ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হ্যানয়, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১০ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হ্যানয়, ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ

উদয় হাকিম, হ্যানয় (ভিয়েতনাম) থেকে : পোর্ট এন্ট্রি। অথবা অন এ্যারাইভাল। যারা বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন, তাদের কাছে শব্দ দুটি পরিচিত। ভিসা ছাড়া কোনো দেশে প্রবেশাধিকার এটা। বিষয়টা অনেক সম্মানের। সাধারণত বড় এবং অধিক বন্ধুপ্রতিম দেশকে এই সুবিধা দেয়া হয়।

 

বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা যতই হতাশ হই, অন্যরা যতই নাক সিঁটকান না কেন; বাংলাদেশের অধিবাসীরাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন এ্যারাইভাল বা পোর্ট এন্ট্রি পেয়ে থাকেন। গুগল বলছে ৪২টি দেশ আমাদের অন এ্যারাইভাল ভিসা দেয়।  কিন্তু আমার ধারণা সংখ্যাটা ৭০ এর কাছাকাছি হবে।

 

প্রসঙ্গটা উঠলো বিশেষ কারণে। আগে আরো বেশি সংখ্যক দেশে পোর্ট এন্ট্রি পেতাম আমরা। ধীরে ধীরে সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আরো কমবে সেটাও চোখ বুঁজে বলে দিতে পারি। কারণ বিশ্ববাসীর কাছে আমরা ক্রমেই মূল্য হারিয়ে ফেলছি।

 

আমার মনে হয়, যেসব দেশ এখনো সম্মান করে আমাদের অন অ্যারাইভাল ভিসা দিচ্ছে যেসব দেশে আমাদের বেশি বেশি বেড়াতে যাওয়া উচিত। অথবা ওইসব দেশে যেসব বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী যেতে চান তাদের সাধুবাদ জানানো উচিত। অথচ হচ্ছে তার উল্টো! কীভাবে?

 

ঢাকা বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে যেসব পুলিশ সদস্যরা কাজ করেন তারা জানেনই না যে অন এ্যারাইভাল ভিসা নামে একটা বিষয় আছে! যতবারই অন এ্যারাইভাল ভিসায় বিদেশে গিয়েছি ততবারই তারা বলেছে, যাওয়া যাবে না। শেষমেষ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়েছে।

 

তার মানে কী দাঁড়ালো? কোন কোন দেশে ভ্রমণে বাংলাদেশিদের ভিসা লাগে না, এই সহজ পাঠটুকুও তাদের দেয়া হয় নি! তবে ঘটনা অন্যরকমও হতে পারে। হয়তো জানেন ঠিকই। কিন্তু যাত্রীকে হয়রানী করার প্রবণতা থেকেই এটা করা হয়। যাক, এসব বলাও ঠিক না। সরকারি কাজে হস্তক্ষেপ হতে পারে। আমি কোথাকার কোন হরিদাস পাল, আমার জন্য বানাতে হবে ধান ক্ষেতের আ’ল।

 

ভিয়েতনামের পার্লামেন্ট ভবন

 

ভিয়েতনাম যাচ্ছি। কুয়ালালামপুর হয়ে হ্যানয়। এরপর হ্যানয় থেকে হা লং বে। ঢাকা এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনে একটা কাগজ ছিলো সঙ্গে। ভিয়েতনাম ইমিগ্রেশনের চিঠি। তাতে আমাদের চারজনের নাম, পাসপোর্ট নম্বর, সিল-ছাপ্পর ছিলো। হ্যানয় গেলে ভিসা স্ট্যাম্পিং হবে। যথারীতি আটকে গেলাম। আবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে পার পেলাম।

 

ফ্লাইট দেড় ঘন্টা ডি’লে। গভীর রাত অব্দি অপেক্ষা। ভেবেছিলাম বাজেট এয়ার মালিন্দো খাবার-পানি দেবে না। কিন্তু না, এয়ার এশিয়ার মতো এরা অত খচ্চর নয়। এয়ার এশিয়ায় এক গ্লাস পানিও দেয় না ডলার ছাড়া। মালিন্দো নাস্তা পানি সবই দিয়েছে। সকাল বেলা বিমান থেকে মালয়েশিয়ার পাম বাগান, রাস্তা দেখা হয়ে গেলো। সারা রাত জেগে সকাল সোয়া আটটায় নামলাম কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে। হ্যানয়ের ফ্লাইট ধরতে দৌঁড়।

 

হ্যানয়ের ফ্লাইট খুব উপভোগ করলাম। দিনের বেলা সমুদ্র আর ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। ফ্লাই করার আধা ঘন্টা পর শুরু হলো সমুদ্র। এর আধা ঘন্টা পর আবার স্থলভূমি, বনভূমি, লোকালয়। পাইলট জানালেন, ৩৩ থেকে ৩৫ হাজার ফুট উপর দিয়ে যাচ্ছি। ৩ ঘন্টা সময় লাগবে হ্যানয় পৌঁছতে। এয়ারপোর্টেও আগে দেখলাম নিচু জায়গা, জলাভূমি। আমাদের যেমন এয়ারপোর্টের সঙ্গেই আশুলিয়ার বিল।

 

বেলা সাড়ে বারোটায় নামলাম হ্যানয় এয়ারপোর্টে। ২৫ ডলার খরচে ভিসা স্ট্যাম্পিং হলো। বাইরে অপেক্ষমান গাইড দাঁড়িয়ে ছিলেন গাড়ি নিয়ে। মিস্টার ডুক আমাদের রিসিভ করলেন। বৃষ্টি হচ্ছিলো তখন। ডুক জানালেন, নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। এরপরই শীত শুরু হবে। আমাদের দেশের মতোই।

 

 ভিয়েতনামের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তর বা প্রধান অফিস

 

এয়ারপোর্ট থেকে শহরে পৌঁছতে মিনিট ৪০ লাগলো। এরমধ্যে ডুক জানালেন, ৩০ বছর আগে হ্যানয় ছিলো ৯০০ লোকের শহর। এখন বাস করে ৬০ লাখ। ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বড়। লোকসংখ্যা ৯ কোটি। কথা হলো ভিয়েতনামের রাজনীতি নিয়ে। কমিউনিস্ট পার্টি দেশ চালাচ্ছে। এখানে নাকি পার্টি বলতে ওই একটাই। তা কেন? ডুকের ব্যাখা- এখানে রাজনীতিকরা দুর্নীতিবাজ, মিথ্যুক, প্রতারক এবং পকেটমার। তাই তাদের কাছে চেনা পকেটমার ভালো, নতুন অচেনা কোনো পকেটমারকে তারা চান না!

 

লাঞ্চ সেরে হোটেলে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সঙ্গে ডুক। তার সঙ্গে আমরা চারজন। জাহিদ হাসান, ফিরোজ আলম, মিল্টন আহমেদ আর আমি। আগেই শুনেছি; পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল চলে ভিয়েতনামে। কথা সত্য। শহর জুড়ে কেবল মোটরসাইকেল, হাজার হাজার। বুড়ো-বুড়ি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চালাচ্ছে।

 

প্রথমে নামলাম বিপ্লবী হো চি মিনের সমাধিসৌধ ও মিউজিয়ামে। বিশাল এলাকা। তার উল্টোদিকে পার্লামেন্ট ভবন। রাস্তায় ওই শত শত গাড়ির মাঝ দিয়েই হুইসেল বাজিয়ে প্রেসিডেন্টের গাড়ি গেলো। অবশ্যই বাংলাদেশের মতো রাস্তা বন্ধ করে নয়। কোনো গাড়িকে থামিয়েও নয়। পাশেই প্রেসিডেন্ট ভবন। তার সামনে গিয়ে ছবি তুললাম সবাই। একই চত্বরে কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তর। প্রেসিডেন্ট ভবনের সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর অফিস, বাসভবন। পুরো এলাকা হেঁটেই দেখলাম। ফিরোজ বললেন, লিখে দিয়েন; আমি খুব এক্সাইটেড!

 হ্যানয় শহরে বিপ্লবী হো চি মিনের সমাধি ও মিউজিয়াম

 

বিশাল একটা লেকের ধারে বসলাম। ডাবের পানি পান করলাম। ৫টা ডাবের দাম এক লাখ ৮০ হাজার ডং (ভিয়েতনামের মুদ্রা)। দাম খুব একটা বেশি নয়। কারণ এক মার্কিন ডলারে মেলে ২২ হাজার ডং!

 

এরপর গেলাম অপেরা হাউজে। মেঘলা দিন। বৃষ্টি পড়ছে। অচেনা জায়গা। তাই অপেরা হাউজে না ঢুকে বেরিয়ে পড়লাম। ১৮৯৬ সালে ফরাসিরা এটা করেছিলো। ভিয়েতনাম দীর্ঘদিন ফরাসি কলোনি ছিলো। তাই তাদের স্টাইলেই বাড়ি-ঘর।

 

ফিরোজ আর মিল্টন হেঁটে যাবেন হোটেলে। আমি আর জাহিদ হাসান উঠলাম সাইক্লো রাইডে। অনেকটা রিক্সার মতো। কিন্তু এর চালক থাকে পেছনে, যাত্রী সামনে। এটি হ্যানয়ের পুরনো সিটি। আমাদের পুরান ঢাকার মতো। লেক, দোকানপাট, ঘিঞ্চি এলাকা পার হচ্ছি। ব্যস্ত শহর। কিন্তু কোথাও কোনো গাড়ির হর্ন নেই!

 

এক লাখ ডং টিপস দিয়ে পৌঁছলাম হোটেলে। ততক্ষণে স্ট্রিট লাইট জ্বলে উঠেছে। আলোয় ভরে উঠছে শহর। এই আলো-ই আশা সঞ্চারিণী। আলোর সন্ধানেই ছুটছি আমরা। ছুটছে পৃথিবী।

 

 

রাইজিংবিডি/১০ নভেম্বর ২০১৬/অগাস্টিন সুজন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়