যায়। এর মধ্যে রিয়াদের চাকরিতে প্রমোশন হয়েছে। ব্যাংক থেকে কিছু টাকা লোন নিয়েছে ফ্লাট কিনবে বলে। দেখেশুনে ধানমন্ডিতে একটি ফ্লাটের জন্য অগ্রিম ২০ লাখ টাকা দেয় রিয়াদ। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। শুধু ব্যাংক লোন আর জমানো টাকা দিয়ে তো পুরো টাকা শোধ হবে না।

 

একদিন রাতের খাবার শেষে বাবার ঘরে যায় রিয়াদ। বোনের জন্য বাবা যে টাকাটা ব্যাংকে রেখেছে তাতে নজর যায় রিয়াদের। বাবাকে জানায়, টাকাগুলো তাকে দিতে। বোনের বিয়ের সময় যা খরচ সে নিজেই করবে। প্রথমে রিয়াদের মা রাজি হয়নি। তবে বাবা আর না করতে পারলো না। ছেলে তো প্রয়োজনেই টাকাটা নিতে যাচ্ছে। তাকে কী না বলা যায়। রিয়াদ বাবার দেওয়া টাকা নিয়ে ফ্লাটের বাকি টাকা পরিশোধ করে। এরপর তারা সবাই নতুন বাসায় ওঠে। রিয়াদের ছেলেটাও বেশ বড় হয়েছে। দাদা-দাদির জন্য পাগল। সারাক্ষণ দাদার কাছ থেকে রাজা-রাণির গল্প শোনার বায়না ধরে। কোনো কোনো রাতে দাদার কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়। পরে মা এসে নিয়ে যায়।

 

এদিকে শান্তার পড়ালেখাও শেষের দিকে। রিয়াদ তার বিয়ের জন্য পরিচিতদের ছেলে দেখতে বলেছে। বেশ কয়েক জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। তবে ব্যাটে-বলে মিলছে না। পছন্দ হলো রায়হান নামের এক ছেলেকে। রায়হান একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছে। পারিবারিকভাবে দেখাশোনা হলো। বিয়ের সব খরচ অবশ্য রিয়াদই করল। বিয়ের কিছুদিন পর রায়হান বিদেশ চলে যায়। বছর খানেক পর স্ত্রীকে নিয়ে যায়।

 

বেশ কিছু দিন রিয়াদের বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বুকে ব্যাথা। বয়স হয়েছে। ডায়বেটিসসহ নানা রোগ শরীরে বাসা বেধেছে। অবস্থা খারাপ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাতেও শেষ রক্ষা হলো। ১০ দিন হাসপাতালে থাকার পর মারা যান এনামুল।

 

এনামুল মারা যাওয়ার পর সব থেকে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন সেলিনা। নিজেকে অনেক বেশি অসহায় মনে হয়। এই একটা মানুষ চলে যাওয়ার পর তার দুনিয়াটায় যেন অন্ধকার হয়ে পড়েছে। তুলির ব্যবহার তো আগে থেকেই খারাপ। এখন যেন তা চরমে। ছেলে সারা দিন অফিসে থাকে। বাড়ি ফেরে অনেক রাতে। আবার সেই সকালে চলে যায়। মায়ের সঙ্গে তেমন কথায় হয় না। এদিকে রান্না-বান্নাসহ সংসারের অধিকাংশ কাজই রিয়াদের মাকে করতে হয়। তারপরও তুলির কাছে সে ভালো না। যেভাবেই হোক মাকে সে বাসা থেকে বের করবে। এ নিয়ে রিয়াদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বাকযুদ্ধ চলছে। রিয়াদ অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। মাকে দিয়ে এলো বৃদ্ধাশ্রমে।

 

যেদিন স্বামী মারা যায়, সেদিনই সেলিনা বুঝেছিলেন তার কপালে আরো কষ্ট আছে। এক বিকেলে বৃদ্ধাশ্রমের ঘরে বসে মা ভাবছেন, শেষ জীবনে ঠিকানা এটা হবে কোনোদিন কল্পনাও করেননি। যে সন্তানকে জন্ম দিয়ে, কষ্ট করে মানুষ করা তার জন্য আজ এখানে। কত স্বপ্নই না ছিল। পছন্দের খাবার তখন সন্তানের মুখে গেলে নিজের পেট ভরতো, ও ভালো কাপড় পড়লে মনে আনন্দ হতো। ওর সফলতায় সুখে ভরে উঠতো মন, যে ছেলে ছিল মা অন্তঃপ্রাণ- আজ সেই কী-না তাকে রেখে গেল বৃদ্ধাশ্রমে..।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫/ইভা/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়