ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

স্মরণ : কবি বন্দে আলী মিয়া

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ২৭ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্মরণ : কবি বন্দে আলী মিয়া

কবি বন্দে আলী মিয়া

শাহ মতিন টিপু : ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,/ থাকি সেথা সবে মিলে-নাহি কেহ পর।/ পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,/ এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।’ এমন অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতার ¯্রষ্টা বন্দে আলী মিয়ার ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায় ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি জন্ম বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই কবির।

কবি বন্দে আলী মিয়া ২৬ বছর বয়সেই লেখালেখির জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। কবি মৃত্যুর চার বছর আগে তার ‘ধরিত্রী’ কাব্যে ‘বিদায় প্রহর’ কবিতায় তিনি লেখেন- ‘এবারে আমার শেষ হয়ে এলো/ প্রবাসের দিনগুলি/ যাবার বেলায় বারে বারে হায়/মন ওঠে তবু দুলি।/ কেটেছে হেথায় কয়টি বছর/সুখে-দুখে বেদনায়/ স্মরণ ভরিয়া রহিল সে সব/ভুলিব না কভু তায়।/ আমার স্মরণে তোমাদের ছবি/জেগে রবে অনুক্ষণ/ বিদায় এবার ফুরায়েছে মোর/প্রবাসের প্রয়োজন।’

বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন রাজশাহীর কাজিরহাট অঞ্চলের নিজ বাসভবনে সকাল ১১টা ১০ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কবির জন্ম ১৭ জানুয়ারি, ১৯০৬। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, শিশু-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিত্রকর। তিনি পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি পাবনার মজুমদার একাডেমি থেকে ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন এবং ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯২৫-এ ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি কলকাতা জীবনে রবীন্দ্র-নজরুলের সান্নিধ্য লাভ করেন। তখন তার প্রায় ২০০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সে সময় বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানিতে তার রচিত পালাগান ও নাটিকা রের্কড আকারে কলকাতার বাজারে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৬৪-র পর প্রথমে ঢাকা বেতারে ও পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেন। প্রকৃতির রূপ বর্ণনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থ আজও অমর হয়ে আছে।

কবি বন্দে আলী মিয়া কলকাতা, ঢাকা ও রাজশাহী এ তিনটি স্থানই তার কর্মস্থল ছিল। কবি জীবনের শেষ দিকে বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীর স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বেতারে কাজ করার সময় ছোটদের আসর সবুজ মেলায় ‘গল্প দাদু’ নামে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি বেতারে ‘ছেলে ঘুমালো’ নামে একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।

তিনি কলকাতায় ছিলেন তিরিশ বছর। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সজনিকান্ত দাশ, প্রমথ চৌধুরী, নরেশ দেব, হুমায়ুন কবির, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, একে ফজলুল হক এদের সান্নিধ্যে আসেন।

কবি বন্দে আলী মিয়ার প্রথম কাব্য ‘ময়নামতির চর’ এর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন- ‘তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে গঙ্গা চরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথায়ও ফাঁকি নেই। সমস্ত সরের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস শুদ্ধিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক গ্রাম্য শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হওনি। তাতে করে কবিতাগুলি আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকটস্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি। (২৬ জুলাই ১৯৩২)।’

শিশু সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন। তিনি মরণোত্তর একুশে পদক এ ভূষিত হন।

জানা যায়, কবি বহুবিবাহ করেছিলেন। বাবা-মা’র সম্মতিক্রমে পাবনা শহরের জেলাপাড়া মহল্লার রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অনেকের মতে, তিনি কলকাতা, রাজশাহী ও ঢাকায় সংসার পেতেছিলেন। এমনও শোনা যায়, বন্দে আলী মিয়ার নওগাঁ জেলাতেও আরও একটি সংসার ছিল। বিস্তারিত কিছু না জানা গেলেও হেনা, শামসুন্নাহার ও পরীবানু নামে অপর তিন স্ত্রীর নাম পাওয়া গেছে বলে কথিত আছে।

পাবনার একটি সড়ক ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের নাম কবি বন্দে আলী মিয়ার নামে নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া জেলার আটঘরিয়া উপজেলায় ১৯৮৮ সালে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ‘কবি বন্দে আলী মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’  প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে সংরক্ষণের অভাবে বিলীনের পথে কবির বসতভিটা ‘কবি কুঞ্জ’, কবরস্থান। বন্ধ হয়ে গেছে কবির নামে প্রতিষ্ঠিত একটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৬/ টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়