সেলিনা হোসেনের ধারাবাহিক উপন্যাস || দ্বিতীয় কিস্তি
সেলিনা হোসেন || রাইজিংবিডি.কম
অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার
শুনতে পাই দরজায় কেউ টুকটুক শব্দ করছে। হয়তো কাজের লোকের কেউ এসেছে। জুয়েল আসতে পারে। এখন ওর বাজার করে দেয়ার সময়। জুয়েল রাস্তার ধারে বসে জুতো সেলাইয়ের কাজ করে। আমার বাজার করার কাজ পেয়ে ও বেজায় খুশি। খুশিতে আটখানা বলা যায়। মাস গেলে বেতন পায়, আবার বাজারের দরদামের হাত সাফাই তো আছেই। আমার এই একা দিনযাপনে খুঁটিনাটি এইসব কিছু আমাকে মেনে নিতে হয়। আমি বেঁচে থাকার শর্ত হিসেবে মেনে নিয়েছি। বড় বেশি সাহসী জীবনযাপন। সাহস এই অর্থে যে আমি বাঁচা-মরার আর কোনো কিছু পরোয় করছি না।
বেলটা জোরে জোরে আরও কয়েকবার বাজে। ডালিয়ার হাতটা চাদরের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি দরজা খুলতে আসি। জুয়েলই এসেছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে স্যার?
কিছু হয়নি তো। তোর কেন মনে হলো যে কিছু হয়েছে?
আপনার শরীর ভালো আছে?
ভালোই তো আছি। তুই তো আমাকে কালও দেখে গেলি। আমাকে দেখতে খারাপ দেখাচ্ছে?
হ্যাঁ, কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে যে মানুষকে রোজ দেখি আজ আপনি সেই মানুষ না।
আমি হা-হা করে হাসি। প্রাণখুলে হাসি। হাসতে হাসতে ওকে ইশারায় ভেতরে ডেকে দরজা বন্ধ করে দেই। হাসি থামিয়ে বলি, আমার হাসিও কি অন্যরকম লাগছে?
ও ঘাড় কাত করে বলে, হ্যাঁ। একদমই অন্যরকম লাগছে।
তাহলে তুই ভুল করে অন্য বাড়িতে ঢুকে পড়েছিস জুয়েল। ভেবে দেখ ঠিক বাড়িতে এসেছিস তো?
আমি ঠিক বাড়িতেই এসেছি। আমার কোনো ভুল হয়নি।
তাহলে বাড়ির মানুষটাকে বেঠিক লাগছে কেন?
লাগছে সেটা জানি। কেন লাগছে জানি না। আজকে কী বাজার করব স্যার? কী মাছ আনব? নাকি মুরগি?
ম্যাডাম কী খাবে জিজ্ঞেস করি। তুই বোস।
ম্যাডাম? জুয়েল বিস্ফারিত চোখে তাকায়। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে যাই। তাইতো, আমি কি বললাম ওকে? কত বছর আগে এমন করে কথা বলতাম! এখন কি তেমন করে কথা বলা যায়। হায়, আমার কী হবে! এমন ভুল বারবার করলে লোকে আমাকে পাগল বলবে।
ম্যাডামের স্যুপ আনতে হবে স্যার?
অনেককিছুই লাগবে। তুই বোস আমি রান্নাঘর দেখে তোকে স্লিপ দেব।
ততক্ষণে আমি মামা আর খালার ঘরদু’টো ঝাড়– দেই? বেলি আমাকে ঝাড়– দিতে বলে গেছে।
ওর আজ কাজ করতে ভয় করছিল।
ওর কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না। আজ ওর কি হয়েছে কে জানে? অন্যদিন তো এমন করে না। তাই ও ভয়ের কথা বলেছে। আপনাকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছে। জুয়েল ফিক করে হাসে।
বেশ দুষ্টু হয়েছে তো? আর আমি বুঝতেই পারিনি। আমি ভাবলাম মেয়েটার হলো কি? এক মুহূর্ত থেমে আমি বলি, তবে ওর বুদ্ধি আছে। ঘটনাটা ভালোই সাজিয়েছে। মেয়েটা লেখাপড়া শিখলে ভালো করবে। আহা রে, ওকে যদি আমি স্কুলে ভর্তি করাতে পারতাম!
স্যার আমি ঘর ঝাড়– দিতে যাচ্ছি। মুছেও দেব।
আচ্ছা। আমি ঘাড় নেড়ে সায় দেই। বাজারের তালিকা করতে করতে বারবারই বেলির কথা মনে হয়। মেয়েটির কল্পনাশক্তি আমাকে অভিভূত করে। আমার মতো বয়সী মানুষকে একদম ঘায়েল করে ফেলেছে। আমি ধরতেই পারিনি। আবার কাজটা যাতে হয় সেজন্য জুয়েলকে করতে বলে গেছে। ফাঁকিবাজির জায়গাটা অ্যাড্রেস করেছে ও। আমি খুব খুশি হই। ভেবে দেখি কৈশোরে রায়নার এমন দুষ্টু বুদ্ধি ছিল না। ও মেধাবী শান্ত মেয়ে ছিল। তাহলে বেলফুল সময়ের সুযোগ নিতে শিখেছে। চারপাশ থেকে শিখতে পারছে। বাহ্, এটাও দারুণ। আমি স্লিপ হাতে ড্রইংরুমে আসি। বুঝতে পারি বেলফুলের সুগন্ধ আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে। ওর বুদ্ধিমত্তা এবং নিখুঁত পারফরম্যান্স আমাকে মোহিত করে রেখেছে। বেঁচে থাকার তাড়না কি ওকে এমন কৌশলী হতে শিখিয়েছে? তাই হবে। রায়নার সামনে বেঁচে থাকার তাড়না ছিল না। নিজের বোঝা ওকে টানতে হয়নি। বরং বাড়তি পাওয়ায় পূর্ণ ছিল ওর কৈশোর। আমি স্লিপ হাতে বসেই থাকি। আলমারি থেকে টাকা বের করতে যাই না। আমার বসে থাকতে ভালো লাগছে। আমার সামনে উড়তে থাকে সময়ের মেঘরাজি। আমি সেই মেঘরাজিতে খুঁজতে থাকি আমার কৈশোর। কোথাও খুঁজে পাই না। আমি একজন বয়সী মানুষ আমার কৈশোর হারিয়ে ফেলেছি। আমার বুকের ভেতরে ধুপধুপ শব্দ হয়। আমি নিজের বুকের শব্দ নিজেই কান পেতে শুনি।
একসময় মনে হয় ভালোলাগছে শুনতে। যেন আমার সামনে কোনো এক ঢাকী ঢোল বাজাচ্ছে। কৈশোরে ঢোলের শব্দ শুনে বুঝতে পারতাম আজ উৎসব। পূজার উৎসব। প্রতিমা গড়া শেষ হয়েছে। আশ্চর্য, আমার কৈশোর ফিরে এসেছে। হুররে, আমি হাতে ধরা কাগজটি ঘরের ভেতরে উড়িয়ে দেই। বলি, যাও মেঘরাজি ছুঁয়ে এসো।
কাজ শেষে সামনে এসে দাঁড়ায় জুয়েল।
ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে ঢাকা শহরের রাস্তায়। একদিন ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গিয়েছিল। স্যান্ডেল খুলে ওকে দিয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কতক্ষণ লাগবে? ও গালভরা হাসিতে আমাকে মাতিয়ে দিয়ে বলেছিল, তিন সেকেন্ড।
তিন সেকেন্ড? কি রে মিছে কথা শিখেছিস কেন?
মিছে কথা না। আমি এভাবেই কথা বলি।
কে শিখিয়েছে?
ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছে।
বাবার নাম কী?
সুরেন দাস। পেশায় মুচি। নিখুঁতভাবে জুতো সেলাই করে।
সুরেনের ছেলে জুয়েল। আমি দ্বিধা নিয়ে ওর দিকে তাকাই।
বাবা আমাকে রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ন্যাকড়ায় পেঁচিয়ে কেউ আমাকে ফেলে দিয়েছিল। বড় হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি আমার নামের শেষে দাস লিখতে দাও না কেন? বাবা বলেছিলেন, কুড়িয়ে পাওয়া ছেলের ধর্ম আমি জানব কি করে সেজন্য তুই শুধু জুয়েল। আমার মানিক। তোর মায়ের বুকের ধন। আর তোর দুই দিদির ছোট্ট সোনা।
সেদিন ওর একটানা কথা আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ও আমার সামনে একটি স্কুল। ও নিজে একটি প্রতিষ্ঠান। এবং এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার কোনো সীমা টানা নেই।
শুনতে পাই ও মৃদুস্বরে ডাকছে আমাকে।
স্যার। স্যার। স্যার। স্যার। স্যার-
বেশ লাগছে শুনতে ওর কণ্ঠস্বর। আমি কান পেতে শুনি। যেন এই মুহূর্তে ও আমার ছাত্র। ক্লাশভরা ছাত্রছাত্রী নেই। বড় ঘরটায় ও একাই ছাত্র। একসময় ওর দিকে তাকিয়ে বলি, তোর বাবা তোকে লেখাপড়া না শিখিয়ে জুতো সেলাইয়ের কাজ শিখিয়েছে কেন রে?
লেখাপড়াতো শিখেছি। ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত। এর বেশি আমি পড়তে চাইনি। বাবাকে বলেছি জুতা সেলাইয়ের কাজ শিখব।
কেন? জুতো সেলাইয়ের কাজ কেন?
বারে আমি তো বাবার ছেলেই হতে চেয়েছি। যার কেউ নেই তার একটা ঠাঁই হলেই হয়। বেশি কিছুর দরকার নেই। যার ঘরে বড় হয়েছি তার সবকিছুই আমার। বুড়ো হলে যখন মরব তখন সবাইকে বলে যাব আমাকে যেন চিতায় পোড়ানো হয়। বাবার ধর্মই আমার ধর্ম।
তুই একটা দারুণ ছেলে জুয়েল। ভাগ্যিস তোর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, নইলে এতকিছু আমার জানা হতো না। এখন থেকে তোকে আমি স্যার ডাকবো।
ছি ছি কি যে বলেন স্যার। এখন আবার আপনাকে আমার অন্যমানুষ লাগছে। এমন মানুষ আমি কখনো দেখিনি। পথেই তো থাকি। কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। কেউ আপনার মতো না।
ওদের সঙ্গে তো তোর অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়। তাদের চিনবি কী করে? আমার সঙ্গে তোর রোজ দেখা হয়। কাজের বাইরে অন্য সময়ে ডাকলেও তুই আসিস। ঘরের ছেলের মতো হয়ে গেছিস।
হ্যাঁ, এই বাড়িটা আমার দ্বিতীয় ঘর। বেঁচে থাকার শুরুতে ঘর পেয়েছিলাম। মায়ের আদর, দিদিদের যতœ সব পেয়েছি। এখন আপনার কাছ থেকে শেখার জায়গা পেয়েছি। ভালোবাসা পেয়েছি। আমি পৃথিবীর ভাগ্যবান ছেলে।
কোথা থেকে এসেছিস তা জানার ইচ্ছা হয় না?
একটুও না। ওদের কথা ভাবলে আমার ঘেন্না হয়। আমার তো মনে হয় আমি একটা শেয়ালের পেটে জন্ম নিয়েছিলাম।
শেয়ালের ওপর তোর রাগ হলো কেন রে?
জানি না। এমনি মনে হলো। কথার কথায় শেয়ালের নাম এসেছে।
মানুষের কথা মনে হলো না কেন?
মনে হয়। ওদেরকে আমি হারামি ভাবি।
সব মানুষ খারাপ হলে তোর বাবা পেতি কোথায়?
আমার বাবা দেবতার মতো মানুষ। একটু থেমে আবার বলে, আপনাকেও আমার দেবতার মতো মানুষ লাগে।
কেন রে? আমার ভেতরে কি পেলি?
আপনি মানুষকে ভালোবাসেন। আপনি তো আমাকে রাস্তা থেকে ডেকে এনেছেন। কাজে লাগিয়েছেন। বিশ্বাস করেন।
আমার দরকারে এনেছি। তুই আমাকে সাহায্য করবি সেজন্য ডেকেছি।
তা ঠিক, কিন্তু খারাপ ব্যবহার করেন না। আদর করেন। আর আপনি মাঝে মাঝে এত অন্যরকম মানুষ হয়ে যান যে সেটা আমার খুব ভালো লাগে।
ভয় করে না? মনে হয় না এখানে থেকে পালিয়ে যাই?
না, একদম মনে হয় না। আমার যখন বিয়ে হবে তখন আমার বউকে বলব, আপনার সব কাজ করে দিতে। খালাম্মার দেখাশোনা করতে।
তুই কবে বিয়ে করবি জুয়েল?
জুয়েল লাজুক হেসে বলে, জানি না। আমার বিয়ের কথা এখনো ভাবিনি।
তোর বউ কি তোর বাবা ঠিক করবে?
জানি না। বাবা যদি কাউকে বিয়ে করতে বলে আমি রাজি থাকব। বাবার কথার উপর আমার কথা নাই।
কথা শেষ করে ও মেঝে থেকে বাজারের স্লিপটা তুলে নেয়। লম্বা স্লিপ হয়েছে। অনেক কিছু কিনতে হবে। ও স্লিপের দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো পড়ছে। অনেক সময় হাতের লেখা বুঝতে কষ্ট হয়।
আমি আবার মৃদুস্বরে ওকে ডাকি, জুয়েল।
ও আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, স্যার।
তোর কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়নি?
এখনো হয়নি। তবে হয়তো অল্পদিনে হবে। বাবাকে সে মেয়ের কথা বলব।
তোর বিয়ের আয়োজন আমার বাড়িতে করব।
ও জোরের সঙ্গে বলে, না। কখনোই না। এ বাড়িতে বিয়ে হবে না।
কেন? কেন না করছিস? এ বাড়ির খারাপ কী হয়েছে?
এ বাড়িতে একজন মরা মানুষ আছে। জুয়েল এবারও চেঁচিয়েই বলে।
কি বললি মরা মানুষ? কি বললি তুই? ডালিয়া মরা মানুষ-
আমি উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াই। থরথর করে আমার শরীর কাঁপে। আমি পা বাড়াতে পারছি না। ওকে কষে দু’টো থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে। ও দু’পা পিছিয়ে সরে গেছে। খোলা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো ভাবছে, আমি তাড়া করলে দৌড়ে পালাবে। ও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলে, শুধু নিশ্বাস পড়লেই মানুষ বেঁচে থাকে? এমন বেঁচে থাকা আমি চাই না। এইটা কোনো জীবিত মানুষ হলো?
হারামজাদা। ফের যদি এই কথা বলবি-
আমার যে মাকে আমি দেখিনি সেও আমার কাছে মরা মানুষ।
তুইতো তাকে নিশ্বাস ফেলতে দেখিস না শয়তান। সে তোর সামনে নাই।
ওই একই কথা।
কখনোই একই কথা না।
আমার যা মনে হয়েছে তা আমি বলেছি।
তোকে একটা কথা বলি শোন, তোর খালাআম্মা যতদিন নিশ্বাস ফেলবে ততদিন আমি তার পাশে থাকব। যত্ন করব। স্যুপ খাওয়াব।
জুয়েল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার দিকে তাকায় না। আমি ঘরে গিয়ে বাজারের টাকা আনি। টাকাটা ওর হাতে দিয়ে বলি, সবসময় মন ভালো রাখিস। মানুষকে দেখতে হয় বুকের চোখ দিয়ে। যেমন তোর বাবা তোকে দেখেছিল। তার বুকে চোখ ছিল বলেই তুই তার আদর পেয়েছিলি।
ও ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে, আমার বুকের ভেতর চোখ নাই।
চোখ জন্মের সময় থাকে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বানাতে হয়। আমি তোকে চোখ বানাতে শেখাব। শিখবি তো? মানুষের চোখ মানুষই বানায়। শুধু শিখতে হয়।
ও চুপ করে থাকে। মুহূর্ত সময় মাত্র। তারপর ঘাড় নেড়ে বলে, যাই। ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, শিখব। আমি চোখ বানানো শিখব।
কতক্ষণ লাগবে বাজার করতে?
তাড়াতাড়ি আসব। ও ফিক করে হেসে বলে, স্যার আপনার জন্য কাজ করতে আমার ভালোলাগে। মাস শেষে টাকা নেই অভাবের জন্য। এই টাকা দিয়ে বাবার জন্য ওষুধ কেনা হয়। এটাই কি বুকের চোখ স্যার?
আমি মাথা নাড়ি। ওর কাঁধে হাত রাখি। পিঠ চাপড়ে দেই।
আমার চোখটা আরও বড় বড় করতে হবে। অনেক বড়। আমার মা ও দিদিদের দেখতে হবে। বেলিকে দেখতে হবে। আরও অনেককে দেখতে হবে।
হ্যাঁ, এভাবে সবাইকে দেখতে শেখা খুব দরকার।
আমি আপনার কাছ থেকে দেখতে শিখতে পারব। আমার বুকে দুইটা চোখ থাকবে না। হাজার হাজার চোখ থাকবে।
আমি হা-হা করে হাসি। ও লজ্জা পায়। ওর অনুভবে আমি খুব আনন্দ পাই। পথের ধারের একটি ছেলে আমার কাছ থেকে শিখতে পারছে। ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষার্থী না। ও জীবিকার অর্থনীতি শিখছে। কার্ল মার্কস আমার গুরু। আমি মার্কসীয় দর্শন ওকে কীভাবে শেখাব। সেটা হবে না। ওর চারপাশ থেকে অর্জিত জ্ঞান ওর অভিজ্ঞতার ঘরে অনবরত জমা হবে।
স্যার টাকা! ও হাত বাড়ায়।
ও, হ্যাঁ। এই নে। স্লিপ দেখে কেনাকাটা করবি। ভুল হয় না যেন। আজকে বাজার একটু বেশিই হবে।
সবই ঠিকঠাক মতো আসবে স্যার। আপনি ভাববেন না। এখন তো নেইলা বুয়া আসবে খালাআম্মার কাপড় ধোয়ার জন্য।
ওহ্, তাই তো। ঠিক আছে তুই যা।
আমি দরজা বন্ধ করে দ্রুত ডালিয়ার বিছানার পাশে আসি। নিষ্পাপ শিশুর মতো দু’চোখ বন্ধ করা ডালিয়া আমার সামনে এখন অরেঞ্জ নদী। আমি বলি, আমার অরেঞ্জ নদী চোখ খোল।
আগে যখন ওকে অরেঞ্জ নদী ডেকেছি, ও বলতো, অরেঞ্জ নদী নাম আমার পছন্দ না। ও আরও বলতো, দক্ষিণ অফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া অরেঞ্জ নদী আমি হতে চাই না গো। তুমি আমাকে আগুনমুখা ডাক। আগুনমুখা আমাদের নদী। বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মিশেছে।
আমি বলতাম, আমি যে তোমাকে বিশ্বজুড়ে দেখতে চাই। ডালিয়া আমাদের ভালোবাসার সীমানা নেই। আমাদের ভালোবাসা পৃথিবীর সবটুকু।
ডালিয়া উজ্জ্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলতো, তুমি এমন করে কথা বলো যে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তোমার কথা শুনলে আমি নিজেকে খুঁজে পাই না।
সম্পর্ক তো এমনই হওয়া দরকার ডালিয়া। দু’জনে যেন দু’জনের ভেতরে আটকে থাকি। বোধে-চেতনায়-বোঝায়-চিন্তায়-
ডালিয়া দু’হাত উপরে তুলে জোরে জোরে বলতো, হয়েছে হয়েছে থাম। থাম। একজীবনে এতবড় জায়গা ধরে রাখা কঠিন। মনের ভেতরে ক্ষয় আছে, ভূমিকম্প আছে, বন্যা-খরা আছে। সবকিছুই সম্পর্কের দেয়ালে আঘাত করবে। ভুলে যেও না যে আমারও মানুষ।
ঠিক বলেছ। আমার উচ্ছ্বাস ঝিমিয়ে যায়। আমি মিনমিন স্বরে বলি, হ্যাঁ আমরা মানুষ। আমাদের রাগ আছে, হিংসা আছে, নীচতা আছে, ভালো কিছু মেনে না নেয়ার দ্বন্দ্ব আছে। হ্যাঁ, আমরা তো মানুষই আগুনমুখা-ডালিয়া। (চলবে)
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ অক্টোবর ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন