ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

স্টারলিং হাইটস-এর কিলবোর্ন ড্রাইভ

শাকুর মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১২, ৭ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্টারলিং হাইটস-এর কিলবোর্ন ড্রাইভ

স্টারলিং হাইটস

শাকুর মজিদ

(মিরিকিনে : দ্বিতীয় কিস্তি)

ডেট্রয়েটের স্টারলিং হাইটস গ্রামটা চমৎকার। এই গ্রামের কিলবোর্ন ড্রাইভ নামে যে ছোট গলিটা আছে তার দু’পাশে কতগুলো একতালা চার চালা বাড়ি। বাড়িগুলোর দেয়াল নাই, নাই কোনো সীমানা প্রাচীর। এমনকি কখনো কখনো ঝোপঝাড় দিয়ে যেভাবে আলাদা করা হয়, সে রকম কিছুও না। প্রতিটি বাড়ি প্রায় একই রকমের ডিজাইন। বাইরে থেকে একই হলেও ভেতরে সবার আলাদা কিনা বোঝা যায় না।

এই গ্রামের একটি বাড়িতে এসে উঠেছি আমরা। আমার ছোট বোন নুরুরা থাকে এখানে। ২০০১ সালে যখন এসেছিলাম তখন ছিলাম হ্যাম্পট্রামক নামক একটা লোকালয়ে। সে এলাকাটিতে প্রচুর বাংলাদেশী ছিলেন। ১৪ বছরের ব্যবধানে আমেরিকার পরিবর্তনের মতো তাদেরও পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে দুই দফা ঘর বদল করেছে তারা। বছর খানেক আগে এসেছে এই গ্রামে।

সকাল বেলা ঘুম ভেঙে যায় অনক ভোরে। জেট লেগ কেটে যাবার কথা নয় আমার। সকাল ৭টায় ঘুম ভেঙে যাবার পর মনে হলো, এখন তো ঢাকায় বিকেল ৫টা! এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমাই কী করে! সকাল বেলা আমি একা দরোজা খুলে বাইরে আসি। কোথাও কোনো কোলাহল নেই। এমনকি পাখির কোনো ডাকও কানে আসে না। অক্টোবরের প্রথম দিনে ভোর বেলা বেশ শীত। ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস। শীতের তীব্রতা মিশিগানে কাবু করে ডিসেম্বর থেকে। এখন তার আগমনী শুরু হয়ে গেছে। মাঝ দুপুরে অবশ্য ঝকঝকে রোদে তেমন শীত শীত বোধ হয় না। কিন্তু সকালটা বেশ গুমোট।

আমি বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি, এক মা তার সন্তান নিয়ে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। সেকেন্ড কয়েক দাঁড়ানোর পর দেখা গেলো একটা স্কুলবাস এসে বাচ্চাটাকে বাসে উঠিয়ে নিয়ে গেলো, মা তার ঘরে ফিরে গেলেন। একটু দূরের আরেক বাড়ি থেকে এক চৈনিক তরুণী বেরিয়েছে। তার কাঁধে ঝোলানো হ্যাভার সেক। মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তার কাছে আসার আগেই একটা জীপ এসে তাকে তুলে নিল। কোথাও কেনো কথাবার্তা, গাড়ির হর্ন, কোনো কিছু নাই।


এসব বাড়ি আমার অনেক দেখা হয়েছে। মাঝখানে একটা সরু রাস্তা, দু’টো গাড়ি যাওয়া-আসা করতে পারে এমন; তারপর ঘেষো পথ। সেটুকু পেরিয়ে দু’পাশে পায়ে হাঁটা পথ। তারপর একটা ছোট্ট লন এবং এরপর একটা চারচালা ঘর। একটি বাড়ি থেকে আরেকটির দূরত্ব প্রায় দেড়শ ফুটের মতো হবে। বাড়িগুলো পাশাপাশি, কারো কোনো সীমানা প্রাচীর নাই। বাড়ির সামনে যেমন খোলা উঠান, পেছনেও একটা নিজস্ব আঙিনা। এই আঙিনাগুলো একেকটা ছোট্ট খামার।

নুরুর ব্যাক-ইয়ার্ডটা বাং-মেরিকান। এখানে তাবু টাঙিয়ে সোফা বিছিয়ে বসার জায়গার পরেও আছে একটা সবজি ও ফলের বাগান। আপেলের গাছ আছে দু’টো, সেখানে ঠশ ঠশে আপেল ধরে আছে, পাড়া হচ্ছে না। ভাইয়া এলে নিজ হাতে পাড়বেন। আছে রোজ-ভেরি ফলের গাছ। গোলাপী রঙের লিচুর মতো একটা ফল হয় এখানে। এরপর আছে বাংলাদেশী কদু ও সীমের বাগান। এই বাগানের প্রতি নুরুর যত্ন অনেক বেশী। কারণ, ২০১২ সালে দেশ থেকে আসার সময় সে আমাদের গ্রামের বাড়ির কদু ও সীমের যে বীজ নয়ে এসেছিল, ঠিক সেই বীজ থেকেই ফলিয়েছে এই সবজি। কিন্তু দুঃখ একটাই যে, স্বাদটা একেবারে খাঁটি সিলেটী নয়। একটু অন্য রকম। আমেরিকায় এসে কদু আর সীমের আকারটা বড় হয়ে গেছে। এটা সম্ভবত এই মাটির জন্য। বললো- বীজের সঙ্গে যদি মাটিটাও নিয়ে আসা যেতো!

আমরা ভাইবোন মিলে বাগান দেখি। ঘরের পাশের দিকে লাগিয়েছে নাগা মরিচের গাছ। এটারও একই অবস্থা! দেশের মরিচের চেয়ে ঝাঁজ এখানেও বেশী। এর পাশে কয়েকটা টমেটো গাছ। এই টমেটো বাগান নিয়ে তার অনেক দুঃশ্চিন্তা। বাগানের গাছগুলো প্রথমে ছিলো তার সীমানার মধ্যে। ওগুলো বেড়ে গেছে এবং তার প্রায় অর্ধেক অংশ প্রতিবেশীর সীমানায় ঝুলে আছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা হয়েছে এ নিয়ে। তাদেরকে সে বলেছে- তোমাদের আপত্তি হলে আমি গাছ কেটে ফেলবো।
প্রতিবেশী বলেছে, আপত্তি নাই।
নুরু বলেছে, তাহলে তোমাদের অংশে ঝুলে থাকা সমস্ত টমেটো তোমাদের।
প্রতিবেশী বলেছে, তোমার কথা রাখবো। আমরা তোমার বাগান থেকে একটা টমেটো নেবো। বাকীগুলো সব তোমার।


প্রতিবেশীর গল্প শুনে মজা পেলাম। নুরু বলে- তোমার আসার কথা তাদের বলেছি। ওরা বলেছে, তোমাকে দেখতে আসবে।
আমি বলি, ওরা কোন দেশের?
নুরু বলে, আমেরিকান, বাট কিউবান অরিজিন।

কিউবান নেইবার
দুপুর বেলা আমি ঘরের ফ্লোরের মধ্যে বসে ল্যাপটপে ছবি বাছাই করছি, এমন সময় নুরু এসে বলে- ভাইয়া, আমার নেইবার আইছে, তুমার লগে দেখা করতো।
আমি অবাক! বলি- নিয়ে আয়।
নুরু এসেছে, ওর হাতে একটা বোতল। আমার দিকে তাকায় আর হাসতে হাসতে বলে- দেখো, এ তখটা লইয়া আইছে।
তাকিয়ে দেখি ওয়াইনের বোতল!
খালি হাতে পড়শির বাড়ি কী করে আসে! এর জন্যই কি এই আয়োজন।

এই ঘরে দুইটা বৈঠকখানা। মূল বৈঠকখানার পেছনে অন্দর মহলের ব্রেকফাস্ট কর্নারের সঙ্গে লাগোয়া অপর ঘরের ছোট্ট পারিবারিক আড্ডাখানার যে জায়গাটিতে আমি কাঠের ফ্লোরের ওপর বসে ছিলাম, তার পাশের দু’টো সোফায় এসে তারা বসেন। এদের মধ্যে যিনি স্বামী তার নাম রুয়ান আর স্ত্রীর নাম লিলিয়া। রুয়ানের বয়স ৮৪, লিলিয়ার ৭২। ৫৫ বছর ধরে তারা আমেরিকায় আছেন। রুয়ানের কেউ এখন আর কিউবায় থাকেন না। লিলিয়ার আছে। তাদের দুই পুত্র। বড়টির বয়স ৫২, ছোটটি ৪২। তারা দু’জনই আমেরিকার মিশিগানে দু’টো আলাদা বাড়ি নিয়ে থাকেন। বুড়োবুড়ি পেনশনে আছেন। তারা একা থাকেন এই বাড়িতে। আর কোনো তৃতীয় সঙ্গী, এমনকি কোনো কুকুরও তাদের সঙ্গে থাকেন না।


রুয়ান বলেন, সন্তানদের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে দেখা হয়, আমরা একসঙ্গে খাই। বাড়িতে কেউ তেমন আসে না। তবে যোগাযোগ আছে। একসময় এই দম্পতি একটা অফিসে কাজ করতেন। এখন আর কেউ কিছু করেন না।
আমরা সবাই মিলে তাদের সঙ্গে গল্প করতে বসে পড়ি। গল্প করার মতো তেমন কিছু পাই না।
আমি বলি, তোমাদের কিউবা সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। শুধু ফিদেল কাস্ট্রের নাম জানি। ম্যারাডোনাকে তিনি খুব পছন্দ করতেন, এটাও জানি, এর বেশি কিছু না।
রুয়ান বলেন, ফিদেল একটা খারাপ শাসক। কেউ তাকে পছন্দ করে না। সবাই দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে আসছে শুধু কাস্ট্রর অত্যাচারে!

বলি- কিসের অত্যাচার?
রুয়ান বলেন, কিউবায় জিনিসপত্র আকাড়া। পয়সা থাকলেও জিনিস কেনা যায় না। প্রতি সপ্তাহে কী পরিমাণ কী জিনিস কেনা হবে তার একটা ফর্দ যদি আগে থেকে পাস বুকে লেখা থাকে দোকানে গিয়ে কেবল সে সব জিনিসই কেনা যাবে। ট্যুরিস্টরা অবশ্য টাকা দিয়ে যা ইচ্ছা কিনতে পারে, কিন্তু কিউবার কেউ পারবে না। পাস বুকে যে পরিমাণ জিনিসের কথা লেখা থাকবে, শুধু সেই পরিমাণই পারবে। আমেরিকা এতো কাছের একটা দেশ, অথচ রাজনৈতিক কারণে দেশটাকে দরিদ্র করে রেখেছে, মানুষের মধ্যে আনন্দ নাই। দারিদ্র্য বেশি। এ কারণে অপরাধ বাড়ছে।


আমি বলি, বাংলাদেশ সম্পর্কে কী ধারণা তোমার?
রুয়ান বলেন, বাংলাদেশও অনেক দরিদ্র, কিন্তু এ দেশের মানুষগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ অনেক বেশি। আমরা যেমন কিউবা ছেড়ে এসে আর কিউবার কথা মনে রাখি না, তোমাদের দেশের মানুষের মধ্যে এখনো সেটা হয়নি। তোমাদের এই বাড়িতে এসেও দেখি- পারলে পুরো বাংলাদেশকে তোমরা এখানে এনে রেখে দিতে।

রুয়ানকে নিয়ে আমরা সবাই ঘরের পেছন দিকের বাগান দেখাই। বাংলাদেশী মরিচ, লাউ, সীম-এর বীজ থেকে আমেরিকার মাটিতে গজিয়ে ওঠা সবজি দেখাই, তাদের বাংলা নাম শেখাই। রুয়ান একটা কাগজ বের করে ইংরেজিতে লিখে KODU/water pumpkin, MORICH/green chilli, LOGI URI/ Green Beans,  আমেরিকান রোজ-ভেরী আর আপেলের সঙ্গে বাংলাদেশী লাউ মরিচের বাগানে আমরা অনেকক্ষণ সময় এক সাথে আড্ডা মারি।
এক পর্যায়ে নুরু নিয়ে এক কোণায়। ঘরের ভিটার সঙ্গে লাগানো মরিচ বাগানের কাছে যায়। রুয়ানকে বলে, হ্যাভ এ লুক।
রুয়ান তাকায় মরিচ গাছের দিকে। কিছু বলে না।
নুরু বলে- সি, দিস ইজ রেড অ্যান্ড গ্রিন।
এবার মুচকি হাসেন রুয়ান। বলেন, দিস ইজ ইয়োর ফ্লাগ কালার, আই থিঙ্ক।
নুরু এবার খুশী। বলে, থ্যাঙ্ক ইউ ।
আমেরিকার মিশিগান অঙ্গরাজ্যের স্টার্লিং হাইটসের কিলবর্ন পাড়ার এক বাড়ির বাগিচার মরিচ বাগানেও লাল-সবুজের জয়জয়কার।



১ অক্টোবর ২০১৫। স্টারলিং হাইটস, মিশিগান।

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ অক্টোবর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়