ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘আগে জানলে মায়েরে রানা প্লাজায় চাকরি করতে দিতাম না।’

হেদায়েতুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৩ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘আগে জানলে মায়েরে রানা প্লাজায় চাকরি করতে দিতাম না।’

এই শিশুদের প্রত্যেকেই রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় স্বজন হারিয়েছেন

গাইবান্ধা প্রতিনিধি :  ২৪ এপ্রিল ২০১৩। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না হয়ে রইল এই দেশেরই কিছু ভাগ্যহত মানুষের। মর্মান্তিক সেই ঘটনার রেশ এখনও কাটেনি। সেদিন দুর্ঘটনায় যারা মৃত্যুবরণ করেছিলেন তাদের পরিবারের কান্না থামেনি এখনও। বিশেষ করে সেদিনের ঘটনায় বাবা-মা হারা শিশুদের চোখের জল এখনও ঝরে অঝর ধারায়। মা-বাবার কথা মনে পড়লেই ছোট্ট বুকের মধ্যে বড় বেদনা হয়ে বাজে হাহাকার।

সেদিন দুর্ঘটনায় মা-বাবা হারানো অনেক শিশুর ঠাঁই হয়েছে গাইবান্ধার সমাজ সেবামূলক বেসরকারি সংগঠন অর্কা (ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন) হোমে। সেখানে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় স্বপন ইসলামের (১০) সঙ্গে। তার গ্রামের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মাওজি গ্রামে। স্বপনের মা  ফেরোজা বেগম চাকরি করতেন রানা প্লাজায় অবস্থিত একটি প্রতিষ্ঠানে। ভবন ধসে পড়ার পর সেখান থেকে ফেরোজা বেগমের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। স্বপনের বাবা আনারুল ইসলাম সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন আরো অনেক আগে। ফলে আকস্মিক এই ঘটনা স্বপনের জীবনকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। পরে স্বজনেরা তাকে রেখে যান অর্কা হোমে।

স্বপনের সঙ্গে থাকে আল-আমিন (১১)। তার বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলায়। মমতাময়ী মায়ের স্নেহ-ভালোবাসায় বেড়ে উঠছিল সে। রানা প্লাজার সেই ঘটনা তার জীবন থেকে কেড়ে নেয় মায়ের আদর, স্নেহ। মা ফাতেমা বেগম চলে যান না ফেরার দেশে। স্বামী পরিত্যাক্তা মায়ের স্বপ্ন ছিল আল-আমিন বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হবে। একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তখন ঘুঁচে যাবে জীবনের সকল দুঃখ, কষ্ট। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। দুঃখ এখন আল-আমিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মা তার কাছে কেবল স্মৃতি। মায়ের কথা মনে হতেই হু হু করে কান্না চলে আসে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখনও মায়ের কথা ভেবে তার চোখের কোণে জমেছিল পানি। সে বারবার বলছিল, মায়ের কথা মনে হইলে কিছুই ভালো লাগে না। মায়ের মতো কেউ আমাকে এখন আদর করে না। দুই বছর হইল মাকে দেখি না। আমাকে মানুষ করার জন্য মা রানা প্লাজায় গার্মেন্টসে চাকরি করতো। আগে জানলে মায়েরে রানা প্লাজায় চাকরি করতে দিতাম না।

সেদিন আল-আমিনের মতো অকালেই মা-হারা হয়েছে গাইবান্ধা সদর উপজেলার আলিফ হাসান (১২), একই জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার সিহাব (১২) এবং জামালপুর সদর উপজেলার সৌরভ হাসান (৫)। এ ছাড়াও হোমে দেখা হয় আরিফুল ইসলামের (১০) সঙ্গে। আরিফুলের জীবনের গল্প একটু অন্যরকম। ধসে পড়া ভবনের  নিচে সেদিন চাপা পড়েছিলেন আফরোজা বেগম। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও স্মৃতিশক্তি হারিয়ে এখন তিনি মৃতপ্রায়। বাবা মান্নান মিয়া আরিফুলের মাকে তালাক দিয়ে দেয়। ফলে মাকে নিয়ে আরিফুল নানাবাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার কান্তানগরে এসে ওঠে। সবাই আশা করেছিল আফরোজা বেগম নিশ্চয়ই একদিন সুস্থ হবেন। কিন্তু না হওয়ায় কিছু দিন আগে দিনমজুর নানা আরিফুলকে হোমে রেখে যান।

উল্লিখিত শিশুরা বঞ্চিত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে। ওরা এখন জেনে গেছে, আর কখনও মা ওদের কোলে নিয়ে আদর করবে না। মায়ের স্নেহমাখা স্পর্শ আর কখনও পাবে না তারা। এখন তাদের একটাই চাওয়া, জড়িতদের শাস্তি হোক। আল-আমিনের ভাষ্যমতে, মায়ের জীবন কেড়ে নেওয়ার জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তি দিতে হবে।  যাদের জন্য সেদিন দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের শাস্তি হলে তার মতো আর কোনো শিশু মায়ের স্নেহ থেকে অকালে  বঞ্চিত হবে না। মা-হারা আরেক শিশু আলিফ মিয়া জানায়, বন্ধু-বান্ধবদের মায়েরা যখন ওদের কোলে নেয়, আদর করে, তখন খুব কষ্ট হয়। আমাকে কেউ আদর করে না, কোলে নেয় না, খুব কান্না পায় তখন।

ভাগ্যহারা দরিদ্র পরিবারের এই শিশুরা সবাই এখন বেড়ে উঠছে অর্কা হোমে। তাদের লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছে এই সংগঠন। সংগঠনের ভাইস প্রিন্সিপাল শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাবা-মা হারা এসব শিশুকে স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য বিজিএমইএ’র কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। তারা পেশাজীবনে প্রবেশের আগ পর্যন্ত সকল দায়িত্ব আমাদের।’ ২০১৪ সালে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার হোসেনপুরে অর্কা হোম প্রতিষ্ঠিত হয়। হোমে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বাবা-মা হারা ছয় শিশু বেড়ে উঠছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ এপ্রিল ২০১৫/হেদায়েতুল ইসলাম/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়