ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এক মুক্তিযোদ্ধার আকুল আবেদন

স্বপ্নীল মাহফুজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১৮, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এক মুক্তিযোদ্ধার আকুল আবেদন

কাজী পিয়ারউজ্জামান

স্বপ্নীল মাহফুজ : কাজী পিয়ারউজ্জামান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কিন্তু তার বীরত্বগাঁথা কিংবা আর্থিক অবদান বলতে গেলে জাতির কাছে একেবারেই অজানা।

 

কাজী পিয়ারউজ্জামান ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ধনাঢ্য পাট বাবসায়ী কাজী আব্দুল আজিজের ছেলে এবং সবচেয়ে বড় পাট ব্যবসায়ী কাজী আজহারুল হকের শ্যালক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা শহরে মোট ছয়টি মোটরগাড়ি ছিল, যার দুটিই ছিল এই কাজী পরিবারের। ১৯৭১ সালে কাজী পিয়ার ছিলেন বি.এল (ব্রজলাল কলেজ, খুলনা) কলেজের ছাত্র।

 

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর যুদ্ধ যখন নিশ্চিত তখন কাজী পিয়ার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তা এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় আসেনি। পাকিস্তানের আয়ের একটা বড় উৎস ছিল পাট রপ্তানি। যার পুরোটাই উৎপন্ন হতো পূর্ব পাকিস্তানে কিন্তু সমস্ত লাভের অংশ চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। পাট রপ্তানির আবার বড় অংশ যেত খুলনা থেকে। তখন যুবক কাজী পিয়ার উজ্জামান এবং তার বন্ধু মাহবুবুল হক মিলে গোপনে ঠিক করলেন খুলনা থেকে পাট রপ্তানি বন্ধ করতে হবে। আর কাজটি করতে হবে নিজ পরিবার থেকে। সব পাট ব্যবসায়ীর কাছে খোলা চিঠি পাঠালেন। কিন্তু তাতেও যখন কেউ সাড়া দিল না, তখন তিনি নিজ ভগ্নিপতি কাজী আজহারুল হককে কাফনের কাপড় পাঠালেন আর চিঠি দিলেন পাট রপ্তানি বন্ধ কর। কাজী আজহারুল হক অনেকটা ভয়ই পেলেন এবং ইউরোপের বায়ারসহ সবার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলেন। কাজী আজহারুল হকের দেখা দেখিতে একে একে সবাই পাট রপ্তানি বন্ধ করলেন। এটা মোটামুটি বিশ্বে নাড়া দিল।

 

এরপর যুবক পিয়ার ঠিক করলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে তার গাড়িচালক সিরাজ ও মাহবুবুল হককে নিয়ে কুষ্টিয়ার পাথরঘাটা বর্ডার দিয়ে চলে গেলেন ভারতের কৃষ্ণনগরে। কৃষ্ণনগরে গিয়ে দেখলেন প্রায় লাখ খানেক লোক ইতোমধ্যে শরণার্থী হিসেবে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। কৃষ্ণনগর স্কুলে গিয়ে দেখলেন ওখানে তাজউদ্দীন আহমেদ, কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, মেজর জলিল ও কৃষ্ণনগর স্কুলের এক শিক্ষক নগেন বাবু বসে আছেন স্কুলের বারান্দায়। সে সময় তাজউদ্দীন আহমেদকে কাজী পিয়ার বললেন আমি যুদ্ধ করতে চাই। তাজউদ্দীন আহমেদ বললেন তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি বিত্তশালী পরিবারের ছেলে। যদি পার এই শরণার্থীদের জন্য কিছু কর। তখন তিনি জানালেন আমার কাছে ৪৪ হাজার টাকা আছে এটা আপনি নেন এবং শরণার্থীদের জন্য কিছু করেন। এই টাকায় শরণার্থীদের জন্য খাবার কেনা হলো।

 

এর প্রায় ৭/৮ দিন পর মেজর জলিল এসে বললেন, তুমি কি যুদ্ধে যাবে? কাজী পিয়ার বললেন যুদ্ধ করার জন্যই তো এসেছি। তারপর মেজর জলিল (তিনি ছিলেন নয় নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার) বললেন চল। নিয়ে গেলেন কলকাতার উইলিংটন পার্কের পাশে একটা চারতলা ভবনে। সেখানে গিয়ে দেখেন আরো ২০/২৫ জন যুবক আছে ওখানে। কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছে আবার কেউ ছাত্র। কাজী পিয়ার তার কাছে থাকা শেষ ১৪ হাজার টাকা ওই বাড়ির মালিকের হাতে তুলে দেন, যাতে যতদিন খুশি বাড়িটি ব্যবহার করতে পারেন। ওইদিন ম্যাপ যুক্ত পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশ মিশনের যাত্রা শুরু হলো ওই ভবনে। ভারতের বিহারে প্রশিক্ষণের পর ভারতের হিঙ্গোলগঞ্জ ক্যাম্প থেকে রওনা দিয়ে পৌঁছালেন বসন্তপুর। মূলত নয় নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর প্রথম প্রবেশ তখনি। মুক্তিবাহিনীতে ছিল রাশিয়ান কাল্কবিনাস, এল এমজিসহ আরো অস্ত্র। কিন্তু মুক্তিবাহিনী প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি দালালেরা খবর পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তানি মিলিটারিদের। মুক্তিবাহিনী আক্রমণের আগেই মিলিটারিরা আক্রমণ চালাল। যুদ্ধ চলল সমান তালে। প্রায় চার রাত চার দিন যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রায় ১০-১২ জন নিহত হয়। আহত হয় শতাধিক। আর এই বসন্তপুর কালীগঞ্জ যুদ্ধে ৫২-৭০ জন পাকিস্তানি নিহত হয়। এর প্রতি আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী যশোর ক্যান্টমেন্ট থেকে আবার ফোর্স পাঠায়। কিন্তু সেখানেও পাকবাহিনী পিছু হটে। তারপর মুজিব বাহিনী, গেরিলা বাহিনী এক হয়ে আক্রমণ চালায় কপিলমুনি ক্যাম্প। সেখানেও কাজী পিয়ার বীরত্বের পরিচয় দেন।

 

 

এরপরই কাজী পিয়ার সবচেয়ে সাহসিকতার কাজ করেন। মুক্তিবাহিনীর রসদ প্রায় শেষ হয়ে আসছিল কপিলমুনি যুদ্ধেই। তারপর হানা দিল শীত। মুক্তিবাহিনীর লোকেরা ক্লান্ত এবং শীতে কাবু হয়ে যাচ্ছিল। শীতবস্ত্র এবং খাবারের যোগান নিতে হলে খুলনায় যেতে হবে। কিন্তু খুলনায় পাক বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। সেই অবস্থায় একা পিয়ার খুলনায় এলেন লঞ্চে করে। ঝুড়িতে কচুরলতির নিচে গ্রেনেড নিয়ে। খুলনায় পৌঁছেই পড়লেন মহাবিপদে। রাজাকারেরা টের পেয়ে যায়। তাড়া করে পিয়ারকে। পিয়ার আশ্রয় নেন খুলনার টুটপাড়ার একটি বাড়িতে। কোনোমতে পালিয়ে পৌঁছান দৌলতপুর নিজ বাড়িতে। সেখানে গিয়ে ভগ্নিপতিকে বলেন এই মুহূর্তে বাজারে যান। শীতবস্ত্র আর শুকনো খাবার যত আছে কিনে আনেন। তখন প্রায় ১৪-১৫ হাজার টাকার শীতবস্ত্র আর শুকনো খাবার কেনা হলো। এগুলো নিয়ে পিয়ার আর তার গাড়িচালক মোসলেম রওনা দেন। পথে গল্লামারি এলাকায় পাকবাহিনীর লোকেরা গাড়ি আটকায়। জিজ্ঞাসা করে কিসের মাল এগুলো? মোসলেম বুদ্ধি করে বলেন দোকানের মাল। পরে মোসলেম এগুলো পৌঁছে দেন মুক্তিবাহিনীর কাছে।

 

কাজী পিয়ারউজ্জামান বলেন, ‘মোসলেম ড্রাইভারকেও মুক্তিযোদ্ধা বলতে হবে। কারণ সে এগুলো পৌঁছে না দিলে মুক্তিযোদ্ধারা বিপদেই পড়ত। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, সেই মোসলেম ড্রাইভার এখনো জীবিত কিন্তু তার কোনো মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেই। অথচ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভাব নেই। মোসলেম ড্রাইভারের এই অবদান যে সেই সময়ের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না।’

 

এরপর আরো ছোটখাট যুদ্ধে অংশ নেন কাজী পিয়ার। সর্বশেষ অংশ নেন শিরমনি যুদ্ধে। ১৭ ডিসেম্বর এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে খুলনা শত্রু মুক্ত হয় এবং নয় নম্বর সেক্টর পুরোপুরি সফলতা পায়।

 

কাজী পিয়ারউজ্জামান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করেছি দেশকে বাঁচানোর জন্য, দেশকে ভালোবেসে আর বঙ্গবন্ধুর ডাকে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন এটাতেই অনেক শান্তি। যখন আমার প্রচুর অর্থ ছিল তখন দেশের জন্য বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করিনি। এখন আমি অসহায়। আমি ভাড়া থাকি তিন মেয়ে আর নাতিদের নিয়ে। জাতির জনকের কন্যার কাছে একটাই আবেদন, যদি আমার এই কথা তার কান পর্যন্ত যায়, তবে যেন আমাকে একটা মাথা গোজার ঠাঁই করে দেন। তাহলে শেষ বয়সে মরেও শান্তি পাব।’

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৬/ফিরোজ/এসএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়