ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হাতি ও মশার যুদ্ধ || ইবনুল কাইয়ুম

ইবনুল কাইয়ুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ২ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাতি ও মশার যুদ্ধ || ইবনুল কাইয়ুম

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

এক বনে ছিল এক হাতি। তার নাম গঙ্গারাম। বনের সব পশুপাখি মিলে নামটি দিয়েছে। গঙ্গারাম একটু বোকা প্রকৃতির। সে যেমন অলস তেমনি আরাম প্রিয়। একবার ভরপেট খাওয়া পেলে ঘুমাতেই বেশি ভালোবাসত।

তার সবসময়ের সঙ্গী একটি কাঠঠোক্‌রা পাখি। কাঠ ঠোকানোর চেয়ে সে গঙ্গারামের ঘাড়ে চড়ে বেড়াতেই বেশি পছন্দ করে। গঙ্গারাম কাঠঠোক্‌রাটির নাম দিয়েছে, কৃটকৃটি। খুবই ছটফটে কৃটকৃটি। এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারে না। তবে গঙ্গারাম আর কৃটকৃটির মধ্যে কিন্তু ভারি ভাব। গঙ্গারাম যেখানে যেতো কৃটকৃটিও তার সঙ্গে থাকত।

একদিন দুপুরে ভরপেট খেয়ে গঙ্গারাম একটি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছিল। মাঝ আকাশে সূর্য একেবারে রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। তবে মৃদুমন্দ বাতাস থাকায় একটু স্বস্তি মিলছে এই যা। বনের গাছগাছালির মধ্যে কেমন একটা ঝিমুনির ভাব। পশুপাখিরা সব নিশ্চুপ মেরে আছে। কেমন আঁঠালো ঘুম ঘুম রেশ বিরাজ করছে প্রকৃতিতে। ছটফটে কৃটকৃটি পর্যন্ত ঝিম মেরে বসে আছে গঙ্গারামের ঘাড়ের উপর।

তবে প্রকৃতির আর সবাই ঝিম মেরে গেলেও কুটুশ কিন্তু ঘুমাতে পারছে না। কুটুশ হলো ওই বনেরই একটি মশা। এই ভর দুপুরে ওর বেজায় ক্ষুধা লেগেছে। সবাই আরামে ঘুমাচ্ছে। আর ক্ষুধার জ্বালায় ওর দুচোখের পাতা এক হচ্ছে না। পেটের মধ্যে থেকে মেঘের গর্জনের মতো গুড়ু গুড়ু ডাক বেরিয়ে আসছে। আর কেউ শুনতে না পেলেও নিজের পেটের ডাক ও ঠিকই শুনতে পাচ্ছে।

কুটুশের মনে খুব দুঃখ। বনের প্রাণিগুলো যা নচ্ছার, ভাবতেই ওর মনে রাগ উথলে ওঠে। মাত্র এক ফোঁটাই তো। সারা জীবনে এই ফোঁটা রক্তই তো লাগবে তার। কিন্তু কেউ এই এক ফোঁটা রক্তের মায়া ত্যাগ করতে পারে না! কাছে গেলেই দূরছাই করে তাড়িয়ে দেয়। যত্তসব কৃপণ বখিলের দল। বনের সব পশুদের প্রতি বিতৃষ্ণায় মন ভরে যায় তার।   

গঙ্গারাম মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে তা হঠাৎ করে বোঝা খুবই মুশকিল। তার পাকানো সুতোর মতো লেজটিকে নড়তে দেখে বোঝাগেল এখনো ধড়ে প্রাণটি টিক টিক করছে। অন্তত কুটুশের তাই মনে হলো। সে ভাবল তাহলে আর দেরি করে কি হবে? যাই দেখি সুযোগটা কাজে লাগাই। মরার আগেই একফোটা রক্ত নিয়ে নেওয়া যাক। কুটুশ যেই না কাছে গেছে ওমনি গঙ্গারামের বড় বড় কানগুলো নড়ে উঠল। চোখ দুটোও খুলে গেল। কুটুশকে দেখতে পেয়ে তাকে তাড়ানোর জন্য গঙ্গারাম এদিকে একবার ওদিকে একবার শুড় নাড়াতে লাগল। দুয়েকবার ফু দিয়েও চেষ্টা করল। তবে তাড়াতে পারল না। নাছোড় বান্দার মতো লেগে থাকলো কুটুশ।

কৃটকৃটি আর বসে থাকে কেনো? গঙ্গারামের বিরক্তি দেখে সে বুকটান করে পাখা দুটো মেলে দিল। কুটুশের পিছনে লেগে গেল আঠার মতো। একবার বাগে পেয়েছে মনে করে ডাইভ দিয়ে ধরতে গেল কুটুশকে। আর ওদিকে গঙ্গারামও তার শূঁড়ের একটা রাম বাড়ি বসিয়ে দিল কুটুশকে লক্ষ্য করে। এই যাহ্ সেমসাইড হয়ে গেল যে। শূঁড়ের বাড়ি গিয়ে লাগল কৃটকৃটির গায়ে। ছিটকে বিশহাত দূরে একটা গাছের গায়ে গিয়ে বাড়ি খেলো কৃটকৃটি। একেবারে দাঁত ছরকুটে পড়ে থাকল গাছের নিচে। তার মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে।

ওদিকে কুটুশের হাসি দেখে কে। গঙ্গারামের নজর যখন কৃটকৃটির দিকে তখন সেই সুযোগ কাজে লাগালো কুটুশ। ডাইভ দিয়ে গিয়ে পড়ল গঙ্গারামের পশ্চাতের ওপর। হুল ফোটানোর সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে কয়েকহাত ওপরে উঠে গেল সে। চার পা চারদিকে আর শূঁড়খানা সামনে একেবারে ছড়িয়ে আছে তার। দেখার মতো দৃশ্য বটে। গঙ্গারামের গগণ বিদারি চিৎকারে বনের ঘুম ঘুম পরিবেশ ভেঙ্গে একেবারে খান খান হয়ে পড়ল। আশপাশের গাছ গাছালি থেকে পাখিরা তাস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে উড়ে গেল।

কুটুশের এই কাজে খুবই রাগ হয়েছে গঙ্গারামের। সেই সঙ্গে অপমানও বোধ করেছে সে। যুদ্ধংদেহী ষাড়ের মতো তাই মাটিতে পা ঠুকে কুটুশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল গঙ্গারাম। ছোট ছোট চোখ দুটো তার ক্রোধে ভয়ংকর হয়ে উঠল। এই রণমূর্তি দেখে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিলো কুটুশ। কুটুশ প্রাণ পণে উড়ে চলেছে। তার পেছনে গঙ্গারাম আকাশ, বাতাস আর মাটি কাঁপাতে কাঁপাতে ছুটে চলেছে। ধরতে পারলে আজ আর আস্ত রাখবে না সে কুটুশকে।

প্রাণ ভয়ে কুটুশ ঘাস বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সেখানে মাটিতে মাথা গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিল উটপাখি ভোম্বলা। কুটুশ তাকে পাশ কাটিয়ে উড়ে যেতেই ভোম্বলা সচকিত হয়ে মাথা তুলল। আশপাশে তাকাতেই দেখল গঙ্গারাম ভূমিকম্প ঘটাতে ঘটাতে ছুটে আসছে। কি করবে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারল না সে। ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকল যতক্ষণ না পর্যন্ত গঙ্গারামের শূঁড়ের বাড়িতে আকাশপানে উড়তে শুরু করল। তবে বিনা পাখায় এই ওড়াউড়ি তার জন্য কতটা সুখকর তা অবশ্য ভোম্বলাই বলতে পারবে।

এদিকে একটা বড় গাছের মগডাল থেকে কচি কচি পাতা ছিঁড়ে মনের সুখে চিবুচ্ছিল দুটো জিরাফ- হান্টু আর কান্টু। কুটুশ রকেটের গতিতে তাদের মাঝ দিয়ে উড়ে গেল। লম্বা দুটো গলা গোল পোস্টের মতো দাঁড়িয়েই থাকল হান্টু-কান্টু। কোনো ভাবান্তর নেই। নিরাবেগ দৃষ্টিতে আধবোজা চোখে পাতা চিবিয়ে চলেছে তারা। তবে এক মুহূর্ত পরে আর দৃষ্টিতে নিরাবেগ ভাবটি থাকল না। গঙ্গারামকে দেখে বড় বড় হয়ে উঠল দু জোড়া চোখ। পাতা চিবানো থেমে গেছে তাদের। সরে যাওয়ার আগেই গঙ্গারামের সামনে পড়ে গেল তারা। একটুপর হান্টু-কান্টুকেও আকাশে উড়তে দেখা গেল।

মনে হচ্ছে কুটুশকে আজ একহাত না দেখে থামবে না গঙ্গারাম। কুটুশও প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বেজায় বেগে উড়ে চলেছে। উড়তে উড়তে একেবারে বনের শেষ প্রান্তে চলে এলো কুটুশ। এরপরই পাহাড়ের ঢাল। লম্বা একটা পাথরের লেজ বেরিয়ে আছে এখানে। তারপর ঝপ করে বিশ ফুট নিচে ঘাসমোড়া খাদ। পাথরের লেজটি ছাড়িয়ে এলো কুটুশ। গঙ্গারামও তার পিছু পিছু। এই তো ধরে ফেলেছে আরকি। আরেকটু...। হঠাৎ পায়ের নিচে মাটি পেলো না গঙ্গারাম। ধপ করে তার ভারি দেহটি বিশ ফুট নিচে গিয়ে পড়ল। শূঁড়টি সামনে পড়ে থাকল আজদাহা অজগরের মতো। মাথাটি মাটিতে, পা চারটি আকাশ পানে চারদিকে ছড়ানো।

এমন সময় কৃটকৃটি উড়ে এলো। গঙ্গারামের মুখের সামনে বসে তার এই করুন দশায় দুর্বোধ্য ভাষায় সহমর্মীতা দেখাতে লাগল। এমন সময় হুড়মুড় করে কোথা থেকে তার ঘাড়ে এসে পড়ল ভোম্বলা। একটু পর আকাশ থেকে হান্টু-কান্টুও নেমে এলো। তারা গঙ্গারামের দুপাশে বডিগার্ডের মতো পড়ে থাকল। তাদেরও দশা গঙ্গারামের মতই। মাথা মাটিতে পা চারটি আকাশ পানে চারদিকে ছড়ানো।

তাদের এই দশা দেখ আনন্দে ডগমগ হয়ে পুওওওও করে উড়ে এলো কুটুশ। চারপাশে একটা চক্কর কেটে এগিয়ে গেলো গঙ্গারামের দিকে। তার টিকিপানা লেজটি দুবার নড়ে থেমে গেল। তা দেখে হাসি দুই কানে গিয়ে ঠেকল কুটুশের। ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেল সে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ আগস্ট ২০১৫/সনি/তাপস

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়