ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সেলিনা হোসেনের ধারাবাহিক উপন্যাস || ষষ্ঠ কিস্তি

সেলিনা হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২৮ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেলিনা হোসেনের ধারাবাহিক উপন্যাস || ষষ্ঠ কিস্তি

ঘরের ভেতর নেংটি ইঁদুর ছোটাছুটি করছে। কিচকিচ শব্দে বোঝা যায় ওর ছুটে বেড়ানোর আনন্দ। একসময় ঘুম আসে ওর। চেয়ারে বসেই ঝিমোয়। তারপরও ওর বিছানায় যেতে ইচ্ছা করে না। অনেক দিন বিছানার চাদরটি ধোয়া হয়নি। নোংরা হয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে নোংরা চাদর বোঝা যায় না। আসলে ও নিজেকে গোছাতে পারছে না। প্রবল অস্থিরতা ওকে কুরে খাচ্ছে। ও বদরুলকে নিয়ে সাজেক ভ্যালি যাবে বলে ঠিক করেছে। জলফুকে নিয়ে যাবে কি? নিতে চাইলেই কি নেওয়া যাবে? ও কি যেতে রাজি হবে? ওসমান আলি ক্লান্তিবোধ করে। মনে হয়, ইঁদুরটা দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কিচকিচ শব্দ নেই অনেকক্ষণ। মশা ভিড় করেছে। দুই হাতে মেরেও শেষ করা যাচ্ছে না। রাতে আর বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। কাল একটি বাল্ব কিনতে হবে। ও ভাবে, এসব ভাবনার মানে কী? বুঝতে পারে, আসলে ও নিজেকে গোছাতে পারছে না। বড় কষ্ট। এই কষ্টের রাত ওর স্মৃতি। কোনো দিনই মাথা থেকে নামবে না। ও হাই তোলে। সোজা হয়ে বসে। বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘরের বাইরে আসে। মনে হয়, রাতের আর বেশি বাকি নেই। খুবই অস্পষ্টভাবে দিনের আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে। ওসমান এই প্রথম নিজের তারুণ্যের জন্য ব্যথিত হয়। ভাবে, শুধু লেখাপড়া শেখাই যথেষ্ট নয়, যদি না তার সঙ্গে আরো নানা কাজ যুক্ত করা যায়। এই মুহূর্তে জলফু ওর সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল নাড়াচ্ছে। ওকে সবুজ ব্যাঙ ডাকা বা এক-দুবেলা ভাত খাওয়ানো যথেষ্ট নয়, যদি না ওর সবটুকু দেখভাল করা যায়। ওসমান বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে করতে মনের ভেতরে নিজের জন্য করুণার পাহাড় গড়ে। বলে, হায় বেঁচে থাকা!

 

তিন দিন পরে দিনের বেলা জলফুর খোঁজে কবরস্থানের গেটে গেলে জমিরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়। ওর জন্য একটা টান লাগছিল সেদিনের পর থেকে। জমিরুদ্দিন ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে জমির ভাই?
আপনে তো রাইতে আসেন, আইজ দিনের বেলা আসছেন ক্যান?
জলফুকে খুঁজতে। ভাবলাম ওকে দেখে যাই। ও কেমন আছে?
কেমন আর থাকব? ভালাই আছে। কেমন আছে আপনেরে দেখাই। আহেন।
জমিরুদ্দিন কবরস্থানের ভেতরে ঢোকে। নতুন কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ দোয়া পড়ছে। কোথাও একজন নারী কেঁদেকেটে নিজের ভেতরটুকু নিঃশেষ করছে। বড় নিঃশব্দ কান্না। তারপরও ফোঁপানির শব্দ শোনা যায়। ওসমান চারদিকে তাকায়। কোথাও জলফু নেই। জলফু ওকে দেখলে দৌড়ে কাছে আসত। ও ঘাড় ঘুরিয়ে জমিরুদ্দিনকে বলে, জলফু তো এখানে নেই। দেখছি না তো?
আছে। আসেন। জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে কথা বলে। যেন এই আবাসস্থলে যারা আছে তারা সবাই ওর চেনা। ও কখনো কাউকে হারিয়ে যেতে দেখেনি। ও জানে এখানে যারা আছে, তারা সবাই ভালো আছে। শান্তিতে আছে। একজীবনে যারা কষ্টভোগ করেছে তাদের সেই জীবন আর নেই। সব কিছু অবসানের পরে এখন তাদের অপার শান্তি। জমিরুদ্দিন ওর আগে আগে হাঁটছে। শেষ মাথায় গিয়ে নতুন কবরটি দেখিয়ে বলে, এই যে এইহানে আপনার ব্যাঙ। ঘুমাইতাছে। বেওয়ারিশ লাশ হইয়া আসছে।

মানে! ওসমান হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে কবরের ধারে। জমিরুদ্দিনও বসে। হাত বাড়িয়ে কবরের মাটি ছোঁয়। ওসমানের কান্নার বেগ কমে এলে বলে, কেউ অর লাগি কান্দে নাই। আপনেই পত্থম।

 

ওসমান আলি দুই হাতে চোখ মোছে। তারপর মৃদুস্বরে বলে, ও তো বেওয়ারিশ লাশ হবেই, ওর কেউ না থাকতে পারে; কিন্তু ওর তো এভাবে মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। কোথায় পাওয়া গেছে ওর লাশ?

 

কামরাঙ্গীরচরের খানাখন্দে। মানুষজন পুলিশরে খবর দিলে হেরা অরে মর্গে লইয়া গেছে। আধা বেলা ওইখানে পইড়া ছিল। হেরপর আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের গাড়িতে কইরা এখানে আইনলে আমি অরে চিনা ফালাই।

তুমি কি আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লোকদের বলেছিলে আমি ওকে চিনি। ও আমাদের জলফু। পোলাটারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন ছাত্রও চেনে। ওরে অনেক আদর করে।
এবারও জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, না কাউরে কিছু কই নাই। কইয়া কী লাভ? মইরাই তো গেছে। অহন ওরে চেনা না চেনা সমান।

কেউ তাকে চিনত এটা প্রমাণ হতো। লোকেরা জানতো যে এই শহরে ওর কেউ আছে। ও পরগাছা না।
থোন, এইসব ধানাইপানাই। পথের পোলার আবার পরিচয়। তয় অরে আমি যত্ন কইরা ধোয়াইছি। কাফনের কাপড় পরাইছি। আতর মাখাইয়া দিছি। নিজে অরে কবরে নামাইছি।
ওসমান আবার কাঁদতে কাঁদতে জমিরুদ্দিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, শেষ বেলায় ও কারো যত্ন পেয়েছে। এটুকুই আমার জন্য সান্ত্বনা।
না, আপনের লাগি কনু সান্ত্বনা নাই। পথের পোলারে ভালোবাসতে কে কইছে আপনেরে?
ওসমান আলি সরাসরি তাকিয়ে বলে, তুমি কি আমাকে আরো দুঃখের কথা বলবে?
জমিরুদ্দিন অন্যদিকে তাকায়। ওসমান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো? কে ওকে মারতে পারে?
হেইডা আমি ক্যামনে কমু। জানি না।
তোমাদের আশপাশের কেউ? তুমি কি জানো ও কার সঙ্গে থাকত?
জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, না, জানি না।
নাকি বলতে চাও না জমির ভাই?
আপনে আমারে পুলিশের মতো জেরা করেন ক্যান? আপনে কি পুলিশ? যত্তসব। চলেন বাইরে যাই।
ওর শরীরে কোথাও আঘাত ছিল জমির ভাই?
জমিরুদ্দিন চুপ করে থাকলে ওসমান আবার বলে, কোথায় কোথায় মেরেছিল জানলে-
আপনে তো অর কেউ না। এত কথা জিগান ক্যান? খবরদার আর কিছু জিগাইবেন না।
শুধু বলো ওর মাথা কি ফাটিয়ে দিয়েছিল?
না, মাথা ঠিক আছিল। চেহারা দেইখা মনে অইছিল ও ঘুমাইয়া আছে।
ওর বুক-পিঠ ঠিক ছিল?
হ, ঠিক ছিল। আপনে আমারে আর কিছু জিগাইবেন না। চলেন, বাইরে যাই।
তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ। তুমি আমাকে তোমার শেষ কথাটা বলো জমির ভাই। জলফুর কেন মরতে হলো?
জমিরুদ্দিন চারদিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে, শেষ গোসল দিবার সময় আমি দেইখলাম ওর অন্ডকোষ থেতলানো। সব কিছু থেতলানো। যেন কেউ মুগুর দিয়া থেতলাইছে। না হইলে হাতুড়ি দিয়া। না হইলে ইট দিয়া থেতলাইছে।
ওহ মাগো! ওসমান আলি দুহাতে মাথা ঝাঁকায়। জমিরুদ্দিন নির্বিকার কণ্ঠে বলে, আর কিছু জিগাইবেন? জিগান? আইজ বেহানে পানি খান নাই? এত জ্বালা ক্যান?
আমি হোটেলের ওই লোকটাকে পুলিশে দেব।
আপনের পরমান কী? কিছুই পরমান কইরতে পাইরবেন না। পড়ালেহা করতাছেন পড়ালেহা শ্যাষ করেন। যেইটা মরছে হেরে শান্তিতে থাকতে দ্যান। আমি যত দিন বাঁইচা থাকমু তত দিন ওই কবরে দোয়া পড়মু। বেশি দিন তো ওইডা ওর একলার কবর থাকব না। আবার কারো কবর হইব ওই কবরে। যাই। দুনিয়াদারি আন্দার লাগে।
ওসমান আলি একা একা আবার ফিরে আসে কবরের কাছে। বসে দোয়া পড়ে। শেষে বলে, তুই জান্নাতবাসী হবি রে সবুজ ব্যাঙ। আল্লাহ তোকে বেহেশতবাসী করুক।

 

আত্মীয়স্বজনহীন এই ঢাকা শহরে একা একা বাস করতে থাকা ওসমান আলির মনে হয়, আজ বুঝি ও নিজের কৈশোরও হারাল। কাকে বলবে এসব কথা? কার সঙ্গে ভাগাভাগি করবে? কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করার ইচ্ছা নেই। সবাই নিজ নিজ চিন্তায় ব্যস্ত। ও আবার নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। মন দিয়ে ক্লাস করে। স্যারদের লেকচার শোনে। ফিরে এসে দোকানে গিয়ে চা খায়। টিউশনি করতে যায়। তার পরে নিজের লেখাপড়া। কোনো ছেলে নোট চাইলে দেয়। পড়াও বুঝিয়ে দেয়। এত কিছুর পরও ওসমান নিজের সময় কাটানো মুখ বুজে সেরে ফেলে। মাঝে মাঝে নিজের সঙ্গে পেরে ওঠে না। যাকে দিগন্তের কাছে যাওয়ার রাস্তা পায়ে হেঁটে পার হতে হয় তার তো শক্তির অবশিষ্ট কমই থাকে। গ্রামে বড় ভাই অপেক্ষা করছে ওর পরীক্ষা পাসের খবরের জন্য। চাকরি পেলে তার ছেলেমেয়ের পড়ালেখা হবে, এই আশায় দিন গুনছে বড় ভাই। ভালো রেজাল্টের পরে ভালো চাকরি-একটি অসাধারণ রেজাল্ট করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হতে পারে। এই আশায় পাঠের সময় নিজেকে আর কোনো কিছুর কাছে সমর্পণ করে না। মোবাইল বাজলেও ধরে না। মোবাইলে শুধু ওর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় রোজ। মাঝে মাঝে মিরপুর থেকে ফোন আসে। যেদিন শাওনের পড়তে ইচ্ছে করে না সেদিন ও যেতে না করে। কিন্তু ওর কথা শুনে না গেলে চলবে না। ওর মা একটা খাতা দিয়েছে। সেই খাতায় সাইন করতে হয়। না গেলে সেদিনের টাকা কাটা হয়। তারপরও ও টিউশনিটা ছাড়ে না। কারণ অন্য জায়গার তুলনায় টাকার অঙ্ক বেশি। ওর প্রয়োজন মেটানোটাই ওর উদ্দেশ্য। গত বছর একটা প্যান্ট-শার্ট পরে ক্লাস করেছে। এখন আরো দুটো প্যান্ট-শার্ট হয়েছে। ওসমান আলী ঘরের দরজা বন্ধ করে দাঁড়ালে মনে হয়, ঘরের কাচের দেয়ালে ফুটে আছে ওর ফেলে আসা জীবনের সবটুকু। দেয়ালে ভিডিও চলছে। শোনা যাচ্ছে বাবার কণ্ঠস্বর, বাবা রে তোর জন্য কিছু করতে পারলাম না। তুই আমারে মাফ করে দিস। ও তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। ভ্যানচালক বাবার সাধ্যই বা কী। মানুষের সীমিত সাধ্যকেও স্যালুট করা উচিত। তাতে মানুষকে হেয় করা হয় না। মানুষকে হেয় না করতে শেখা উচিত সবার। ওসমান দেখতে পায় মাকে। কোমর বাঁকা করে ইটের ঝুড়ি টানছে। পোঁটলায় করে নিয়ে আসা রুটি-গুড় বের করে দিয়ে ওকে বলছে, বাবা এইটুকু খা। সইন্ধ্যাবেলা ভাত রাধুম। ও ভুলে যেত, দুপুরে একবার খাবার সময় হয়। সে কথা ভুলে থাকার জন্য মা ওকে কাছে টেনে আদর করে, আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়।

 

ও সেদিকে তাকিয়ে বলে, মাগো আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাব। স্যার-ম্যাডামরা বলেন, আমার খাতায় লাল দাগ দেওয়া যায় না। মাগো তোমার ইচ্ছা আমি পূরণ করব, তুমি তা দেখে গেলে না। তোমাকে আমি খুঁজব না। আমি জানি তুমি কোথায় আছ। সেখানে আমি গিয়ে বলব, দেখো তোমার ওসমু এসেছে। তোমার হাত আমার মাথার ওপর রাখো মাগো।

 

খুশির হাসিতে ও নিজেকে গুটিয়ে নিলে কাচের দেয়াল সরে যায়। ছোট ঘরে অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে। পড়ার টেবিলে বসলে দরজায় টুকটুক শব্দ হয়। ও উঠতে চায় না। কে এলো এই সময়? যখন-তখন কেউ না কেউ আসবে এটা ওর পছন্দ না। ওর একাকিত্বই তো সবার সঙ্গে ওর সঙ্গ। এই সঙ্গের উপভোগ ভাগাভাগি করা যায় না। এর আনন্দ সামনাসামনি আড্ডা দেয়ার চেয়ে কম নয়। একাকিত্বের উপভোগ মধ্যরাতে হয়, সূর্য ওঠার আগে হয়, পথে হেঁটে যেতে হয় কিংবা বাসের জানালা দিয়ে দিগন্ত দেখার সময় হয়, বইপড়ার সময়ও হয়, এমন কি ক্লাসে বসে থাকলেও আনমনা চিন্তা ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যায়। ভাবে, এ এক গভীর আনন্দ। সামনাসামনি বসে বসে গ্যাঁজাতে হবে-এটা কোনোভাবে নিছক বন্ধুত্ব না। ওই গ্যাঁজানোতে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হয় একেকজনের। এসব ও পছন্দ করে না। ও জানে কেউ কেউ বলে, ভ্যানচালকের পোলা তো, এই জন্য সবার সঙ্গে মিশতে পারে না। মেশার জন্য সোশ্যাল স্ট্যাটাস লাগে।

 

 

এসব কথা ও গায়ে মাখে না। ও জানে, যে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারে, তার পেছনেই সার বেঁধে দাঁড়াবে সোশ্যাল স্ট্যাটাসের মানুষ। যেমন জেলের ছেলে আবদুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তাঁর জ্ঞান দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে জয় করেছিলেন সোশ্যাল স্ট্যাটাস। আর এখন এই সময়ে চা-বিক্রেতা বালক ভারতের প্রধানমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্ষমতার রাস্তা। দুই পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোশ্যাল স্ট্যাটাসের লোকেরা। হ্যাঁ, সোশ্যাল স্ট্যাটাস।
তখন দরজার শব্দ জোরে বাজে। ও বুঝতে পারে এটা বদরুলের ডাক। ও সব সময় বন্ধুত্বের অধিকার খাটায়। তখন ভেসে আসে বদরুলের কণ্ঠ-ওই নেংটি ইঁদুর দরজা খোল। কী করছিস? বিদ্যার ধানের গোলা কাটছিস? দরজা খোল নেংটি ইঁদুর।
ওসমান আলি দরজা খোলে। বদরুলকে ওর পছন্দ, খোলামেলা, প্রাণখোলা। দরজা খুলেই বলে, চেঁচাচ্ছিস কেন?
চেঁচাবোইতো। না চেঁচালে তোর ধ্যান ভাঙে না। দরজায় তালা নেই, তার মানে তুই ঘরে আছিস। তাহলে দরজা খুলতে এত দেরি হবে কেন?
কৈফিয়ত চাইছিস?
চাইতেই পারি। বন্ধুত্বের ভালোবাসা আছে না? আমি কি তোর কাছে বাইরের লোক? অ্যাঁ, কি বলিস? তোর জন্য ডালপুরি এনেছি।
আয়, ভেতরে আয় তুই আমার ঘরের লোক।
সে জন্যই তো তোর নোট পড়ে পরীক্ষায় পাস করি।
বদরুল বিছানার ওপর পা গুটিয়ে বসে ঠোঙা থেকে ডালপুরি বের করে ওসমানকে দেয়। ওসমান ওর মুখোমুখি চেয়ারে বসে। ডালপুরি খায়, পাঁচটা ডালপুরির তিনটাই ও সাবাড় করে। খেতে খেতে বদরুল বলে, সামনের ক্রিসমাসের ছুটিতে সাজেক ভ্যালিতে যাব। তুই বলেছিলি। ভাবলাম, আমারও ওই দিকে যাওয়া হয়নি। এবার যাব। কী বলিস?
ঠিক আছে যাব। শাওনের বাবা বলেছে, এই ছুটিতে ওরা সিঙ্গাপুরে বেড়াতে যাবে। আমি প্রায় পনেরো দিনের ছুটি পাব। এবারই যাওয়ার সময়।
গুড। তাহলে ব্যবস্থা নেই। কীভাবে যাব, এই খোঁজখবর আমি করব। তোর টিকিটের টাকা আমি দেব।
কেন, তুই দিবি ক্যান? আমি দেব আমারটা।
তুই আমার লেখাপড়ায় হেল্প করিস। কিছু না বুঝলে বুঝিয়ে দিস। তুই আমাকে নোট দিস। সেই নোট পড়ে আমি পরীক্ষায় পাশ করি। এইটুকু খাতির তো আমি তোকে করবই। বাপের ভাড়ার থেকে পড়ালেখার খরচ পাই। আমার চিন্তা কী।
বদরুলের এই কথায় আনমনা হয়ে যায় ওসমান। কেউ যদি কারো বাবার কথা বলে, তখন উদাস হয়ে যায় ও। বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা তৈরি হওয়ার আগেই বাবা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। বাবার গল্প ঠিকমতো জমেনি ওর জীবনে।
কী রে, চুপ মেরে গেলি যে?
সাজেক ভ্যালি তো অনেক দূর। যাব কি না ভাবছি।
ভাবাভাবির কিছু নেই। যেতে হবে। আমি বাসের টিকিট কাটতে গেলাম। তুই কি ঘরে থাকবি?
হ্যাঁ। ও নির্বিকার জবাব দেয়।
থাক। তোর সঙ্গী-সাথি তো বই। তোর একটা ল্যাপটপ থাকলে আরো মজা হতো।
ইন্টারনেট? না বাপু, অত মজার মধ্যে আমি নেই। যা, ভাগ।
বেরিয়ে যায় বদরুল। ওসমান ভাবে, জলফুর জীবনে বই ছিল না, ল্যাপটপও না। জীবনের শূন্য জায়গাটা আর পূরণই হলো না। ছোটবেলায় একবার একটি রাস্তার কুকুরকে ও পথের ধারে কাতরাতে দেখেছিল। কুকুরটির জন্য এক টুকরো মাংস খুঁজতে বাজারে গিয়েছিল। পায়নি। বাড়ি বাড়ি গিয়েছিল। পায়নি। ফিরে এসে দেখেছিল, কুকুরটি মরে গেছে। তখনো মনে হয়েছিল, একটি প্রাণীর জীবনের শূন্য জায়গা পূরণ করা হলো না। ও টেবিলের ওপর রাখা একটি বই বের করে। পাঠ্যবই না। সাধারণ জ্ঞানের বই। বিশ্বের বড় মানুষের জীবনী আছে সেখানে। যেখানে একটি বাণী এমন : ‘রিয়াল লিভিং ইজ লিভিং ফর আদারস।’ জলফুর মৃত্যু যখন ওর সামনে আসে, তখন মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন। কিছুই তো করা হলো না এই জীবনে। না মানুষের জন্য, না প্রাণীকুলের জন্য। বেঁচে থাকার পরিসর তো কম হয়নি। আর কবে ও রিয়াল লিভিংয়ের মর্ম বুঝবে?
ওসমান পড়ার টেবিলের সামনের খোলা জানালা দিয়ে তাকালে নিজেকে এক ধূসর পৃথিবীর বাসিন্দা ভাবে। তরুণ জীবনের এই পর্যায়ে বড় অর্জনের কোনো চিহ্ন নেই। আর কত দিনে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন বলতে পারবে কিছু তো করতে পেরেছি-আমার এতটুকু সাধ্যই ছিল।

 

ওসমান আর বদরুল এখন সাজেক ভ্যালির রাস্তায়। গতকাল খাগড়াছড়িতে এসেছে। রাতে একটি হোটেলে ছিল। পরদিন চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে বদরুল। ও এমনই ছেলে। যখন যা মাথায় ঢোকে তখন তা করেই ছাড়ে। অনেকে নিষেধ করেছিল যেতে। বলেছিল, দুর্গম এলাকা। পাহাড়ি-বাঙালি মারামারি লাগলে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবে না। বদরুল হাসতে হাসতে বলেছিল, পাহাড়ের একটি ঝরনার ধারে মারা পড়লে মন্দ হবে না। ঝরনার স্বচ্ছ পানিতে আমার শেষ গোসল হয়ে যাবে।
মাজেদ খোঁচা দিয়ে বলেছিল, গোসল হবে, কিন্তু কবর হবে না। কয় দিন পড়ে থেকে কাদায় মিশে যাবি। নইলে বন্য প্রাণী খাবে তোকে?
আমাকে খেয়ে প্রাণীকুলের পেট ভরলে মন্দ কী? ভাবতে পারব যে কারো খিদে মিটিয়েছি।
বানর একটা।
মাজেদ ক্রুদ্ধ স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল।
হা-হা হো-হো করে হেসেছিল আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা। হেসেছিল ওসমান আলী নিজেও। বলেছিল, ফিরতে যদি না পারি তাহলে অন্যের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া হবে। আমরা যারা ফার্স্ট ক্লাসের লাইনে আছি, সেখানে আর একজন ঢুকতে পারবে।
ওরা বলেছিল, দুটোরই মাথা গরম হয়ে গেছে। ওদের সঙ্গে কথা বলা বৃথা। চল, সরে পড়ি। রমনা পার্কে গিয়ে ঝালমুড়ি খেয়ে আসি।
ওরা চলে গেলে দুজনেরই মনে হয়েছিল, ওরা অ্যাডভেঞ্চার বোঝে না।
এখন এই পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য অভিভূত করে দুজনকে। বাঘাইহাট আর্মি চেকপোস্ট পার হতে হলো। প্রথমে তারা যেতে দিতে চায়নি। বলেছিল, এই দুর্গম এলাকায় হারিয়ে গেলে আমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হবে।
বদরুলের একটাই উত্তর আমাদের খুঁজবেন না। ফিরতে না পারলে বুঝবেন, গভীর অরণ্যের কোথাও ঢুকে ছিলাম। বুনো হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়েছি। আমাদের জীবনের দায় আমরা অন্যের ওপর চাপাব না।
ব্রেভো। ওরা হাসতে হাসতে বদরুলের পিঠ চাপড়ে আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল। ওসমান বলেছিল, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ভালোয় ভালোয় যেন ফিরে আসতে পারি।
বদরুল ক্রেডিট নেয়ার ভাঙ্গিতে বলে, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ওর নাম ওসমান আলী। খুব মেধাবী ছেলে। ফার্স্ট ক্লাস পাবে। বিভাগের টিচার হবে। ও আমাদের গর্ব।
একজন হাসতে হাসতে বলে, আপনি আমাদেরও গর্ব। একজন শিক্ষকতো ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক। শিক্ষার অভিভাবক।
দু’জনে চমকিত হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল দু’জনের চোখের দুষ্টি তার হাতে রাইফেলের ওপর স্থির হয়ে গিয়েছিল।
দাঁড়িয়ে থাকা চারজন সেনা ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলেছিল, কংগ্রাচুলেশনস।
ও নিঃসঙ্গতার ভারী কণ্ঠে বলেছিল, আপনাদের অভিনন্দন নিচ্ছি। তবে এখনো পথ বাকি আছে। যেতে হবে শেষ মাথায়। আমি জানি না কতটা যেতে পারব।
পারবেন, পারবেন। পুরো পথই যেতে পারবেন।
ওদের রাইফেলের নল আকাশের দিকে উঠে গিয়েছিল।
আচ্ছা আসি।
ওসমানের বিষণ্ন কণ্ঠস্বর পাহাড়-বেষ্টিত এলাকায় গুমগুম করে। হয়তো কোথাও গিয়ে আছড়ে পড়ে কিংবা ঝরনার জলে ভেসে যায়। যে জ্বলে ব্যাঙ আছে, পোকা আছে, পতনের শব্দ আছে।
বিভিন্ন চেকপোস্ট পার হয়ে চাঁদের গাড়ি চলতে শুরু করে। কখনো ওপরের দিকে ওঠে, কখনো নিচের দিকে যায়। বদরুল বলে, ছোটবেলায় মুখস্থ করেছিলাম যাওয়া-আসার পথের ধারে। এখানে বলতে হবে ওঠানামার পথের ধারে। ওর হাসির সঙ্গে নিজের হাসি মেলাতে পারে না ওসমান। অপলক তাকিয়ে থাকে। এত অপরূপ প্রকৃতি এ দেশেরই সম্পদ, এখানে না এলে জানা হতো না। অনেক দূরে দূরে দু-একটা বাড়ি দেখা যায়। বাড়ি ঠিক নয়, কুঁড়েঘরের মতো বসবাস উপযোগী। পরিচ্ছন্ন। সুন্দর। তবে লোক চলাচল কম। ওরা জানে, সাজেক ভ্যালিতে লুসাইরা থাকে। বড় দা নিয়ে জঙ্গলে মরা ডাল কাটতে দেখা যাচ্ছে দু-চারজনকে। গাড়ি যখন পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠে, তখন মনে হয় হাত বাড়ালেই আকাশ ছোঁয়া যাবে। ওরা এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদের গাড়ির ছাদে উঠে বসে। গাড়ির ভেতরে বসে যে দৃশ্যটি দেখা যাচ্ছিল ছোট আয়তনে, ছাদে ওঠার ফলে তার আয়তন বিশাল হয়ে যায়। দুজনের চোখের পাতা পড়ে না যেন। কাছের-দূরের ছোট-বড় সব পাহাড়ের মাথায় তুলো মতো মেঘ জমে আছে। ছোটবেলায় শুনেছিল তুলোর মতো মেঘ, বিশেষ করে শরতকালে ভেসে যায় আকাশে, সেইসব মেঘ এখন ওদের চারদিকে। মনে হয় হাত বাড়ালে ছোঁয়া যাবে, মাথার ওপর বসে ভিজিয়ে দেবে চুল। বদরুল গলা ছেড়ে গান গাইছে। ওসমান ওর গানে কান দেয় না, ভাবে এখানে চোখের দাবি বেশি। এই দৃশ্য না দেখে মরে যেতে হলে জীবনের আফসোস ঝুলে থাকতো বাড়ির কাছে তেঁতুল গাছে। ভাবতেই দমফাটা হাসিতে নিজেকে ভরিয়ে তোলে ওসমান। হারানো শৈশবের জন্য ওর আর দুঃখ থাকে না।

 

বদরুল ঘাড় ঘুরয়ে বলে, হাসছিস যে?
পথের ধারের বাচ্চাদের দেখে নিজের কথা মনে হলো। ভাবলাম, ওদের মধ্যে আমি আছি। ওদের দেখে নিজের শৈশব খোঁজা আমার আজ থেকে শেষ হলো।
ঠিক বলেছিস। আমারও মনে হয়েছে ওদের মধ্যে আমি আছি। ভাবতে ভালো লাগছে যে দূর থেকে গাড়ির শব্দ শুনে ওরা ছুটে আসে রাস্তার পাশে, তারপর হাসিমুখে হাত নাড়ে। দারুণ দৃশ্য।
ওসমান অভিভূত কন্ঠে বলে, এখানে না এলে আমি আমার শৈশব হারানোর দুঃখ ভুলতে পারতাম না। হায়, প্রিয় সাজেক। হায় আমার মাতৃভূমি।
ওসমানের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়ায়। ওর পানিভরা দৃষ্টি ছুঁয়ে থাকে পাহাড়ের মাথা। যেন শিশুদের মাথা ওই পাহাড়সমান উঁচু। ওপর থেকে নিচ থেকে ওরা বলছে, বেড়াতে এসেছ আমাদের কাছে। তোমাদের স্বাগতম। ওসমান বলে, স্বাগতম ছোটরা, তোমরাই আমি। তোমারে কাছের কেউ। ভালোবাসা নাও, মেঘভরা ভালোবাসা।  
চাঁদের গাড়ি যেখানে এসে থামে, সে জায়গার নাম রুইলুইপাড়া। খাগড়াছড়ি ছাড়ার পরে ওরা পেরিয়ে এসেছে দীঘিনালা, বাঘাইহাট, মাসালাং বাজার। প্রায় দুই হাজার ফুট পাহাড়ে উঁচুতে রুইলুইপাড়া। দূরে দূরে আদিবাসীদের বসতি। ছবির মতো উপত্যকা। এখানে দাঁড়িয়ে মেঘের দিকে তাকলে মনে হয় ওগুলো মেঘ নয়, নদী কিংবা সরোবর- ঝিল কিংবা জলাভূমি। ও ঢাকা থেকেই জেনে এসেছে যে বেশি উঁচু পাড়াগুলো রাঙামাটির সাজেক ইউনিয়নের নয়, মিজোরামের সঙ্গে যে সীমান্ত টানা আছে সেই মিজোরামে। উপর থেকে তাকালে সীমান্ত দেখা যায়, দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের বেঁচে থাকার অবিস্মরণীয় জীবন-সত্য। বলতে চাই পৃথিবীজুড়ে সীমান্ত নেই। মানুষই এক, মানুষই সীমান্ত, মানুষই দেশ। আবার হা-হা করে হাসি। ভাবি, এমন অবাস্তব চিন্তাই বা কেন করবে। দূরের পাহাড়ে, সীমান্তের ওপারের পাহাড়ের ঘরবাড়ি, ঝরনা, গির্জা দেখা যাচ্ছে। ছোট আকারের মানুষের চলাফেরা দেখতে পাচ্ছি। জানি ওখানে গান আছে, নিজের ভাষার গান। নিজেদের সঙ্গীত। মানুষের এই বৈচিত্র্য নিয়েইতো এক হতে হবে। বলতে হবে, উৎসব যার যার, মিলন সবার। উৎসবের মিলন মানুষের প্রাণের টান। (চলবে)


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ নভেম্বর ২০১৫/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়