ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সেলিনা হোসেনের ধারাবাহিক উপন্যাস || প্রথম কিস্তি

সেলিনা হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেলিনা হোসেনের ধারাবাহিক উপন্যাস || প্রথম কিস্তি

আমি আরিফুর রহমান। বয়স চুয়াত্তর।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে জীবন কাটিয়েছি। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার সাধনার জায়গা। জীবনভর মনে করেছি যে আমি একটি কাচের ঘরে বাস করেছি। যেদিকে তাকিয়েছি সেদিকেই দেখেছি নিজের চেহারা। কখনো সে চেহারা খুব অন্তরঙ্গ মনে হয়েছে। কখনো একদমই অচেনা। যেন অন্য কেউ আমারই সবটুকু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শিক্ষকতা পেশায় আমি পঁয়তাল্লিশ বছর কাটিয়েছি। এখন অবসর জীবনে আছি। আমি জানি পেশা থেকে অবসর নিলেই অবসর জীবনে ঢোকা হয় না। অবসর কখনো ঘাড়ের ওপর বোঝার মতো চেপে বসে। এই মুহূর্তে আমি আমার ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় বসে আছি। যে ইজিচেয়ার এখন আমার দখলে এটি আমার প্রিয়। বেশ প্রিয়। যথেষ্ট পুরনো হয়েছে। প্রায় একত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। কিন্তু বসতে আরামদায়ক লাগে দেখেই ফেলে দেইনি। কখনো সখনো কোনো ঘটনা বা বস্তু এভাবে আঁকড়ে থাকে মানুষকে।
দক্ষিণের বারান্দায় এলেই আমার ভেতরে দার্শনিক চিন্তা কাজ করে। আমি অনবরত খুঁজতে থাকি জীবনের জন্য অর্থবহ পরিসর। পরিসর আমার জন্য ব্যাপ্ত চিন্তা। এখন খোঁজাই আমার নিয়তি। আমি হারিয়েছি অনেক। হারিয়েছি ডালিয়াকে। গত পাঁচ বছর ধরে ডালিয়া আমার সামনে থেকেও নেই। আমি তো অনবরত সেই ডালিয়াকে খুঁজেছি যাকে একদিন ভালোবাসার কথা বলেছিলাম। ও মৃদু হেসে বলেছিল, জানতাম তুমি একদিন আমাকে তোমার জীবনের প্রিয় কথাটিই বলবে।
কী করে জানলে?
তোমার চোখের ভাষা আমাকে বলে দিয়েছিল। মানুষ কীভাবে চোখের ভাষা তৈরি করে তা আমাকে অনেক দিন ভাবিয়েছে। সেদিন থেকে আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম তোমার ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য।

আমি অবাক হয়ে ডালিয়ার দিকে তাকিয়েছিলাম। দেখেছিলাম ডালিয়ার নিজের চোখের দৃষ্টি আশ্চর্য উজ্জ্বল। আমার মুগ্ধতার শেষ ছিল না সেই দৃষ্টির জন্য। এখন ওর চোখ আছে, কিন্তু দৃষ্টি নেই।
গত পাঁচ বছর ধরে আমি ওর বোজা চোখ দেখি। যেদিন থেকে ও চোখ বুজেছে সেদিন থেকে আমি ওর দৃষ্টি খুঁজে বেড়াই। খুঁজি এই বাড়ির সবটুকু জায়গাজুড়ে। এই বাড়ির বয়স এখন ছাব্বিশ বছর। এক বিঘা জমির ওপর বাড়ি। শোবার ঘরটি অনেক বড়। আলো-বাতাসের অভাব নেই। রোদ এসে ভরে যায় ঘরে। ডালিয়া সুস্থ থাকতে পর্দা সরিয়ে ঘরের সব জানালা খুলে রেখে বলতো, দেখো রোদ-বাতাসের লুকোচুরি। আলোর ছায়ায় জীবনচুরি।
আমি হেসে বলতাম, জীবনচুরি কি?
সবকিছু কি অর্থ মিলিয়ে বলি নাকি? যা মনে আসে তাই বলি। হাসিতে গড়িয়ে পড়ত ডালিয়া। ওর হাসিতে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ত ঘরে। আমি বুক ভরে শ্বাস   টেনে নিয়ে বলতাম, প্রেমের হাসি এমনই সুন্দর। যেন আমি একটা বিশাল তিমি। হাসির সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি।

বাব্বা, কবি হতে বাকি নেই তোমার।
আমি চোখ বড় করে বলতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি অর্থনীতি পড়াই। রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখি।
এটাও কবিতার মতো করে বললে। ডালিয়া আবার বাঁধভাঙ্গা হাসিতে ভেঙে পড়তো। হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দু’’হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলতো, আমাদের জীবন কবিতা লেখার খাতা। এখানে দুঃখের কবিতাও লেখা হবে। শুধু আনন্দের না।
কথা বলে ওর সঙ্গে জেতা আমার জন্য কঠিন ছিল। আমি ভেতরে ভেতরে চেষ্টা করেছি। ওকে বুঝতে দেইনি। তারপরও দেখতাম ও যা বলে সেটা সুন্দর। আমার কথা আড়াল হয়ে যায়। সেদিন ও বলেছিল, দুঃখেরও কবিতা লেখা হবে। আমি এখন সেই দুঃখের কবিতায় আছি।

এই বড় আকারের শোবার ঘরে ডালিয়া এখন একা শুয়ে আছে। বাড়িতে আরও তিনটে বেড়রুম আছে। দু’টোয় থাকতো আমার দুই ছেলেমেয়ে। আর একটি অতিথিদের জন্য। ছেলের ঘরটিতে আমি থাকি। মেয়ের ঘরটি ফাঁকা। ছেলে ভ্যাঙ্কুবারে থাকে। মেয়ে সুইডেনে। দুজনেই চাকরি করে। দু’জনেই বিয়ে করেছে। মেয়ের স্বামী বিদেশি। ওদের ঘরে চারজন নাতি-নাতনি আছে। সবকিছু মিলিয়ে আমার ভালো থাকার কথা ছিল। আমার ভালো থাকা হয়নি। ডালিয়াকে খুঁজে ফিরে আমি সময় কাটাই। এক আশ্চর্য সময়!
আমার জীবনে এমন আশ্চর্য সময় অনেকবার এসেছে। সময়ের চিন্তায় আমি ড্রইংরুমে আসি। আমিতো আমার সময়কে বাজিয়েছি- খুঁজেছি হারিয়ে যাওয়া মানুষকে। আমি সঙ্গীত শিল্পী আলতাফ মাহমুদের ছবির সামনে এসে দাঁড়াই। না, ছবিটা ওর একার নয়। সঙ্গে আমিও আছি। ও আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল। আমাদের যৌবনের শুরুর সকালটি ছিল জীবনের এক আশ্চর্য সময়। যৌবনে আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। সেই সময় আমার সামনে স্থির হয়ে আছে। সহস্র মুক্তোর মালায় জড়িয়ে আছে সময়। শুধু খুঁজে পাই না আলতাফকে। খুঁজতে থাকি অনবরত।

ড্রইংরুমে চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি আমার সময় এখন কাচের দেয়াল। দেয়ালজুড়ে ফুটে আছে আমারই চেহারা। চোখে চোখ পড়লে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে, তুমি কেমন আছ?
ভালো নেই। আমি মাথা নাড়ি।
ভালো থাকার উপায় খোঁজ।
কত আর খুঁজব। খুঁজতে খুঁজতে জীবনের শেষ সীমায় এসেছি।
উপায় খোঁজাই বেঁচে থাকা।
উপদেশ দিচ্ছ?
যদি মনে করো উপদেশ, তাহলে তাই। এই শর্ত তুমি মানতে পার, নাও পারো।
আমি চেঁচিয়ে বলি, মানি না। মানি না।
আমার চিৎকারে মুখের ভঙ্গি বদলে যায়। চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে ওঠে। দাঁত বেরিয়ে পড়ে। জিহ্বা দেখা যায়। ঘরের চারদিকে কুৎসিত একটা কিছু যেন ভেসে উঠেছে। আমি নিজেকে করুণা করি এবং ঘৃণাও। চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে আমার মাথা ঝিম মেরে যায়। আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ি। নিজের দিকে তাকাতে আমার ভয় করে। আমি এক ভয়ঙ্কর প্রাণী বুঝি। আমার খোঁজার প্রহর কাটে না। আমি ডাইনোসরের সময়ের মানুষ হয়ে যাই। আমি নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি।

বুঝতে পারি ডালিয়া এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে। বলছে, ওঠো। আমার হাত ধরো। চলো আমরা তালতলীর বৌদ্ধ মূর্তিটি দেখে আসি। অসাধারণ সুন্দর বুদ্ধকে দেখে তোমার বেঁচে থাকার স্বপ্ন ফুল হয়ে ফুটবে।
আমি ডালিয়াকে বলি, ডালিয়া আমাদের সময় কি ফুরোয়নি?
না, আমাদের সময় কোনোদিন ফুরোবে না। আমরা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের গর্তগুলো বুঁজিয়ে দেবো।
আমরা চাইলেও তা পারবো না। ফাঁকি দেয়ার চিন্তাকে আমি ঘৃণা করি ডালিয়া।
আমার কান্না ফুরোয়। শুনতে পাই মৃদুকণ্ঠের ডাক, নানাভাই।
আমি দু’হাতে চোখ মুছে ওর দিকে তাকাই। ওর হাতে ঝাড়ু এবং ন্যাকড়া। ও রাস্তায় ফুল বিক্রি করে। যখন সময় পায় তখন এসে আমার ঘরগুলো পরিষ্কার করে দিয়ে যায়।
আমার দিকে তাকিয়ে বলে, নানাভাই ঘর ঝাড়ু দিমু? কোন ঘর আগে?
ও প্রতিদিন এমন একটি প্রশ্ন আমাকে করে। আমার মনে হয় এটাও ওর খোঁজা। ডালিয়ার অসুস্থতার পরে আমি ওকে কাজের জন্য ডেকে এনেছি। বলেছি, যখন খুশি আসবি। যেভাবে কাজ করতে ভালোলাগবে সেভাবে করবি। শুধু ঘরগুলো পরিষ্কার থাকা চাই।
আবার শুনতে পাই ওর কণ্ঠস্বর।
নানাভাই কোন ঘর আগে?
রায়নার ঘর। আমার মেয়ের ঘর আগে ঝাড়ু না দিলে আমার শান্তি লাগে না।
ওই ঘরে অনেক মাকড়সা। ওই ঘর ঝাড়ু দিতে আমার ডর করে।
মাকড়সা কোথায়? আমি তো মাকড়সা দেখতে পাইনা।
সারা ঘরে মাকড়সা আছে। কোনহানে যে মাকড়সা নাই তা কইবার পারুম না।
চল তো দেখি। তুই তো আমাকে নতুন কথা শোনালি।


আমি ওর সঙ্গে রায়নার ঘরে আসি। কতদিন যে আমি রায়নার ঘরে ঢুকিনি তা আমার মনে নেই। আসলে তা নয় এই ঘরে তো আমি রোজই ঢুকি। তবে কেন এমন হয়, ওর ঘরে ঢুকলে আমি ওকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু কোথাও ওকে পাই না। উল্টো আমার বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ হয়। আমি জানি ও আমার কাছে নেই। দূর দেশে আছে। চাকরি করছে। বিদেশি ছেলেকে বিয়ে করে ঘর-সংসার করছে। দু’টি সন্তানের মা হয়েছে। তারপরও আমার কেবলই মনে হয় আমি ওকে হারিয়েছি। আমার সামনে ওর শৈশব আর কৈশোর আছে। আর কিছু নেই। এই ফুল বিক্রি করা মেয়েটির নাম বেলি। আমি ওকে ‘বেলফুল’ ডাকি। কারণ ওকে দেখে আমার রায়নার কৈশোর দেখা হয়। রায়নাকে ফুল বিক্রি করতে হয়নি। ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। বিদেশে গিয়ে পিএইডি  করেছে। এখন সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। বেলির মধ্যে ওর কৈশোর খোঁজার বিষয় জানতে পারলে আমার মেয়ে চিৎকার করে বলবে, তুমি আমাকে অপমান করছ বাবা। একটা পথের মেয়ের মধ্যে আমার কৈশোর খুঁজছ? তোমার মাথায় কি গোলমাল হয়েছে বাবা?

হ্যাঁ, তাইতো। আমার মাথায় গোলমাল হয়েছে কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়। আমি জানি আমি সুস্থই আছি। আমি যে কোনো মেয়ের মাঝে আমার মেয়ের কৈশোর খুঁজতে পারি। আমার সামনে শ্রেণি-বৈষম্যের ভেদরেখা ঘুচে যায়। আমি মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য দেখতে চাই না। আমি এই আদর্শ নিয়ে বড় হওয়া চিন্তাকে খুঁজে ফিরি। বুঝতে পারি চারদিকের সবখানে মাকড়সার বাসায় ভরে আছে। ওদের বাসাগুলো এক একটি গোলকধাঁধা।
আমি বেলফুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, মাকড়সাকে তোর ভয় লাগে কেন রে নাতনি?
আমি কইতে পারুম না। আমার মা যেদিন গাড়ির তলে পইড়া মইরা গেল তখন মা রে দেইখা মনে হইছিল, মা একডা মাকড়সা হইয়া গেছে। ছোডবেলা থাইকা আমি মাকড়সা দেইখলে চিল্লাইতাম।
আমিও মাকড়সা দেখলে ভয় পাই রে বেলফুল।
আপনে ভয় পাইবেন ক্যান? আপনে তো আমার মতো ছোডু না। আপনে অহন খালার ঘরে চলেন।
আয় দেখি।
আমি ওর সঙ্গে রায়নার ঘরে সামনে গিয়ে দাঁড়াই। চারদিকে তাকিয়ে দেখি ঘরটা গোছানোই আছে। শুধু দেয়ালের এককোণায় একটি ছোট্ট মাকড়সার জাল ঝুলছে। কোথাও আর কিছু নেই। আমি ফুলবিক্রি মেয়ের দিকে তাকাই। বলি, বেলফুল আয়।
ও ঝাড়– বুকে চেপে ধরে নিজেকে সামলায়। পা টিপে টিপে ভেতরে ঢোকে। দ্রুত ঘর ঝাড়ু দেয়।
আমি বলি, ওই কোণায় মাকড়সার জাল আছে। ভেঙে আয় বেলফুল।
আমি পারুম না। মায়ের গালে ঝাড়ু লাগাইতে পারুম না। ওইডাতে আমার মরা মা।
তাহলে ঝাড়ুটা আমাকে দে। আমি ওর হাত থেকে ঝাড়ু নিয়ে দেয়াল থেকে মাকড়সার জাল পরিষ্কার করি। আতঙ্কিত মেয়েটি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ওর হাতে ঝাড়ু ফেরত দিতে গেলে ও বলে, ঘর তো সাফ হয় নাই নানাভাই। মাকড়সার বাসাতো সারা ঘরে আছে।
কই, আমি তো আর দেখছি না। কি বলিস তুই?
আমি তো দেহি। সবখানে আছে। খাটে, টেবিলে, আলমারিতে, আলনায়। কোনহানে নাই?
আমি ওর মাথায় হাত রেখে বলি, তোর খিদে পেয়েছে বেলফুল?
হ, পাইছে। সকাল থাইকা কিছু খাই নাই।
আয় আমার সঙ্গে। দেখি ফ্রিজে কি আছে।

ফ্রিজ খুলে ভাত আর গরুর মাংস পাই। একটি থালায় ভাত-মাংস নিয়ে ওকে বলি, ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে আয়। রান্নাঘরের ওই পিঁড়িতে বসে মনের আনন্দে খাবি। মনে কোনো দুঃখ যেন না থাকে।
চোখে পানি থাকব না?
চোখের পানি? হ্যাঁ, চোখে পানি রাখতে পারিস, যদি তা খুশির পানি হয়।
আচ্ছা। ও খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে দৌড়ে বাথরুমে যায়। আমার বুক চেপে আসে। আমি রান্নাঘরে ঢুকি। পানি খাই। ডালিয়াকে স্যুপ খাওয়াতে হবে। স্যুপ তৈরির উদ্যোগ নেই। পাঁচ বছর ধরে ঢাকা শহরের আত্মীয়-স্বজন ডালিয়ার জন্য স্যুপ বানিয়ে পাঠায়। হঠাৎ করে কেউ না পাঠাতে পারলে সেদিন আমি করি। তারপর নলে ঢেলে ওকে খাওয়াতে হয়। হায় ডালিয়া, তুমি এমন করে আমার সামনে থেকে নিখোঁজ হয়ে যাবে? এ কেমন ভালোবাসা বুকে নিয়ে তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলে? আমার চোখে পানি আসে। আমি মুছি না। চোখের পানি গড়াতে দেই। হাত ধুয়ে রান্নাঘরে ফিরে আসে বেলফুল। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে, নানাভাই আপনার চোখে পানি ক্যান?
আমি ওর দিকে তাকাই না। ও আবার ডাকে, নানাভাই। আমি ওর দিকে না তাকিয়ে বলি, কি বলবি বল।
আপনের চোখের পানি খুশির না দুঃখের নানাভাই?
দুঃখের। আমি এবারও ওর দিকে তাকাই না।
আপনে আমার চোখে খুশির পানি রাখতে কইছেন। তাইলে আপনের চোখে দুখের পানি ক্যান?
আমার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে ও বলে, নানির লাইগা? নানি যে মইরাও বাঁইচা আছে হের লাইগা?
তুই ভাত খেয়ে নে বেলফুল।
আইচ্ছা। ও থালা নিয়ে মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে। ওর আনন্দ আমাকে তোলপাড় করে। মাত্রতো এক থালা ভাত! যেন এটুকুই ওর এই জীবনের সঞ্চয়। ও জমিয়ে রাখবে সারাজীবন।
ভাত খেয়ে ও আমাকে বলে, আইজ আমি নানির নলের মদ্যে সুপ দিমু। দিমু তো নানাভাই?
না। তোর কাজ ঘর পরিষ্কার করা। তুই যে কাজের জন্য এই বাড়িতে আসিস সেটাই করবি।
হ, তাইতো। অহন কোন ঘর ঝাড়ু দিমু?
তোর মামার ঘর। ভাত খেয়ে পেট ভরেছে?
হ, ভরছে। ও বেসিনে হাত ধুয়ে নেয়। থালা ধুয়ে এক কোণায় রাখে। এই একটি থালা আলাদা করে রাখা আছে ওদের তিনজনের জন্য। যে ছেলেটি রাস্তার ধারে বসে জুতো সেলাইয়ের কাজ করে ও আমার বাজার করে।  যে ছেলেটি রাস্তায় ঝাড়ু দেয় ও আমার গাড়ি পরিষ্কার করে। আর পাশের বাড়িতে কাজ করে যে মহিলা সে সন্ধ্যায় এসে আমার রান্না করে দেয়। এভাবে আমার রাতদিনের কাজের হিসাব চলে। আমিতো বেশ আছি। অকস্মাৎ হা-হা হাসিতে আমি চারদিক ফাটিয়ে দেই। বেশ মজা পাই। বেলফুলের হাত থেকে মেলামাইনের থালা পড়ে যায় বেসিনের উপর। ও দ্রুত উঠিয়ে রেখে বাইরে চলে যায়। বুঝতে পারি আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস ওর নেই। আমি চুলো থেকে প্যান নামিয়ে রাখি। আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে ভাবি সব কষ্ট পুড়িয়ে দাও আমার। যদি পোড়ানোর সাধ্য না থাকে তবে দাউদাউ জ্বালো কেন আগুনের পরশমণি! আমি আমার মন তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি পুড়িয়ে দগ্ধ করো। আমি মন নামের এক টুকরো কয়লা নিয়েই বাঁচতে চাই। বেঁচে থাকার অর্থ তো আমার ফুরিয়েছে। আমি চুলো বন্ধ করি। এখন আমার ডালিয়ার কাছে যেতে হবে। ওকে পরিষ্কার করতে হবে, কাপড় বদলে দিতে হবে।

শুনতে পাই বেলফুল চিৎকার করছে, নানাভাই নানাভাই।
আমি ইশতিকের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, কি হয়েছে বেলফুল?
খাটের নিচে একটা বড় ইঁন্দুর। কেমুন কইরা যেন চাইয়া রইছিল।
তুই ওটাকে ‘মামা’ ডাকবি।
মামা? বেলির কান্নাভেজা চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়।
হ্যাঁ, মামা। ওর তোর ইশতিক মামার ঘরে থাকে। তোর মামাকে ভালোবেসে।
ইন্দুর মামা হয় ক্যামনে? ও আল্লাহরে আমি আর এই বাসায় কাম করুম না। আগে তো এই বাসায় মাকড়সা আর ইন্দুর আছিল না। আইজ ক্যান এমুন লাগতাছে।
ও ঘরের ভেতর লাফালাফি করে। আমার মনে হয় ইশতিক ওর কৈশোর নিয়ে এই ঘরে এসেছে। বড় অল্প সময়ের জন্য। আমি বেলফুলকে দেখি। ও ছেলে না মেয়ে তা আমি চিন্তায় রাখি না। শুধু এক আশ্চর্য সময় আমার সামনে।
এক কিশোরীর মাঝে আমি খুঁজে বেড়াই আমার জীবনের এক ক্ষুদ্র অংশ- যেখানে গোলাভরা শস্য ছিল। শস্যের দানা খাওয়ার জন্য ইদুঁরের ঘোরাফেরা ছিল। আর ইদুঁরের খেয়ে-যাওয়া শস্যদানার খোসার ভেতর জড়ো হয়ে গেছে হারানো সময়। আমি হল অফ মিরর এফেক্টে একজন ধ্যানমগ্ন সত্তা। অন্তহীন জিজ্ঞাসায় নিমজ্জিত জীবন। আমি বেলফুলের হাত ধরে বলি, আজ তোর ছুটি। বাড়িতে যা।

ও ঘরের মধ্যে ঝাড়ু ফেলে একছুটে বেরিয়ে যায়। আমি এসে দাঁড়াই ডালিয়ার বিছানার কাছে। ওকে একজন সন্ত নারীর মতো লাগছে। গায়ে সাদা রঙের চাদর। দু’চোখ বোজা। শ্বাস পড়ছে। আমি চাদরের নিচ থেকে বেরিয়ে আসা ডান হাত ধরি। বলি, ডালিয়া চোখ খোল। ভোর হয়েছে।
যৌবনে আমরা এভাবে একজন আর একজনকে ডাকতাম। যেদিন ওর আগে ঘুম ভাঙতো সেদিন ও জানালার পর্দা সরিয়ে বলতো, দেখ আলো ফুটেছে। ওঠো সোনাপাখি। ময়ূর আমার।
আমাকে নতুন নতুন নামে ডাকার জন্য ও অনেক পাখির নাম মুখস্ত করেছিল। এক একদিন এক এক নামে ডাকতো। আমি ওকে ডাকতাম নদীর নামে।
আজও ওর হাতে ঠোঁট ঠেকিয়ে বললাম, ওঠো আমাজন নদী। দেখো রেইন ফরেস্টের মাথায় আলো ছড়িয়েছে।
ওর হাত ধরে বসে রইলাম। কোথাও কোনো শব্দ নেই।
এমনতো কথা ছিল না ডালিয়া যে তুমি আমার সঙ্গে পাঁচ বছর তিন মাস কথা বলবে না। চোখ খুলে তাকাবে না। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলবে না, শোন গুণগুণ ধ্বনি। তুমি বলো আমার এই ধ্বনি কখনো গানের চেয়েও বেশি মধুময় লাগে। হায় ডালিয়া নিজের সবটুকু নিয়ে তুমি এখন আড়াল হয়ে আছ। তোমার নিশ্বাসটুকুই আমার শেষ অবলম্বন। নিশ্বাস-প্রশ্বাস আমার কাছে এখন এক অলৌকিক আনন্দ। এই আনন্দ নিয়ে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। বুঝতে পারি বেঁচে থাকার সৌন্দর্য কোথাও কোথাও প্রতিটি মানুষের জন্য খানিকটুকু থেকে যায়।
তুমি কতদিন আমাকে বলেছো, আমরা আজ রাতে ঘুমুবো না। তুমি গান করবে আমি শুনব। আমরা কেউই ঘড়ির দিকে তাকাব না। ঘুমে ঢলে পড়ব না। বিষখালি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রক্তাভ আকাশের সূর্য ওঠা দেখব। হায় ডালিয়া, তুমি এখন এসব স্মৃতির বাইরে। বেঁচে থাকার নিষ্ঠুর বিপর্যয়ে আমার দিন এমন কুঁকড়ে যাবে, কি করে মেনে নেই তা।






রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়