ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

ইচ্ছে হয় এখনই ছুটে যেতে

আলী নওশের || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৩, ২৭ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইচ্ছে হয় এখনই ছুটে যেতে

গালাপাগোস দ্বীপের চিত্র

আলী নওশের : অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের এই পৃথিবী। এমন অনেক স্থান আছে যার অপার সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ না হয়ে পারি না। সারা পৃথিবীতেই এমন অসাধারণ সব সুন্দর জায়গা রয়েছে যেগুলোর ছবি দেখলে ইচ্ছে হবে এখনই সেখানে ছুটে যেতে। এরকমই একটি স্থান গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ (Galapagos Islands)।

 

এর অবস্থান দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডর থেকে এক হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে নিরক্ষরেখা বরাবর প্রশান্ত মহাসাগরে। গালাপাগোসকে বলা হয় ‘জীবন্ত জাদুঘর’। এ দ্বীপপুঞ্জে অদ্ভুত ও অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের কারণে একে ‘বিবর্তনের শোকেস’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

 

অনন্যসাধারণ জীববৈচিত্র্যের কারণে ১৯৭৮ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা এবং এখানকার প্রাণিসমূহকে বিপণ্ন তালিকাভুক্ত করে।

 

এই দ্বীপ পুঞ্জের মাটি, বাতাস, চারপাশ ঘেরা সাগর সবকিছুতেই প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার উদাহরণ স্পষ্ট। এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া, পরক্ষণে আবার কোমল বাতাস। হয়তো হুট করেই কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল পুরো দ্বীপ। প্রতিকূল পরিবেশ দেখে প্রাচীনকালের নাবিকরা এর নাম দিয়েছিল ‘জাদুদ্বীপ’ বা ‘মায়াদ্বীপ’।

 

এই জাদুদ্বীপ প্রথমে নজরে আসে ১৮৩৫ সালে। তবে তারও তিন শতাব্দী পর্যন্ত কেউ এর ধারে কাছে যায়নি বা যেতে পারেনি। কারণ, জায়গাগুলো ছিলো দূর্গম ও ভয়ংকর। একমাত্র তিমি শিকারি ও জলদস্যুদেরই আশ্রয়স্থল ছিল।

কে কাকে অনুকরণ করছে? গালাপাগোস দ্বীপের প্রাণীরা মানুষ দেখে ভয় পায় না

 

বেশ কিছু আগ্নেয় দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ইকুয়েডরের গালাপাগোস প্রদেশের অন্তর্গত এবং সে দেশের জাতীয় পার্ক সিস্টেমের অংশ। দ্বীপপুঞ্জের মানুষদের প্রধান ভাষা স্প্যানিশ। ছোটবড় অনেক দ্বীপ ও পাহাড়-পর্বত রয়েছে এখানে। বড় দ্বীপ আছে ১৯টি। আর মাত্র চারটি দ্বীপে মানুষের বসবাস। প্রায় ২৬ হাজার লোকের বসবাস করেন সেসব দ্বীপে।

 

গত শতকে ইকুয়েডর সরকার ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সম্মানে গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জর সরকারী নাম দ্বীপমালা Archipelago de Colon (কলম্বাসের দ্বীপমালা) নামকরণ করে। ১৯৩৪ সালে এ দ্বীপ রক্ষা করার জন্য প্রথম আইন পাস করা হয়। বর্তমানে এটি ইকুয়েডর ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৫৯ সালে দ্বীপ সমূহের ৯৭ ভাগ ভুমি জাতীয় পার্কের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। দ্বীপগুলোর মধ্য পারস্পরিক দূরত্ব ৭০-৮০ কিলোমিটার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু এবং বাস্তুতান্ত্রিক অসামঞ্জস্য অবাক করার মতো।

কত বড় কচ্ছপ তা এই ছবি দেখে অনুমান করা যায়

 

১৮৩৫ সালে বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইন এই রহস্যময় অঞ্চল ভ্রমণে আসেন। ইংল্যান্ডের রাজকীয় নৌবাহিনীর তৃতীয় জাহাজ, এইচ.এম.এস. বিগলে ডারউইন প্রকৃতিবিদ হিসেবে ভ্রমণের সুযোগ পান। প্রায় চার বছর ধরে দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে ডারউইন গালাপাগোসে আসেন। এই দ্বীপপুঞ্জে তার পর্যবেক্ষণের ফলে বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি নতুন এক তত্ত্ব সংযুক্ত করেন। সেটাকে বলা হয় প্রাকৃতিক চয়নতত্ত্ব।

 

ডারউইনের ভ্রমণই গালাপাগোসকে বিখ্যাত করেছে। কারণ এখানকার বৈচিত্র্যময় বিরল প্রজাতিগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই ডারউইন প্রথমবারের মত বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ পেতে শুরু করেন। এখানকার অনেকগুলো প্রজাতি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে কাজ করেছে। ডারউইন প্রথম দ্বীপটিতে এসে খুবই আশ্চর্য হয়ে যান। তিনি দ্বীপের ভেতর দেখেন বিলুপ্ত প্রাণীগুলো দেদারসে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বিবর্তনবাদের কারণে হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রাণীই বহাল তবিয়তে হেঁটে বেড়াবে এখানকার  দ্বীপসমূহে, তা বোধহয় ভাবনায়ও ছিল না তার।

 

ডারউইন এ অঞ্চলের বড় বড় কচ্ছপ, ইগোয়ানা, শীল, কাঁকড়া, ফিঞ্চ, পেলিক্যান, হরবোলা, প্রভৃতি প্রাণী লক্ষ্য করেন। এই দ্বীপে এসেই ডারউইন লক্ষ্য করেছিলেন এখানকার মকিংবার্ডগুলো একেক দ্বীপে একেক রকম। বর্তমানে এই পাখিগুলোকে ডারউইনের ফিঞ্চ বলা হয়, যদিও সে সময় ডারউইন মনে করেছিলেন এদের সাথে কোন গভীর সম্পর্ক নেই এবং দ্বীপ অনুযায়ী তাদের আলাদা নামকরণের বিষয়টিও ভ্রমণের সময় তিনি চিন্তা করেননি।

 

সে সময় ইকুয়েডর প্রজাতন্ত্রের গালাপাগোস প্রদেশের গভর্নর ইংরেজ অভিজাত নিকলাস লসন চার্লস আইল্যান্ডে তাদের সঙ্গে দেখা করেন। ডারউইনের সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানান, কচ্ছপও একেক দ্বীপে একেক রকম। দ্বীপপুঞ্জে থাকার শেষ দিনগুলোতে ডারউইন ভাবতে শুরু করেছিলেন, একেক দ্বীপে ফিঞ্চ ও কচ্ছপের এই বৈচিত্র্য প্রজাতির পরিবর্তন সম্পর্কে নতুন ধারণার জন্ম দিতে পারে।

 

ইংল্যান্ডে ফিরে এসে ডারউইন গালাপাগোসসহ ভ্রমণের সময় বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত নমুনাগুলো অভিজ্ঞ জীববিজ্ঞানী ও ভূতত্ত্ববিদদের দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে দেখতে পেলেন, গালাপাগোসের ফিঞ্চগুলো বিভিন্ন প্রজাতির এবং দ্বীপ অনুযায়ী তাদের বৈশিষ্ট্য অনেক ভিন্ন। এই তথ্যগুলোই ডারউইনকে তার প্রাকৃতিক নির্বাচন এর মাধ্যমে বিবর্তন প্রমাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

 

এ ধারণা থেকেই তিনি তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘দ্য অরিজিন অব স্পেসিস’ রচনা করেন যা ১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত হয়। ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ বইয়ের অনেকাংশে এই দ্বীপের বর্ণনাই দিয়েছেন ডারউইন।  ১৯৬৪ সালে তার নামে এখানে সান্তা ক্রুজ ডারউইন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।

 

গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জকে নানা কারণেই বলা হয় রহস্যময় অঞ্চল। এখানকার প্রকৃতির আচরণ যেমন বিচিত্র তেমনি অদ্ভুত প্রাণিকূলের ধরন। এ অঞ্চলের প্রকৃতি সব সময় যেন বিচিত্র ও খেয়ালি আচরণ করে। গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের আকাশে প্রায় সময়ই বয়ে চলে প্রচণ্ড হাওয়ার স্রোত। সেখানকার সাগরে এলোমেলো ঢেউ আর খরস্রোতের তাণ্ডব। আবার যখন তখন নেমে আসে চারদিক আঁধার করা কুয়াশা।

 

প্রকৃতির এত সব বিপত্তি পেরিয়ে সেখানে জাহাজ চালানো খুব কঠিন ছিল। এর ঢেউগুলো অদ্ভুত প্রকৃতির । কখনো এই ঢেউগুলো এতই তীব্র হয় যে, এর টানে জাহাজ-নৌকাগুলো প্রচণ্ড গতিতে গ্যালাপাগোসের গায়ে আছড়ে পড়ত। আবার কখনো এই ঢেউগুলোই জাহাজ-নৌকাগুলোকে দূরসমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।

 

১৫৭০ সালে, মানচিত্র প্রণেতা ‘আব্রাহাম ওরটেলিউয়াস প্লটেড’ গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ অঙ্কিত করেন, এবং তাদের নামকরণ করা হয়, আইসলাস ডি গালাপাগোস বা ‘কচ্ছপ দ্বীপ’ (Islands of the Tortoises)। এই দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এই দ্বীপের প্রাণী। দ্বীপে ঢুকলেই আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে আসবে নাদুস নুদুস কোনো সিল মাছ কিংবা বুড়ো খোলস নাড়িয়ে আস্তে-আস্তে হেলে-দুলে আসবে কোনো বিশালাকৃতির কচ্ছপ। এরা কেউই মানুষের উপস্থিতিকে ভয় পায় না।

 

সামুদ্রিক পাখিদের বেশ কয়েকটি প্রজাতি শুধু গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জেই দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে গালাপাগোস পেঙ্গুইন, উড়তে অক্ষম করমোরযান্ট আর ওয়েভড অ্যালবাট্রস। আছে বিশালাকার সিল, কাঁকড়া, পেলিক্যান, হরবোলার মতো হারিয়ে যাওয়া প্রাণী। হাঁসের মতো জোড়া পায়ের অ্যালব্যাট্রস ও সিল মাছ। প্রায় সাড়ে সাত লাখ সামুদ্রিক পাখি আছে দ্বীপটিতে। তবে দৈত্যাকার কচ্ছপ আর সামুদ্রিক ইগুয়ানার জন্যই দ্বীপপুঞ্জ বেশি বিখ্যাত। এখানকার জীবজগতের এক-তৃতীয়াংশই কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। এখানকার ঝঞ্ঝাপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে গাছ আর প্রাণিগুলো বিচিত্রভাবেই বেড়ে উঠেছে।



ভিডিওতে দেখুন অপরূপ গালাপাগোস :

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৫/নওশের/কামরুজ্জামান

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়