ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অরক্ষিত নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প

সুজাউদ্দিন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অরক্ষিত নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প

উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প

সুজাউদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার : উখিয়ার কুতুপালং এলাকার নিবন্ধিত ও অনিবন্ধনকৃত শরণার্থী ক্যাম্প একেবারেই লাগোয়া। সংশ্লিষ্টরা ছাড়া সহজে কারো বুঝার উপায় নেই দুটোর মধ্যকার পার্থক্য। নিবন্ধিত ক্যাম্পে প্রবেশ পথে পুলিশ ও আনসার ক্যাম্প থাকলেও মূলত দুটি ক্যাম্পই অরক্ষিত।

 

অনিবন্ধিত ক্যাম্পে দেখভালের কেউ নেই। সেখান দিয়ে অনায়াসেই ঢোকা যায় নিবন্ধিত ক্যাম্পে। আবার নিবন্ধিত ক্যাম্পে একাধিক বিদেশি এনজিওর খবরদারী থাকলেও অনিবন্ধিত ক্যাম্পে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।

 

প্রভাবশালীদের দখলে থাকা বনবিভাগের জমিতে করা হয়েছে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প। অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেখানে তাদের ঝুঁপড়ি (মাটি, বাঁশ ও পলিথিনে তৈরি ঘর) বানানোর মৌখিক অনুমতি দিয়ে প্রভাবশালীরা আদায় করছে মাসিক ভাড়া।

 

চলতি মাসে নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে অনুপ্রবেশ। এজন্য ঝুঁপড়ির মাসিক ভাড়া কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়তি ভাড়া না দিলে উচ্ছেদ করা হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ঝুঁপড়ির বাসিন্দাদের। দুই ধরনের ক্যাম্প একসঙ্গে লাগোয়া হওয়ায় সেখানে এক ধরনের জগাখিচুড়ি অবস্থা বিরাজ করছে।

 

একাধিক এনজিওর অর্থায়নে সেখানে ঘরে ঘরে সোলার প্যানেল বসিয়ে সৌর বিদ্যুতের আলোর ব্যবস্থা যেমন করা হয়েছে তেমনিভাবে রয়েছে পানীয় জলের সুন্দর ব্যবস্থা। তবে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানে নেই কোন উদ্যোগ। সেখানকার বাসিন্দারা দিনমজুরি, রিক্সাচালানোর পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তি করছেন। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত একাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

 

একাধিক সূত্র মতে, বিজিবি, কোষ্টগার্ড ও পুলিশের নজরদারীর মধ্যেও উখিয়ার ঘুমধুম, থাইংখালী, রহমতের বিল, পালংখালী আঞ্জুমান পাড়া ও  সদরের পূর্বদিকে আমতলী পয়েন্ট দিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আসছে রোহিঙ্গা। এরপর তারা অনেকটা নির্বিঘেœ আশ্রয় নিচ্ছে অনিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পে। স্বজনদের মাধ্যমে নিবন্ধিত ক্যাম্পেও ঠাঁই হচ্ছে অনেকের। নির্দিষ্ট সীমান্ত চৌকি ও রাস্তায় তল্লাশি থাকলেও গোপনে ক্যাম্পে ঢুকে পড়াদের দেখভালের জন্য কেউ নেই।

 

শরণার্থী ক্যাম্পের একাধিক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, সেখানে সর্দারদের মাঝি বলা হতো। তাদের আবার চীফ ছিল। এখন মাঝি প্রথা উঠে গেছে। ২০০৬ সাল থেকে ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট কমিটি (সিএমসি) ও ব্লক ম্যানেজমেন্ট চেয়ারম্যান (বিএমসি) করা হয়েছে। এক বছর মেয়াদী এই কমিটি নির্বাচন করা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে দলাদলি। কুতুপালংয়ের নিবন্ধিত ক্যাম্পে ইমরান নামে একজন চেয়ারম্যান থাকলেও গতমাসে তাকে সরিয়ে মসজিদের ইমাম মৌলভী আলী আহম্মদকে তত্ত্বাবধায়কের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শরণার্থী ক্যাম্পে লেজেগোবরে অবস্থা। সেখানে নেই কোনো ধরনের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সমস্যা নিয়ে প্রকল্প হাতে নিলেও জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রয়েছে নিরব। এমন কোনো  পরিবার নেই যে পরিবারে ৪-৫ জনের কম সন্তান নেই। অন্যদিকে মায়ানমার থেকে আসলেও প্রতিনিয়ত সেখানে থাকা স্বজনদের সঙ্গে ওয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমু ও ম্যাসেঞ্জারে তারা যোগাযোগ রাখছে। ফেসবুকেও আছে যোগাযোগ। এপারে বসে তারা ওপারের রেডিও ষ্টেশন ও বিবিসির খবর শুনছে। আর সীমান্তবর্তী হওয়ায় এদেশের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ওপারেও কাজ করছে সমানতালে।

 

অভিযোগ মিলেছে, অনিবন্ধিত ক্যাম্পের ৭টি ব্লকের দ্বায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যান শুক্কুর ও অধিনায়ক আমির হাকিম স্থানীয় প্রভাবশালী ও বিভিন্ন এনজিও’র হয়ে কাজ করেন। তারা রোহিঙ্গাদের বিচার সালিশ করার পাশাপাশি নানাভাবে সুবিধা পান বিভিন্ন মহল থেকে।

 

সূত্র আরো জানায়, স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বাররা রোহিঙ্গাদের মধ্যকার বিচার সালিশ করেন। পাশাপাশি তারা ক্যাম্পে দোকান বসিয়ে লোক দিয়ে ভাড়া আদায় করে আসছেন। নিবন্ধিত ক্যাম্পে ইজাতুল কোরআনিল কারিম মাদ্রাসায় ১৫০ ছাত্র অধ্যয়নরত। তারা মাসে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে বেতন দিয়ে থাকে।

 

ক্যাম্পের আবুজার মসজিদের ইমাম মো. হারেছ জানান, সেখানে সবাই কষ্টে আছে। তবুও সবার মধ্যে সহমর্মিতা রয়েছে। একজনের বিপদে আরেকজন পাশে দাঁড়াচ্ছে।

 

নিবন্ধিত ক্যাম্পে থাকা শাহিদার স্বামী আব্দুল গাফফার নদী পথে মালয়েশিয়া চলে গেছেন ৬ বছর আগে। সেখানে ভাল আছেন জানিয়ে শাহিদা বলেন, রোহিঙ্গারা প্রতিনিয়ত আসার চেষ্টা করছে। এখন একটু কমে গেছে। সুযোগ পেলেই তারা নৌকায় উঠে নদী পাড়ি দিচ্ছে।

 

এক সপ্তাহ আগে মায়ানমারের ঢেকুবলিয়া থেকে আসা জমির হোসেন জানান, তারা ৪ জন এসেছেন । ফুপাতো ও মামাতো ভাই আবু সৈয়দ ও নুরুল আমীন কয়েক বছর ধরে শরণার্থী ক্যাম্পে আছে। তারা উঠেছেন তাদের ঝুঁপড়িতে।

 

জমির বললেন, নতুন যারা আসে তারা পুরানোদের কাছ থেকে ঘর কিনে নেয়। এজন্য ১০-১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু এখন টাকা দিয়েও ঘর মিলছে না। প্রভাবশালীরা এককালীন টাকা নিয়ে মৌখিকভাবে ঘর নির্মাণের অনুমতি দিয়ে থাকে। তবে বসতি বেড়ে যাওয়ায় এখন টাকা দিয়েও জমি মিলছে না। বসতি ক্যাম্পের পিছনের অংশ আরো বাড়তে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত করেন।

 

জাহিদ হোসেন ২৬ বছর আগে মায়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসেছেন উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। পেশায় দিনমজুর। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এরমধ্যে ওপারের হাতিপাড়া থেকে দিলারা শিশু সন্তান নিয়ে উঠেছেন তার ঝুঁপড়িতে। দিলারার স্বামী নুরে আলমকে ধরে নিয়ে গেছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী। তার হদিস নেই। দিলারাকে অকথ্য নির্যাতন করেছে সেনা সদস্যরা। এরমধ্যে শিশু সন্তান নিয়ে ২৪ নভেম্বর রাতে নাফ নদী পাড়ি দিয়েছেন তিনি। দিলারার মতো আরো ৪ পরিবার এসেছে জাহিদের ঝুঁপড়িতে। একইভাবে অন্যান্য ঝুঁপড়িতে গত এক সপ্তাহে উঠেছে আরো ২৬ জন। জাহিদ বলেন,  বন বিভাগের জমিতে অনিবন্ধিত ক্যাম্প।

 

ওই জমি স্থানীয় শাজাহান, হামিদুল হক, আব্দুর রশিদ, জাবির হোসেনসহ কয়েকজনের দখলে ছিল। রোহিঙ্গারা নিজ খরচে মাটি, বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে সেখানে ঝুঁপড়ি নির্মাণ করেছে। তারা প্রতিমাসে ৫০ টাকা ভাড়া তুলে আসছে। এখন মাসে ৩০০-৪০০ টাকা দাবি করছে তারা। বাড়তি ভাড়া না দিলে ঝুঁপড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে তারা। এ অবস্থায় অনিবন্ধিত ক্যাম্পের বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছে।

 

জাহিদ বলেন, পুরুষদের  অনেকে দিনমজুর, রিক্সাচালানোর পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তি করেন। কাজের সুযোগ না পেয়ে মহিলারাও ভিক্ষাবৃত্তি করছেন।

 

আনিছ (১৫), তার দুই ছোট ভাই জুবায়ের (১০) ও  আনোয়ারকে (৮) সঙ্গে নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে ১০-১২ দিন আগে অনিবন্ধিত ক্যাম্পে ঢুকেছেন। তাদের বাবা হোসেন আহাম্মদ ও মা আয়েশা বেগম ওপারে রয়ে গেছেন। আসতে পারছেন না। মোবাইল, ভাইবার, ইমু ও ম্যাসেঞ্জারে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন, তারাও এপারে আসার সুযোগ খুঁজছেন। আগে থেকেই ক্যাম্পে আসা হোসেন আহম্মেদের তত্ত্বাবধানে থাকা এই তিনভাই অনেকটা কষ্টে সময় পার করছেন বলে জানিয়েছেন আনিছ।

 

এদিকে ৫ নভেম্বর আসা নাসিম বলেছেন, হাতিপাড়া থেকে লম্বাবিল দিয়ে স্ত্রী পেটানসোনা, পুত্র জুবায়ের ও কন্যা রাশিদা বেগমকে নির্বিঘেœ তিনি নৌকায় নাফ নদী পাড়ি দিয়েছেন। এখন কি করে পেট চলবে সেই ভাবনায় তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ২৩ নভেম্বর রাতে তার ভাই সলিম মারা গেছে সেনাবাহিনীর গুলিতে।

 

নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাবেক মাঝি (সর্দার) শামসু জানান, ১৯৯২ সালে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৮৪ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করলে জাতিসংঘের সহায়তায় সরকার ২ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মায়ানমারে ফেরত পাঠায়। এদের অনেকেই আবার অনুপ্রবেশ করে। ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল।

 

তিনি জানান, ৭টি ব্লকের মাঝি (সর্দার), সেচ্ছাসেবী ও চেয়ারম্যান মিলে মোট ৭৮ জনকে ইউএনএইচসিআর থেকে মাসিক ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা করে সম্মানী দেওয়া হয়। তারা ইউএনএইচসিআরের হয়ে কাজ করেন। রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করেন না। তার দাবি, সর্বশেষ রোহিঙ্গা শুমারী অনুযায়ী কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত ক্যাম্পে ৩৩ হাজার লোক রয়েছে।  তবে বাস্তবে এর সংখ্যা কয়েকগুণ বলে দাবি করেন তিনি। ‘ওপারে আরাকানে ৬-৭টি বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ স্বাধীনতার দাবিতে যে আন্দোলন করে আসছে তাদের পিছনে চীন সরকারের ইন্ধন রয়েছে। তারা চীন থেকে অস্ত্র ও অর্থ পাচ্ছে। আর নির্যাতনের বলি হচ্ছে অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানেরা’ বলেন তিনি ।

 

অনিবন্ধিত ক্যাম্পের সেক্রেটারি মোহাম্মদ নূর জানান, তার কাছে থাকা তালিকা মতে গত এক সপ্তাহে ১১১৭ পরিবারের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গা ওই ক্যাম্পে অনুপ্রবেশ করেছে। তালিকার বাইরে আরো কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলেও তিনি দাবি করেন।

 

নূর জানান, বন বিভাগের জমি দখল করে প্রভাবশালীরা রোহিঙ্গাদের ড্যারা বানানোর সুযোগ করে দিয়ে ভাড়া আদায় করে আসছেন।

 

শরণার্থী পুনর্বাসন প্রকল্পের ক্যাম্প ইনচার্জ আরাফাত শাকিল বলেছেন, নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তার কিছু জানা নেই। তারা নিবন্ধিতদের নিয়ে কাজ করেন। অতিরিক্ত সচিব রেজোয়ান হোসেন কক্সবাজারে বসে পুরো প্রকল্প মনিটরিং করেন।

 

স্থানীয় রাজাপালং ইউপির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বখতিয়ার আহম্মদ বলেছেন, রোহিঙ্গা আসা কমেছে। ওপারে আসার অপেক্ষায় আছেন কয়েক লাখ এমন খবর রয়েছে। বিজিবির কড়াকড়ির কারণে তারা নদী পার হতে পারছে না। রোহিঙ্গারা এদেশে আসার পর সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।

 
 

 

রাইজিংবিডি/ ক্সবাজার/৪ ডিসেম্বর ২০১৬/ রুবেল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়